নির্বাচনী এলাকা কুষ্টিয়া-১
আ.লীগের মনোনয়ন লড়াইয়ে সাবেক সাংসদের তিন পুত্র
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ২০:৫৪
আ.লীগের মনোনয়ন লড়াইয়ে সাবেক সাংসদের তিন পুত্র
দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি আফাজ উদ্দিন আহমেদের তিন পুত্রের তিনজনই আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন পাওয়ার লড়াইয়ে মাঠে নেমেছেন। নৌকার মনোনয়ন পেতে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন ।


গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন বড় পুত্র নাজমুল হুদা পটল বিশ্বাস ও ছোট পুত্র উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এজাজ আহমেদ মামুন বিশ্বাস। আর মেজো পুত্র আরিফ আহমেদ বিশ্বাস ঢাকা থেকে কর্মীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। পাশাপাশি বড় ও ছোট ভাই নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে আলাদাভাবে দলের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।


দলীয় মনোনয়ন পেতে তিন ভাই কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। মনোনয়নের বিষয়টি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সাবেক এমপির এই তিন পুত্র নির্বাচনের মাঠ ছাড়বেন না বলে জানা গেছে।


আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক এমপি আফাজ আহমেদের তিন পুত্রের মধ্যে রয়েছেন বড় পুত্র উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক নাজমুল হুদা পটল, মেজো পুত্র উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফ আহমেদ বিশ্বাস এবং ছোট পুত্র দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এজাজ আহমেদ মামুন বিশ্বাস।


তিন ভাইয়ের নৌকার টিকিট পাওয়ার প্রতিযোগিতার বিষয়টি এখানকার মানুষের মধ্যে সরব আলোচনা চলছে। যদিও তিন ভাই মনোনয়ন পাওয়ার লক্ষ্যে আলাদা অবস্থান নেওয়ায় আফাজ পরিবার সমর্থিত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। তারা মাঠে থাকা দুজনের মধ্যে কার পক্ষ নিবেন এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।


উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আফাজ উদ্দিন আহমেদ এরশাদের আমলে ১৯৯০ সালের দ্বিতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তখনকার উপজেলা বিএনপির সভাপতি আহসানুল হক মোল্লাকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।


২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তখনকার উপজেলা বিএনপির সভাপতি আলতাফ হোসেনকে পরাজিত করে মহাজোটের মনোনীত প্রার্থী আফাজ উদ্দিন আহমেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও চারবারের নির্বাচিত এমপি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আহসানুল হক মোল্লার এই নির্বাচনী এলাকাটি এক সময় বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। তবে এখন আর সেই দিন নেই। গত ১৫ বছর ধরে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে।


এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আফাজ উদ্দিন আহমেদ রাজনীতিতে যথারীতি সংবেদনশীল থাকলেও তাতে বাগড়া পড়ে মেজো পুত্র আরিফ আহমেদ বিশ্বাসের কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে।


ওই সময় একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তোলেন আরিফ বিশ্বাস। তিনি নিজের অনুগত দলের নির্দিষ্টসংখ্যক ব্যক্তিকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দলটির বড় একটি অংশের বিরাগভাজন হন। আরিফ বিশ্বাসের এমন খামখেয়ালিপনার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ আর অসন্তোষ দেখা দেয়।


উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শরীফ উদ্দিন রিমন ও সহ-সভাপতি আলহাজ্ব রেজাউল হক চৌধুরীসহ সিনিয়র নেতাদের অনেকে তার কাছ থেকে সরে আসেন।


দলের ভেতরে-বাহিরে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আফাজ উদ্দিনকে। যা পরবর্তী নির্বাচনে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সক্রিয় হয়ে ওঠে বিদ্রোহী একটি গ্রুপ। এই গ্রুপের নেতৃত্ব দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলহাজ্ব রেজাউল হক চৌধুরী।


২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় নির্বাচনে আফাজ উদ্দিন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেলেও আনারস প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়ানো দলের বিদ্রোহী প্রার্থী রেজাউল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। দলের অনেকে মনে করেন, ওই নির্বাচনে ছেলে আরিফ বিশ্বাসের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাশুল গুনতে হয় আফাজ উদ্দিনকে।


আরিফের দুর্নামের ভাগ বাবার ঘাড়ে উঠে আসে। পরে আরিফকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরোপুরি রাজনীতির বাইরে রাখেন আফাজ উদ্দিন।


সামনে আনেন ছোট ছেলে অ্যাডভোকেট এজাজ আহমেদ মামুনকে। বাবার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে সরকারি শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আরিফ আহমেদ বিশ্বাস নিজের পরিবার নিয়ে রাজধানীতে পাড়ি জমান।


তিনি এতদিন রাজনীতির ধারে কাছেও ছিলেন না। কয়েক মাস আগে শোডাউন করে এলাকায় ফেরেন। অতীতের ভুলত্রুটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নতুন করে রাজনীতিতে আসার প্রয়াস চালান।


তিনি মনোনয়ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেন। তবে অপর দুই ভাই অনড় অবস্থানে থাকায় পারিবারিকভাবে একক প্রার্থিতার বিষয়টি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি তারা। এ কারণে নাখোশ হয়ে আরিফ বিশ্বাস বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।


আফাজ উদ্দিন আহমেদকে একাদশে মনোনয়ন না দেওয়া হলেও সর্বশেষ অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তার ছোট ছেলে অ্যাডভোকেট এজাজ আহমেদ মামুনকে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়।


সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল চৌধুরীর ছোট ভাই উপজেলা যুবলীগের বর্তমান সভাপতি বুলবুল আহমেদ টোকেন চৌধুরীকে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এজাজ আহমেদ মামুন।


উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদ মামুন বিশ্বাস এবার জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নিয়মিত গণসংযোগ করছেন তিনি।


একই আশায় রয়েছেন মামুনের বড় ভাই অধ্যাপক নাজমুল হুদা পটল। তিনি একরকম অভিমান করে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। এক সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থাকলেও বর্তমান কমিটিতে সদস্য পদেও রাখা হয়নি তাকে। এ নিয়ে তার অনুসারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ রয়েছে।


তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে রাজশাহীতে বসবাস করছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের পক্ষে রাজনীতির হাল ধরার লক্ষ্যে আবার এলাকায় ফিরে আসেন পটল বিশ্বাস। তিনিও কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে পুরোদমে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। এমনকি তারা আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করে আসছেন। বিভিন্ন স্থানে নিজেদের ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার লাগাচ্ছেন।


মনোনয়ন ইস্যুতে সাবেক এমপি আফাজ আহমেদের তিন পুত্রই মরিয়া হয়ে মাঠে আছেন। চূড়ান্তভাবে দলীয় প্রার্থী মনোনীত না হওয়া পর্যন্ত তারা কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে চাইছেন না। রয়েছেন বিপরীতমুখী অবস্থানে।


বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মামুন বিশ্বাসই কার্যত আফাজ পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যদিও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর মামুন বিশ্বাস অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠেন। এতে সাধারণ নেতাকর্মীদের সঙ্গে বেশ খানিকটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তার।


তবে তিন ভাইয়ের মধ্যে এই মুহূর্তে মামুন গণসংযোগে কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন। দলীয় কর্মী-সমর্থকদের একটি অংশ তার পক্ষে রয়েছেন। অন্যদিকে বাবার মতোই পরিচ্ছন্ন ইমেজের অধিকারী পটল বিশ্বাসও নেতাকর্মীদের কাছে টানতে পাল্লা দিয়ে গণসংযোগে নেমেছেন।


মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক এমপি আফাজ আহমেদের বড় পুত্র উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক নাজমুল হুদা পটল বিবার্তাকে বলেন, দুঃসময়ে আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, আফাজ উদ্দিন আহমেদের ছেলের পরিচয়েই আমার রাজনৈতিক পরিচয় সীমাবদ্ধ- তা আমি মনে করি না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের রাজনীতিতে দৌলতপুর, কুষ্টিয়া কলেজে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভূমিকা আছে- তা দল বিবেচনায় নিবে। পরিবারের বড় ছেলে হিসাবে বাবার শূন্যতা পূরণ করার দায়িত্ব আমার। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আফাজ পরিবারের যে সুনাম ও ঐতিহ্য রয়েছে তা ধরে রাখতে যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন।


তিনি আরো বলেন, বাবা যতদিন ছিলেন ততদিন নির্ভার ছিলাম। কিন্তু এখন পরিবারের পক্ষে দলের জন্য অনেক বড় দায়িত্ব সামনে চলে এসেছে। সেই দায়িত্বের জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত গ্রামে গ্রামে ঘুরছি, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যথেষ্ট ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। কে মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য সেটা দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নির্ধারণ করবেন। দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে মেনে নিয়ে তার পক্ষে কাজ করব। এসময় তিনি বলেন, বড় ছেলে হিসাবে বাবার রাজনৈতিক উত্তরসূরি তিনিই।


সাবেক এমপির ছোট পুত্র দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এজাজ আহমেদ মামুন বিবার্তাকে বলেন, আমি মনোনয়ন প্রত্যাশী- এটা বিচার বিশ্লেষণ করবে দৌলতপুরের আপামর জনসাধারণ ও জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমি আশাবাদী, মনোনয়ন বোর্ডে আমার নামই আসবে। পরিবারের তিনজনের মনোনয়ন চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বড় দলে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকতেই পারে, পরিবারে থাকতে পারে- পরিবারের বাইরেও থাকতে পারে। জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে উপযুক্ত মনে করবেন তাকেই দিবেন। আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নাই। আমার বড় ভাই যদি নমিনেশন পায় তার সাথে কাজ করব, মেজো ভাই পেলে তার সাথে কাজ করব, যদি আমার পরিবারের বাইরেও কেউ নমিনেশন পায় তার হয়ে কাজ করব। এসময় তিনি দাবি করেন তাদের মধ্যে কোনো পারিবারিক দ্বন্দ্ব নাই এবং তিনিই আফাজ উদ্দিন বিশ্বাসের রাজনৈতিক উত্তরসূরি।


সাবেক এমপির মেজো পুত্র উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফ আহমেদ বিশ্বাসকে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।


প্রসঙ্গত, দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আফাজ উদ্দিন আহমেদের রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর একাধারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।


বিবার্তা/তুহিন/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com