শাহবাগ গণজাগরণের এক দশক
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
শাহবাগ গণজাগরণের এক দশক
এফ এম শাহীন
প্রিন্ট অ-অ+

বাঙালির জাগরণ ঘটেছে যুগে যুগে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে মহান ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচন, '৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ, '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সর্বশেষ ২০১৩-এর শাহবাগ আন্দোলন। এটা নিশ্চিত করে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল শক্তিকে একত্রিত করার সফল প্রেক্ষাপট শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ।


শাহবাগের হাত ধরে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। একে অপরের হাতে-হাত, কাঁধে-কাধ মিলিয়ে গানে-কবিতায়-স্লোগানে শাহবাগ হলো বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ হলো শাহবাগ। যে তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, সেই প্রজন্ম এগিয়ে এলো মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তঋণ শোধ করতে। জন্মযুদ্ধের পর দ্বিতীয়বারের মত আশ্চর্য এক সূর্য হয়ে ফেটে পড়ল বাংলাদেশ তথা সমগ্র বাঙালি জাতি। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল প্রকম্পিত হলো মুক্তিযুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে। একাত্তরের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ’৭১-এ ঝাঁপিয়ে পড়ে যেভাবে পরাধীন বাংলাকে মুক্ত করেছিল বাঙালি জাতি, ঠিক তেমনই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় ও শ্রেণিভেদ ভুলে আবার এক হয়ে দাঁড়াই আমরা। অনেকের মতে, রাজনীতিবিমুখ এই তরুণরা এক হয়েছিল শুধু ’৭১-এর ঘাতক-দালালদের ফাঁসির দাবিতে। তাদের সাথে গর্জে উঠেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, কবি, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইমাম, শ্রমিক গৃহবধূ; শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বিশেষ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।



একাত্তরের মানবতাবিরধী বিচারের উদ্যোগের শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে বিএনপি- জামায়াত, স্বাধীনতাবিরোধী দেশদ্রোহীরা দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র করে আসছিল। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করেছিল তারা। দেশের মধ্যে কিছু বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদকে কিনতেও অসুবিধা হয়নি তাদের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রতি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক-দালাল, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার করে-বাঙালি জাতির ৪২ বছরের কলঙ্কমোচন করা।



আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু আমাদের প্রেরণা ছিল মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের লাখো শহীদের রক্তস্নাত স্বপ্ন, বিশ্বাস আর আত্মত্যাগ। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে স্বাধীনতা বিরোধিদের পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা ছিলাম ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। শাহবাগের জড় হওয়া তরুণদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তঋণ শোধাতে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি, স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের মতো সংগঠনকে নিষিদ্ধকরণ। যদিও এটি ছিল দেশের মানুষের দীর্ঘ দিনের লালিত আকাঙ্ক্ষা।


শাহবাগ চত্বরে যে আকস্মিক, স্বতঃস্ফূর্ত গণজমায়েত ঘটেছিল সেটি কেবল প্রজন্ম চত্বরের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র বাঙালির মধ্যে। প্রসারিত হয়েছিল দেশ থেকে দেশান্তরে। যার প্রধান ভূমিকায় ছিল জাতীয় প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। নির্ভীক সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক, অনলাইন গণমাধ্যম ও সাময়িকী প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করে দেশ-বিদেশে প্রচারের ব্যবস্থা করে তরুণদের উজ্জীবিত ও গণজাগরণকে তীব্র করে তুলেছিল। তবে কয়েকটি জামায়াত আদর্শের গণমাধ্যম গণজাগরণ মঞ্চকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে মত্ত হয়ে ওঠে এবং প্রচুর মিথ্যাচার ও ভুয়া তথ্য উপস্থাপন করে যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়।
 

বিশেষ করে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, ইনকিলাব, সংগ্রাম, দিনকাল ও দিগন্ত টেলিভিশন শুধু কুৎসা রটিয়ে ক্ষ্যান্ত ছিল না, আমাদের ফ্যাসিস্ট বলতেও ছাড়েনি। তারা আমাদের তথাকথিত তরুণ প্রজন্ম বলে সম্বোধন করে এবং বারবার দাবি করে ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন ও ব্যর্থতা, দুর্নীতিকে আড়াল করতে, মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে সরাতে বামদের নিয়ে শাহবাগ চত্বরের জন্ম দেয়। গোয়েবলসের প্রোপাগান্ডার সূত্র অনুসরণ করে বিশাল বিশাল মিথ্যা নিয়ে হাজির হয়, যাতে দেশের মানুষ বিভ্রান্ত হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য বাধাগ্রস্থ করা যায়। আমার দেশ পত্রিকা এমনভাবে শতভাগ ভুয়া খবর পরিবেশন করতে থাকে যাতে করে মানুষ যাচাই বাছাই করার আগেই বিভ্রান্ত হয়। তারা কাবা শরিফে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য মানববন্ধনের মতো মিথ্যা খবর ছাপাতে থাকে। বøগার ও শাহবাগের সংগঠক কর্মীদের নিয়ে মিথ্যা খবরের ঝুলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে। শাহবাগের বিরুদ্ধে কলম ধরে কিছু পেইড বুদ্ধিজীবী-লেখক, তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্প-প্রবন্ধ লিখতে থাকে। তবে বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী-লেখক-কবি শাহবাগের বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন স্লোগান, গান, শপথ পাঠ, জামাতের সাথে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট, গণস্বাক্ষর, মোমবাতি প্রজ্বলন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহীদদের উদ্দেশে লেখা চিঠি ও তিন মিনিট নীরবতা নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, গান লেখেন।



এইদিকে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে রাজনৈতিক দল বিএনপি তিনবার তাদের অবস্থান পাল্টায়, যার কারণে তাদের অনেক সমর্থকও বিব্রত হন। শাহবাগে নষ্ট ছেলেরা অবস্থান নিয়েছে, তারা ইতিহাস জানে না এমন মন্তব্য করে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের তরুণ প্রজন্ম ৫ ফেব্রয়ারি থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে যে স্ফুলিঙ্গের জন্ম দেয় তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে। সারাদেশের মানুষ পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়, ১৯৭১ এর মতো সদর্পে আপোসহীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। আমরা জয় বাংলা সেøাগানকে পুনর্জাগরণ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করি।



হাজারও ষড়যন্ত্রের পরে প্রজন্ম চত্বরের গর্জনে স্বাধীনতাবিরোধীদের কাঁপন ওঠে, একাত্তরের চেতনা ধারণ করে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা শাহবাগে প্রাণের টানে জড়ো হন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে পাকিস্তানমুখি যাত্রা করা বাংলাদেশে আমাদের প্রজন্মের কেউ এমনকি আমাদের পূর্ব বা পরবর্তী প্রজন্ম আর বিশ্বাস করতই না যে এদেশে আবারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হবে, গোলাম আজম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী বা সাকাচৌদের কারাপ্রকোষ্ঠে আটকে রাখা সম্ভব হবে। বরং এ ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি ও বাংলাদেশের পাকিস্তানমুখি যাত্রাই একমাত্র সত্য। কিন্তু শাহবাগ প্রজন্ম এসব ভুল প্রমাণ করে রুখে দাঁড়ায় আপন শক্তিতে।


দেশ-বিদেশের নানা ষড়যন্ত্রের পরেও বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিশ্রতি রেখেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারে আপোসহীন থেকে এক লৌহমানবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বিশ্বমোড়লদের রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ’৭১এর ঘাতক রাজাকারদের ফাঁসি বাস্তবায়ন করতে আদালতকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জন কেরি, হিলারী ক্লিনটন, কিংবা ডেভিড ক্যামেরনদের অনুরোধ উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায় কার্যকর করা একমাত্র শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব। দেশের ভেতরে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির ও তাদের দোসররা পুলিশ হত্যা থেকে শুরু করে কী নৃশংস তাণ্ডবই না চালিয়েছে। ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, পেট্রোল-বোমায় পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা, যা বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি! কুখ্যাত খুনি রাজাকার সাঈদীকে চান্দে দেখার খবর ছড়িয়ে হত্যা করা হলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও সাধারণ মানুষদের।


একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত যখন শত ষড়যন্ত্র করেও তাদের পাকি আদর্শে বিশ্বাসী আদর্শিক পিতাদের, ’৭১এর ঘাতকদের বিচার বানচাল করতে পারছে না, তখন আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামকে কাজে লাগিয়ে শুরু করলো দেশ ধ্বংসের চক্রান্ত। নাস্তিকতার ধোয়া তুলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়ন করা সরকারকে উৎখাত করা ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের সাথে যুক্ত হলো বিএনপিসহ মুখোশধারিরাও। হাজার হাজার নিরীহ মাদ্রাসার ছাত্রদের কাজে লাগিয়ে কর্মসূচি দিল ঢাকা অচলের।



৫ মে ২০১৩, ভয়াল সেই রাত ঢাকার বুকে একে দিল ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ক্ষতচিহ্ন। ধর্মের নামে এত জঘন্য ভয়াবহ তাণ্ডব, মানুষ খুন জাতি আর কখনও দেখেনি। বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ভিতর আগুন দিল, মুসলিমদের হাজার হাজার পবিত্র গ্রন্থ কোরআন পুড়িয়ে দিল। মতিঝিল শাপলা চত্বর হয়ে উঠল রণক্ষেত্র। বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্নে এতদিন যারা বিভোর ছিল, আজ তারা আনন্দে আত্মহারা। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চেও আক্রমণ করা হলো, কিন্তু জাগরণ যোদ্ধারা সেই হামলা প্রতিহত করে দিল। ছাত্রলীগ ২৬ মার্চের পর থেকে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচিতে না আসলেও ঐ দিন সবার আগে তারাই প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্রলীগ মৎস্য ভবনের সামনে প্রতিরোধের গড়ে তুললে হেফাজত শাহবাগে খুব বেশি আক্রমণ করতে পারেনি। তারপরও জামায়াত-হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু ক্যাডার রমনার ভেতর দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের দিকে আসতে চাইলে আমাদের সহযোদ্ধারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে তাদের প্রতিহত করে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম দেখেছে জয় বাংলা স্লোগানের শক্তি।



এইদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধকে যারা ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলেছিল তারা ভিতরে থেকে ভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আর বাইরে বিএনপি জামাত-শিবির পাকিস্তানিদের দোসর। সাথে যোগ দেয় বিভিন্ন ভিনদেশি এজেন্ট বাস্তবায়নকারী এনজিও নেতা ও সংগঠন। যে ব্যক্তি শুধু কর্মসূচি পাঠ করতো তাকে বানানো হলো আন্দোলনের একমাত্র নেতা, তাকে বোঝানো হলো, তোমার ডাকে লাখ লাখ মানুষ হয়েছে, তুমি এই প্রজন্মের ‘বঙ্গবন্ধু’! সম্মিলিত সিদ্ধান্ত থেকে তাকে দূরে সরানো হলো। এই জাগরণকে সামনে রেখে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাবার স্বপ্নে বিভোর। ক্ষমতার লোভ আর রাজনৈতিক অভিলাষে বিতর্কিত ও সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলো কর্মসূচি পাঠ করা মুখপাত্র। ‘জয় বাংলা’ পর ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলতে না দেয়া, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফকে শাহবাগে অপমান করা সেই ষড়যন্ত্রের অংশ।


এখানে আরেকটি নির্মম সত্য হলো আন্দোলনের প্রথম থেকেই দেশের তথা কথিত প্রথম সারির কিছু সুবিধাভোগি সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেনা এমন কিছু আওয়ামী নেতা কর্মী শাহবাগের গণজাগরণ নিয়ে বিভ্রান্ত ছড়াতে উঠে পড়ে লাগলো। কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে এমন আচরণ শুরু করলো যা পরবর্তীতে শাহবাগের মধ্যে বিভেদ তৈরিতে তাদের অপচেষ্টা সফল হয়েছিল।


অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে যে সকল আদর্শহীন, জামায়াত সংশ্লিষ্ট আওয়ামী নেতারা এতদিন ব্যবসা বাণিজ্য বিনা বাধায় করে আসছিল তাদের অস্বস্তিতে পড়তে হল। তাদের নিয়ে কথা উঠতে শুরু হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারাও পরবর্তীতে সুপরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্ত ছড়াতে কাজ করেছে। তারা চায়নি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বলীয়ান এই প্রজন্মের কেউ যেন রাজনীতি ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। তারা ভালো করে বুঝে গেলো শাহবাগের জাগরণ যোদ্ধারা আর যাই করুক জামায়াত-শিবির-রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিষয়ে কখনো আপোষ করবে না।


মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তরুণ প্রজন্মের এক বিপুল সম্ভাবনাময় শক্তির অপমৃত্যু ঘটল। অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য যে শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী মনোভাব আর অবিশ্বাসের খেলায় চুরমার হয়ে গেল! এমন ক্ষত তৈরি করল যা সারাতে আরো কয়েক যুগ অপেক্ষা করতে হবে। তবে বাঙালি সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বারংবার। শাহবাগ পেরেছে যে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সে জয় বাংলাকে ছড়িয়ে দিতে সমগ্র বাঙালির কাছে, আগামী প্রজন্মের কাছে। যারা নির্মাণ করবে জাতির পিতার বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। শাহবাগ গণজাগরণ একাত্তরের খুনি কসাই কাদেরের ফাঁসি দিতে শক্তি যুগিয়েছে। শক্তি যুগিয়েছে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে হাঁটবার। প্রজন্ম জেনেছে মুক্তিযুদ্ধে কারা গণহত্যা করেছে, কারা ধর্ষণ করেছে, তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতেই হবে ।


’৭৫ পরবর্তী সময়ে আমরা জয় বাংলা শব্দটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই শব্দটা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মুখে সমস্বরে উচ্চারিত হওয়া একটি বড় অর্জন। ’৭৫এর পরে জয় বাংলাকে শাহবাগের গণজাগরণের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করি।


মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল শক্তিকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে সফল প্রেক্ষাপট গণজাগরণ মঞ্চ। দীর্ঘ সময় ধরে একটি অহিংস আন্দোলন করতে পারা; বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। আন্দোলনের মাধ্যমে সংসদে আইন প্রণয়ন ও জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে আগামী প্রজন্মকে তৈরি করার ক্ষেত্রে একটি সফল আন্দোলন।


আজ পাঁচ ফেব্রুয়ারি হবে গণজাগরণের একদশক।  সংকটময় পথ মাড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার ঐতিহাসিক বিজয়ের দশবছর পূর্তির শুভেচ্ছা সবাইকে।


আসুন, ইতিহাসের এই বাকবদলের দিনে আবারো স্মরণ করি মানবতার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য, প্রগতির জন্য একত্রিত হওয়ার যে বিকল্প নাই তার প্রমাণ শাহবাগ গণজাগরণ । ভুলে যাওয়া চলবে না, ভালো মানুষদের অনৈক্যের ফলাফলটা পাল্টে দিতে পারে সব ইতিহাস সব অর্জন। আমরা ভাষা আন্দোলন করেছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছি, যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ করে নিশ্চিত রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ গড়বো। সেই সাথে বর্তমানের নব্য দেশবিরোধী লুটেরা যারা দেশের টাকা পাচার করে জাতির পিতার সোনার বাংলাকে পঙ্গু করে দিতে চাই, সেই সকল দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী জাগরণ তৈরি করার নতুন শপথ নেয়ার অঙ্গীকার করি। জয় বাংলা !  


লেখক: এফ এম শাহীন,
সংগঠক, গণজাগরণ মঞ্চ , সাধারণ সম্পাদক, গৌরব’৭১।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com