
বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দাবি করেছেন, সরকারের চাপ ও হুমকির মুখে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। একই কারণে তিনি বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
বিচারপতি তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’এ এমন দাবি করেছেন। ৬১০ পৃষ্ঠার বইটি মাত্রই প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি এখন আমাজনে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। অ্যামাজান তাদের ওয়েবসাইটে বইটির ভূমিকাসহ প্রথম ১০ অধ্যায় সবার জন্য উন্মুক্ত করেছে।
এই বইতে বিচারপতি সিনহা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন কোন পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়েছিল, কিভাবে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং তারপর কেন তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন।
তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মুখে তিনি দেশে ছেড়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি যেন সরকারের পক্ষ যায়, সেজন্যে তার ওপর সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে চাপ তৈরি করা হয়েছিল।
সর্বশেষ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে তিনি ছুটিতে যান। সরকারের পক্ষ থেকে অসুস্থতার কথা বলা হলেও ১৩ অক্টেবর তিনি রীতিমত বোমা ফাটিয়ে বিদেশে চলে যান। তখন বিচারপতি সিনহা বলে যান, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি ‘বিব্রত’। তার ছুটির মেয়াদ শেষে ১১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারপতি সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বিচারপতি সিনহার অভিযোগের বিষয়ে ডিজিএফআই বলেছে, কোনো ব্যক্তিকে এ ধরনের থ্রেট বা হুমকি দেয়া আমাদের কাজ নয়। এটা আমরা কখনো করি না।
এখানে বইটির মুখবন্ধের কিছু অংশের অনুবাদ দেয়া হলো।
সিনহা লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের অন্য সদস্য ও মন্ত্রীরা পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে যাবার জন্য আমার কঠোর নিন্দা করেন। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা আমার বিরুদ্ধে অসদাচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনে বদনাম করতে শুরু করেন।
আমি যখন আমার সরকারি বাসভবনে আবদ্ধ, আইনজীবী ও বিচারকদের আমার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না, তখন সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় - আমি অসুস্থ। আমি চিকিৎসার জন্য ছুটি চেয়েছি। একাধিক মন্ত্রী বলেন, আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবো।
অক্টোবরের ১৪ তারিখ, যখন আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই, তখন একটি প্রকাশ্য বিবৃতিতে আমি পরিস্থিতি স্পষ্ট করার চেষ্টায় একটি বিবৃতি দেই যে, আমি অসুস্থ নই এবং আমি চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি আশা করছিলাম যে আমার প্রত্যক্ষ অনুপস্থিতি এবং আদালতের নিয়মিত ছুটি, এ দুটো মিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সহায়ক হবে এবং শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সরকার ওই রায়ের যে মর্মবস্তু, অর্থাৎ বিচারবিভাগের স্বাধীনতা যে জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর - তা বুঝতে পারবে।
শেষ পর্যন্ত দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যার নাম ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স- তাদের ভীতি প্রদর্শন এবং আমার পরিবারের প্রতি হুমকির সম্মুখীন হয়ে আমি বিদেশ থেকে আমার পদত্যাগপত্র জমা দেই।
সিনহার এ বইতে তার ব্যক্তিগত ও বিচার বিভাগে কর্মজীবনের কথা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রতি চ্যালেঞ্জসমূহ, বিচারবিভাগ ও রাজনীতিবিদদের মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের বাড়াবাড়ি, জরুরি অবস্থার প্রভাব এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ডিজিএফআইয়ের অর্থ আদায়ের বিবরণ আছে।
বিচারপতি সিনহার বইয়ের একটি মুখবন্ধ রয়েছে, যাতে তিনি সংক্ষেপে ‘বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব’ বর্ণনা করেছেন এবং তার ভাষায় কী পরিস্থিতিতে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ ত্যাগ করে বিদেশে গিয়েছিলেন তা লিখেছেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ নিয়ে বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাতকারও দিয়েছেন। গত বছরের নানা নাটকীয় ঘটনাবলীর পর কোন গণমাধ্যমে এটিই ছিল তার প্রথম সাক্ষাৎকার।
সংসদে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের ইমপিচ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়ল কাউন্সিলের পরিবর্তে পার্লামেন্টের সদস্যদের দেবার পর ২০১৬ সালের ৫ই মে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বিশেষ বেঞ্চ ওই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয়। সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করে এবং সাত সদস্যের একটি বেঞ্চে আপিলের শুনাশি হয়।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার বইতে লেখেন, জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বহাল রাখে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ১ তারিখ সর্বসম্মত রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়।
সেখানে তিনি লেখেন, ওই সিদ্ধান্তের পর সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে - যাতে সেই রায়কে বাতিল করার জন্য আইনী পদক্ষেপের আহবান জানানো হয়।
নিজের বইয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে কথা বলেছেন এস কে সিনহা। জরুরি অবস্থার সময় নিজের অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, জরুরি অবস্থার সময়ে আমাকে ডেকেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। তিনি আমাকে পদত্যাগের অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু আমি রাজি হইনি। ওই সময় তার সেক্রেটারি মেজর জেনারেল আমিনুল করিমও উপস্থিত ছিলেন। জরুরি অবস্থা ডাকার পর দেশের অবস্থা কী হবে, তা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বলে বইতে দাবি করেন বিচারপতি সিনহা।
বইতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনে নিজের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেন সিনহা।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ নিয়ে বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাতকারও দিয়েছেন। গত বছরের নানা নাটকীয় ঘটনাবলীর পর কোনো গণমাধ্যমে এটিই ছিল তার প্রথম সাক্ষাৎকার। বুধবার রাতে বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান প্রবাহে বিচারপতি সিনহা ওই সময়ের পরিস্থিতি এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়েও কথা বলেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা
বিবার্তা/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]