শিরোনাম
বাংলাদেশে হোমিও, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০১৮, ১৬:৩৭
বাংলাদেশে  হোমিও, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার বাইরে হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক – এই তিন ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থাকে অল্টারনেটিভ মেডিসিন বা বিকল্প চিকিৎসা বলা হয়। এই চিকিৎসাব্যবস্থা কয়েক হাজার বছরের পুরনো। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে এই চিকিৎসাব্যবস্থা প্রচলিত, আর সরকার এখন এর ওপর আরো জোর দিচ্ছে।


বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মানের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সর্বশেষ যে র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উপরে রয়েছে কেবল শ্রীলঙ্কা। তাদের অবস্থান ৭৬তম। ভারত ১১২ এবং পাকিস্তান রয়েছে ১২২তম অবস্থানে। ভুটান ১২৪, মালদ্বীপ ১৪৭, নেপাল ১৫০ এবং সবথেকে পিছনে রয়েছে আফগানিস্তান, ১৭৩তম। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো বলে এই র‌্যাংকিংয়ে প্রতীয়মান হয়।


কিন্তু স্বাস্থ্যসেবায় এসডিজি-র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগের বেশি মানুষের ইউনানি, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথির ওপর আস্থা রয়েছে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৮০ ভাগ এসব পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে। আয়ুর্বেদ অ্যান্ড নেচারোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (আইয়ুনস)-এর সভাপতি ডা. সমীর কুমার সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিকল্প চিকিৎসা এবং ওষুধ বাংলাদেশ সরকারস্বীকৃত। বাংলাদেশে এই চিকিৎসাব্যবস্থার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে।''


তিনি আরো বলেন, ''অল্টারনেটিভ মেডিসিন সরাসরি প্রকৃতি থেকে নেয়া। ভেষজ চিকিৎসায় সরাসরি হার্ব থেকে ওষুধ তৈরি হয়। যেমন কাশির চিকিৎসার উপাদান পাওয়া যায় বাসক ও তুলসি গাছ থেকে। আমরা সরাসরি এটা থেকে ওষুধ বানাই। এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত চিকিৎসাব্যবস্থা। কিন্তু গত ২০০ বছরে এই চিকিৎসাব্যবস্থা পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু এটা এখন আবার এগোচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের নতুন জেনারেশন নেই। ননকমিউনিকেবল ডিজিজ, যেমন ডয়াবেটিস, প্রেসার, কিডনি রোগ – এগুলোতে অ্যালোপ্যাথির এক ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু অল্টারনেটিভে ভালো চিকিৎসা হয়।''


বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ২৫০ জনের মতো বিকল্প মেডিসিনের চিকিৎসক নিয়োগ পেয়েছেন, আরো ২৫০ জনের মতো চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন আছে। প্রতিটি জেলা হাসপতালে বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা আছে। উপজেলা হাসপাতালেও এই ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে। সারা দেশে এর গ্র্যাজেুয়েট রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দেড় হাজারেও বেশি। সরকার স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের অধীনে অল্টারনেটিভ মেডিসিনের একটি সেল করেছে, যার অধীনে একজন পরিচালক এই বিকল্প মেডিসিনের বিষয়গুলো দেখেন। ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ আছে দু'টি, হোমিওপ্যাথিক একটি। এসব কলেজে এমবিবিএস-এর সমমানের ডিগ্রি কোর্স পড়ানো হয়। ডিপ্লোমা পড়ানো হয় এরকম কলেজ আছে অনেক।


বাংলাদেশে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির ৪৫০টির মতো প্রতিষ্ঠান আছে, হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ল্যাবরেটরি আছে ১০০-র মতো। বিপরীতে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে কম-বেশি ২৩০টি।


ডা. সমীর কুমার সাহা বলেন, ‘‘এই চিকিৎসার ইতিবাচক দিক হলো এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। যেটুকু প্রতিক্রিয়া হয়, তা ধর্তব্য নয়। এই চিকিৎসার খরচও অ্যালোপ্যাথিকের চেয়ে অনেক কম। এখন শৈল্য চিকিৎসায়ও অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে।''


তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বেই এখন বিকল্প মেডিসিনের চাহিদা বাড়ছে। মানুষ এখন চায় ন্যাচারাল ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াহীন চিকিৎসা।''


তিনি জানান, ‘‘এখন পর্যন্ত ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার আলাদা কোনো সরকারি হাসপাতাল হয়নি। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে আমাদের আলাদা ইউনিট দেয়া হয়েছে।''


গত এপ্রিলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম অল্টারনেটিভ মেডিসিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদক্ষেপ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘দেশের সর্বত্র হোমিওপ্যাথি, ইউনানি বা আয়ুর্বেদিক কলেজ রয়েছে। সরকারও গুরুত্ব দিয়ে এ ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির মানোন্নয়নে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরই মধ্যে সরকারি হাসপাতালে বিকল্প চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতির মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার এরই মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে।''


বংলাদেশে বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে হোমিওপ্যাথির প্রসার রয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষ হোমিও চিকিৎসায় অভ্যস্ত।


হোমিওপ্যাথি বোর্ডের চেয়ারম্যান ডা. দিলীপ কুমার রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের হিসেবমতে দেশের ৪০ ভাগ মানুষ হোমিও চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এখন তো হোমিও পদ্ধতিতে শৈল্য চিকিৎসার ব্যবস্থাও আছে। মিরপুরে আছে দেশের একমাত্র হোমিও হাসপাতাল ও কলেজ। এছাড়া দেশের প্রত্যেক জেলায় হোমিও কলেজ আছে। দেশে হোমিও বিএইচএমএস চিকিৎসকের সংখ্যা দেড় লাখ। আর গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক আছেন দেড় হাজারের মতো। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে এমবিবিএস ডাক্তারের সমান মর্যাদায় দেড় শ' হোমিও চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।''


তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, তাতে শুধু অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা দিয়ে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। হতদরিদ্র মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে সরকার হোমিওপ্যাথিসহ বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থায় জোর দিচ্ছে।''


হোমিওপ্যাথি বোর্ডের চেয়ারম্যান জানান, ‘‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যায়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশ থেকে ছাত্ররা বিকল্প মেডিসিনে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবে। ওষুধ তৈরিতে সহায়তা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের হোমিও ওষুধ এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। হোমিও ওষুধ উৎপাদনের ৫০ থেকে ৬০টি ভালো ল্যাবরেটরি আছে এ দেশে।''


কিন্তু বাংলাদেশে বিকল্প চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগও অনেক, বিশেষ করে যৌন চিকিৎসার নামে এক শ্রেণির চিকিৎসক মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মঘা ইউনানি ও হারবাল চিকিৎসার নামে প্রচুর তথাকথিত ''চিকিৎসা কেন্দ্র'' আছে। ওসব কেন্দ্রে '‘সর্বরোগের মহৌষধ'' দেয়ার কথাও বলা হয়।


এ প্রসঙ্গে ডা. সমীর কুমার সাহা বলেন, ‘‘এগুলো প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না। অনেকেই ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে এ সব প্রতিষ্ঠান খোলে। এর বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় মাঝেমধ্যে ব্যবস্থা নেয়। তবে মনিটরিং আরো জোরদার করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মানুষকেও সচেতন করতে ও হতে হবে। জানতে হবে অল্টারনেটিভ মেডিসিন একটি স্বীকৃত চিকিৎসাব্যবস্থা। এখানো বুজরুকির কোনো সুযোগ নেই।''


আয়ুর্বেদ অ্যান্ড নেচারোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইয়ুনস)-এর সভাপতি ডা. দিলীপ কুমার রায় বলেন, ‘‘এরা হলো কোয়াক ডাক্তার। আমরা হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এরকম কিছু কোয়াককে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের নজরদারি আরো বাড়াতে হবে।''


বিকল্প এই চিকিৎসাব্যবস্থাকে আরো সমন্বিত রূপ দিতে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাপদ্ধতি আইন এবং বাংলাদেশ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি আইন নামে নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গত ১৯ এপ্রিল সচিবালয়ে দেশীয় চিকিৎসক সমিতি, বাংলাদেশ ইউনানি আয়ুর্বেদিক বোর্ড এবং বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের এক যৌথসভায় এ কথা জানান।


তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হলে ট্র্যাডিশনাল (প্রচলিত ও দেশীয়) চিকিৎসাব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য আইন দু'টি দ্রুত প্রণয়ন করা জরুরি। দরিদ্র মানুষের কাছে ট্র্যাডিশনাল চিকিৎসাপদ্ধতি এখনো প্রিয়। কম খরচে চিকিৎসা পায় বলে সাধারণ মানুষ এ সেবা নিতে পছন্দ করে। তবে এ চিকিৎসাপদ্ধতির মান বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের আরো তৎপর হতে হবে।'' সূত্র : ডয়চে ভেলে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com