
সম্প্রতি দেশে ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে ডলারের সঙ্কট বেড়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে সরবরাহ করেও তা কুলানো যাচ্ছে না। আর এ সঙ্কটের কারণে বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। চলতি সপ্তাহে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা এক বছর আগেও ছিল ৮৪ টাকা। যদিও ব্যাংকের এলসিতে (ইম্পোরট এলসি সেটেলমেন্ট) আরো দেড় থেকে দুই টাকা বেশি দামে ডলার লেনদেন হচ্ছে। পাশাপাশি কর্পোরেট ডিলিংয়েও ডলারের দাম ৯২ টাকা থেকে ৯২ টাকা ৫০ পয়সা বিক্রি হচ্ছে। খোলা বাজারে ডলারের দাম ৯৩ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হচ্ছে।
ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণ
করোনা মহামারির সময় থেকেই আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে ডলারে বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) যেখানে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে উল্টো অর্থাৎ ঋণাত্মক প্রায় ১৯ শতাংশ।
এদিকে রেমিট্যান্সের পাশাপাশি ডলারে রফতানি আয়ের প্রবাহেও প্রভাব পড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে রফতানি আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৩৮৪ কোটি ৩৫ লাখ মার্কিন ডলার।
রফতানি ও রেমিট্যান্স মিলে মোট বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে ৪ হাজার ৭২৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। বিপরীতে আলোচ্য সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। আমদানি ব্যয়ের চেয়ে রফতানি ও রেমিট্যান্স মিলে ব্যবধান প্রায় এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
(জুলাই ২০২১-এপ্রিল ২০২২ তুলনামূলক চিত্র)
রফতানি আয় ডলার- ৩ হাজার ৩৮৪ কোটি ৩৫ লাখ, রেমিট্যান্স আয় ডলার-১ হাজার ৩৪৩ কোটি ৯৫ লাখ, মোট ডলার আসে-৪ হাজার ৭২৮ কোটি ৩০ লাখ, আমদানী ব্যয়- ৫ হাজার ৮০০ কোটি, ডলার ঘাটতি প্রায় ১০০০ কোটি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৭০ থেকে ৮০ মার্কিন ডলারে। সেই সাথে এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৭ শতাংশ, এলসি খোলা বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এছাড়া করোনার কারণে স্থগিত এলসির দেনা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে চলমান বৈদেশিক ঋণের কিস্তির পাশাপাশি করোনার সময়কার স্থগিত কিস্তি। সব মিলে বাজারে ডলারের চাহিদা বেশি।
ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকৃত কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়েছে, পণ্যের শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যয়ে। এতে একদিকে যেমন উদীয়মান মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে, সেই সাথে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামষ্টিক অর্থনীতিতে।
অপরদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক দায়-দেনা পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় তা সুদে আসলে পরিশোধ করতে হয়। এক বছর আগেও ১ ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হতো ৮৪ টাকায়, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিশোধ করতে হচ্ছে ৮৬ টাকায়। এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে সামগ্রিক ব্যয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি
দেশের মূদ্রাবাজারকে স্বাভাবিক রাখতে প্রায় প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই ২৭ থেকে এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ৪৬০ কোটি মার্কিন ডলার বিক্রি করেছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এ বিপুল পরিমাণ ডলার ছেড়েও টাকার মান ধরে রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাধ্য হয়ে বাজারে ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে।
উদ্ঘাটিত বিষয়াদি
করোনার পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ায় আমদানি বেড়েছে, যার মূল্য ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে । যেভাবে ডলারের সঙ্কট ও চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে সামনে সঙ্কট আরো বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে মূদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রনে রাখছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে, তাই রেমিট্যান্সের প্রাপ্তির হারে তেমন উন্নতি হবে না। রফতানির বিপরীতে ডলার আয়েও যুদ্ধের কু-প্রভাব পড়বে। সহজে রেমিটেন্স দেশে পাঠানো এবং ২% ক্যাশব্যাক অফার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে ।
প্রতিবেশী দেশগুলোসহ প্রতিযোগী দেশগুলোতে মুদ্রার মান যেভাবে কমেছে, সেভাবে টাকার মান কমেনি। ফলে দেশের রপ্তানিকারকরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছেন। ঈদের ছুটিতেও রফতানী চলমান রাখতে কাস্টমস খোলা রেখে সরকার ডলার উপার্জনের পথ খোলা রেখেছে, যা প্রশংসনীয়।
সুপারিশমালা
পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাময়িকভাবে বাজারের ডলারের তীব্র সংকট থাকায় অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করে, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে মুদ্রা বিনিময় হারের সুবিধা দিয়ে ডলারের দামে ভারসাম্য আনা যেতে পারে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তাল রেখে ডলারের মূল্য মান নির্ধারণ করা না হলে, ডলার চোরাচালানের ঝুকি বেড়ে যাবে। বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত ও সহজ করতে হবে।সরকার ইতিমধ্যে আমদানী পরবর্তী অর্থায়ন নীতিমালা শিথিল করেছে, যা ইতিবাচক। এর দ্রুত বাস্তবায়ন করে সুফল ব্যবসায়ীদের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে।
লেখক: সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট এট আর্মস, সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ কমিটি ।
বিবার্তা/রোমেল/এসএফ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]