জিম্মি জাহাজে অস্ত্রধারী গার্ড না রাখার ব্যাখ্যা দিল মালিকপক্ষ
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:২৭
জিম্মি জাহাজে অস্ত্রধারী গার্ড না রাখার ব্যাখ্যা দিল মালিকপক্ষ
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজে (এমভি আবদুল্লাহ) অস্ত্রধারী গার্ড না থাকার বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছে জাহাজের মালিকপক্ষ কেএসআরএম।


ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকেই জাহাজটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা। এতে জাহাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বলা হচ্ছিল জাহাজে কোনো অস্ত্রধারী গার্ড ছিল না। এতে দস্যুরা কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই জাহাজ নিয়ন্ত্রণে নেয়। তবে নানা দেনদরবার শেষে একপর্যায়ে দস্যুদের সঙ্গে সমঝোতা হয় জাহাজের মালিকপক্ষের। এরপর দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। মুক্ত হয় জাহাজ ও ২৩ বাংলাদেশি নাবিক।


বাংলাদেশ সময় শনিবার (১৩ এপ্রিল) দিবাগত রাত ৩টা ৮ মিনিটের দিকে জাহাজ থেকে নেমে যায় দস্যুরা। এরপর জাহাজ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের আল হারমিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।


নাবিকদের মুক্ত হওয়ার বিষয়টি শনিবার (১৩ এপ্রিল) রাত ৩টা ৩০ মিনিটে কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।


১৪ এপ্রিল, রবিবার চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় কেএসআরএমের করপোরেট কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।


সংবাদ সম্মেলনে জাহাজে অস্ত্রধারী গার্ড না থাকার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান।


তিনি বলেন, একটা কথা বার বার আসছে, কেন আমরা আর্মড গার্ড নেইনি। এটার কারণ হচ্ছে আমরা হাই রিস্ক অ্যারিয়ার বাইরে ছিলাম। সাধারণত ২০০ নটিক্যাল মাইলের ভেতর হাইরিস্ক অ্যারিয়া হিসেব করা হয়। কিন্তু আমরা যাচ্ছিলাম মোটামুটি ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে দিয়ে। গত ৮-৯ বছরে ওই এলাকায় এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি, যেখানে আর্মড গার্ড নিতে হয়। একারণে আমরা আর্মড গার্ড নেইনি।


জিম্মি নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে জানান শাহরিয়ার জাহান রাহাত। ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ উদ্ধারে অভিযান চালানোর পরিকল্পনাকেও নিরুৎসাহিত করা হয় বলে জানান তিনি।


শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, আমাদের কাছে নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টির গুরুত্ব ছিল। ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর পিছু নেয়ার পর সরকারকে দ্রুত বিষয়টি অবহিত করি। ৩০ মিনিটের মধ্যে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ এটির সঙ্গ ত্যাগ করে। এই জন্য প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান শাহরিয়ার জাহান রাহাত।


মাত্র ৩১ দিনের মাথায় জাহাজসহ নাবিকদের উদ্ধারের গল্প শোনান কেএসআরএমের এই উপমহাব্যবস্থাপক। শাহরিয়ার জাহান বলেন, মালিকপক্ষ বা আমরা সরাসরি জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। যারা এটি নিয়ে কাজ করেন তাদের সাহায্য নিয়েছি। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে জাহাজসহ নাবিকদের উদ্ধার করা গেছে।


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৯ এপ্রিল দুবাই পৌঁছতে পারে জাহাজটি। তারপর ২০ এপ্রিল এয়ারে করে সরাসরি চট্টগ্রামে পৌঁছার সম্ভাবনা রয়েছে নাবিকদের।


জাহাজের নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়েও উত্তর দেন শাহরিয়ার জাহান রাহাত। তিনি বলেন, আমাদের জাহাজটি নিরাপদ দূরত্বে দিয়ে যাচ্ছিল। যেখানে গত এক দশকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে, এবার থেকে আমরা আরও সতর্ক অবস্থায় জাহাজ পরিচালনা করব।


সংবাদ সম্মেলনে কেএসআরএমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করিম বলেন, ১৩ বছর আগে আমাদের আরেকটি জাহাজ জাহানমনি জিম্মি হয়েছিল। তখন আমাদের জ্ঞানের অভাব ছিল। সে জন্য জাহাজটি উদ্ধারে সময় বেশি লেগেছিল। এমভি আব্দুল্লাহ জিম্মি হওয়ার পর, দ্রুত উদ্ধারে প্রপার ওয়েতে কাজ করেছি। জাহাজটি জিম্মি হওয়ার পর থেকে জাহাজের ভিসেটের মাধ্যমে জাহাজটির সব তথ্য তদারকি করেছি।


সোমালিয়ার উপকূলে জাহাজটি যাওয়ার পরপরই জলদস্যুদের একজন কমান্ডার যোগাযোগ করেছেন উল্লেখ করে মেহেরুল করিম বলেন, একজন কমান্ডার যিনি ইংরেজি বলতে পারেন, তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর থেকে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাহাজের নাবিকেরা সুস্থ আছেন কি-না তা নিশ্চিত করা। আমরা যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল শিপিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তাই প্রতিটি রুল আমাদের মেনে চলতে হয়। এমভি আব্দুল্লাহর বেলায়ও বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রতিদিন জুমে কথা বলে আপডেটগুলো জানাতে হতো।


প্রতিদিন নাবিকেরা কেমন আছে, তার একটি ভিডিও নিতেন জানিয়ে মেহেরুল করিম বলেন, আমরা জানতাম নাবিকেরা প্রতিদিন পরিবারের সঙ্গে কথা বলত। তারপরও আমরা নাবিকেরা কেমন আছে, সেটির ভিডিও নিতাম জলদস্যুদের কাছ থেকে। সর্বশেষ গত দুই দিন আগে আমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়। তারপর সবকিছু আইন মোতাবেক করে, জিম্মিদের ছাড়াতে সক্ষম হই।


জিম্মিরা মুক্ত কথাটি শোনার পর নাবিকেরা অনেকে কেঁদে দেন। মেহেরুল করিম বলেন, জাহাজটির ক্যাপ্টেনের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় আমাদের। যখন বলি, আপনারা এখন মুক্ত। আজকেই রওনা দেবেন। তখন নাবিকেরা অনেকে খুঁশিতে কেঁদে দেন। তারপর রাত ৩টায় ৬৫ জন জলদস্যু জাহাজটি ছেড়ে যান।


জানা গেছে, জলদস্যুদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ নিয়ে একটি উড়োজাহাজ বাংলাদেশ সময় শনিবার বিকেলে জিম্মি জাহাজের ওপর চক্কর দেয়। এ সময় জাহাজের ওপরে ২৩ নাবিক অক্ষত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এরপর বিমান থেকে ডলারভর্তি ৩টি ব্যাগ সাগরে ফেলা হয়। স্পিডবোট দিয়ে এসব ব্যাগ জলদস্যুরা কুড়িয়ে নেয়। জাহাজে উঠে দাবি অনুয়ায়ী মুক্তিপণ গুনে নেয় জলদস্যুরা।


এদিকে, জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আমরা তাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করেছি, দীর্ঘদিন কথাবার্তা চলেছে। এখানে মুক্তিপণের কোনো বিষয় নেই। আমাদের আলাপ-আলোচনা এবং বিভিন্ন ধরনের চাপ আছে এখানে। সেই চাপগুলো এখানে কাজে দিয়েছে।


প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ দুপুরে কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়। আটকের পর জাহাজটিকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫৮ হাজার টন কয়লা নিয়ে ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে এমভি আবদুল্লাহ। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com