শিরোনাম
আ.লীগে ভুঁইফোড় সংগঠন: অভিযোগের তীর কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে (পর্ব-২)
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২১, ১৬:১৯
আ.লীগে ভুঁইফোড় সংগঠন: অভিযোগের তীর কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে (পর্ব-২)
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ পেতে ‘আওয়ামী', 'লীগ', মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার ব্যানারে দেশে নিত্যনতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটছে নিয়মিত। এসব সংগঠনের মধ্যে কেবল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নাম ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক সংগঠন। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, দল ক্ষমতায় এলেই দলের ভেতরে বা বাইরের ব্যক্তি দলের নাম ভাঙিয়ে স্বার্থ হাসিলে উঠেপড়ে লাগে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যত্রতত্র গড়ে উঠে এসব সংগঠন।


দলের নেতারা বলছেন, রাজধানীকেন্দ্রিক এসব ভুঁইফোড় সংগঠন এখন ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগকেই কেবল বিতর্কিত করছে না, সরকারের ভাবমূর্তিকেও করছে প্রশ্নবিদ্ধ।


২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকারকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছিলো আওয়ামী লীগ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দণ্ড কার্যকরের দেয়া প্রতিশ্রুতি এখন পূর্ণ হয়েছে। বিচারের সাফল্য আওয়ামী লীগের ঘরে এসেছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।



জানা গেছে, সংগঠনের নামকরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ কামাল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উঠে আসছে অহরহ। এছাড়া অবাধে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা, জয়বাংলা ও প্রজন্মসহ নানা শব্দও ব্যবহার করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ নাম ব্যবহার করতে হলে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল থেকে অনুমোদন নিতে হয়।


খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নিবন্ধন, গঠনতন্ত্র ও কার্যালয় কিছুই নেই। সংগঠনের নেতা-কর্মীও হাতে গোনা কয়েকজন। অনেক সংগঠনের প্যাডে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ঢাকার ঠিকানা লেখা আছে। একই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন নামে একাধিক সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এমপি বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধ’নাম নিয়ে গড়ে তুলছেন একের পর এক সংগঠন। বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের মতো অননুমোদিত সংগঠনের নানা অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি প্রায় নিয়মিত। তিনি নিজেই সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক, ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চের সভাপতি। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম সমন্বয় পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ ও প্রজন্ম মঞ্চের আয়োজনে জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি-ডিআরইউ কেন্দ্রিক সভা, মানববন্ধনেও রয়েছে তার উপস্থিতি।



বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। বাংলাদেশ আওয়ামী তরুণ লীগ, বাংলাদেশ গণ আজাদী লীগ, বঙ্গবন্ধু একাডেমিসহ বেশ কয়েকটি ভুঁইফোড় সংগঠনের অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিলো নিয়মিত। মন্ত্রী থাকাকালীন অবস্থায় মোফাজ্জল হোসেন মায়া এসব অনুষ্ঠানে কথনো প্রধান অতিথি আবার কখনো প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকতেন।


২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী উল্লেখ করে নামসর্বস্ব এসব সংগঠন গড়ে তুলছে একশ্রেণির তদবিরবাজ গোষ্ঠী। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে- মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, মুক্তিযুদ্ধ ও গণমুক্তি আন্দোলন, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি প্রতিরোধ কমিটি, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ, সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা ফ্রন্ট, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা লীগ, জয় বাংলা মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সহযোগী সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধা সমাজ কল্যাণ ও প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধা প্রভৃতি।


জানা গেছে, ‘আওয়ামী’, ‘লীগ’, ‘স্বাধীনতা’ প্রভৃতি নাম নিয়ে গড়ে তোলা এসব সংগঠনে এমনকি অনেক আওয়ামী লীগ নেতা আছেন যারা এসব সংগঠনের চেয়ারম্যান, সভাপতির পদেও রয়েছেন। আওয়ামী লীগের পদধারী এসব নেতারা ভুঁইফোড় এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও ব্যানারে তাদের নাম, পদবী সংশ্লিষ্ট সংগঠনের পদবীর পরিবর্তে দেয়া থাকে আওয়ামী লীগের পদবী।



আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, দলের গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগের রয়েছে সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং বিভিন্ন উপকমিটি। স্বীকৃত সংগঠনের বাইরে যেকোনো নামের সাথে ‘লীগ’বা ‘আওয়ামী’শব্দ জুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নামের আগে বা পরে আওয়ামী যোগ করলেই আওয়ামী লীগ নয়। এদের সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।


ভুঁইফোড় সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া’র মুঠোফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।


অভিযোগের বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) সকাল থেকে একাধিক নাম্বারে কল এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।


সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, ওই সব সংগঠনের সাথে আমাদের আওয়ামী পরিবারের কোনো সম্পর্ক নাই। ভবিষ্যতেও সম্পর্ক থাকবে না। অননুমোদিত বা ভুঁইফোড় কোনো সংগঠনের অনুষ্ঠানে যাতে নেতারা না যান আমরা এ ব্যাপারে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করব। আমরা চাই না আমাদের দলের কোনো নেতা-কর্মী নামধারী অঙ্গসংগঠনের নামে বা কোনো ভুঁইফোড় সংগঠনের অনুষ্ঠানে যাক।



আওয়ামী বা মুক্তিযুদ্ধ নামের সাথে মিল রেখে কেউ কোনো সংগঠন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা এগুলো করছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হবে।


আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বিবার্তাকে বলেন, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সকলকে জানানো হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অনেকেই দলের নেতাদেরকে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। যার কারণে আজকের এই পরিণতি। যতই ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকুক না কেন দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এসব ভুঁইফোড় সংগঠন সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া দরকার। এসব সংগঠনের কারণে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এটার ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স নিয়ে আসতে হবে।



তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে যেকোনো সামাজিক সংগঠনের নামে ‘বঙ্গবন্ধু’এবং ‘লীগ’ এই দুটো শব্দ লাগানো হয়। এদের বেশিরভাগই উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব লাগায়। মুক্তিযুদ্ধের কাজ করতে চাইলে সামাজিক সংগঠনের ব্যানারেই করা যায়। ‘বঙ্গবন্ধু’এবং ‘লীগ’এই শব্দগুলো চয়ন করার ক্ষেত্রে বারণ করা হয়। যারা এসব নিষেধ মানেন না বোঝাই যায় তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে।


বিবার্তা/সোহেল/গমেজ/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com