৬ মাসেও চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির চূড়ান্ত সুপারিশ হয়নি!
প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১২
৬ মাসেও চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির চূড়ান্ত সুপারিশ হয়নি!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) চলতি বছরের ১২ মার্চ রাতে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফল প্রকাশ করেছে। এতে প্রাথমিকভাবে ৩২ হাজার ৪৩৮ জন প্রার্থীকে নির্বাচন করা হয়েছে। তবে তার মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার প্রার্থী ভি-রোল ফরম পূরণ করে অনলাইনে জমা দিয়েছেন। আর তাদের-ই চূড়ান্ত সুপারিশ করার কথা এনটিআরসিএ'র।



কিন্তু এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৬ মাস! এই দীর্ঘ সময়েও প্রাথমিকভাবে নির্বাচিতদের চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রাথমিকভাবে সুপারিশকৃত শিক্ষকরা বলছেন, চূড়ান্ত সুপারিশের দাবিতে তারা দফায় দফায় এনটিআরসিএ কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু সেখানে তারা আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাননি। এদিকে এই বিষয়ে এনটিআরসিএ বলছে, মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বিষয়টিতে দেরি হচ্ছে। তবে শিক্ষকদের চূড়ান্ত সুপারিশকরণে তাদের কাজ চলমান রয়েছে।



জানা যায়, ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর ৬৮ হাজার ৩৯০ জন শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ৩১ হাজার ৫০৮ জন এবং মাদরাসা, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি স্কুল-কলেজে ৩৬ হাজার ৮৮২ জন নিয়োগ দেয়ার কথা জানানো হয়। এরপর এই গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক হতে মোট ১ লাখের বেশি চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেন। যার মধ্যে ৩২ হাজার ৪৩৮ জন প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেছে এনটিআরসিএ।

তবে তাদের প্রকাশিত এই ফলাফল নিয়ে উঠেছিল অভিযোগও। কারো মেরিট পজিশন ভালো অবস্থানে থেকেও বাদ পড়া, আবার মেরিটে পিছিয়ে থাকা অনেকের সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া, কারো কারো রোল ইনডেক্সধারীদের রোলের সাথে মিল থাকায় ব্লক হয়ে বাদ পড়া, আবার কেউ কেউ ৩৫ বছর ঊর্ধ্ব হয়ে গেলেও সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়াসহ নানা অভিযোগ এনেছিল চাকরি প্রত্যাশীরা। পরে এসব অভিযোগ তারা এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও জমা দিয়েছে। এই বিষয়ে এনটিআরসিএ বলেছিল, ভুল হয়ে থাকলে সেটি অবশ্যই চূড়ান্ত সুপারিশের আগে সংশোধন করে দেয়া হবে।


তথ্য বিশ্লেষণে আরও জানা যায়, চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফল প্রকাশের প্রায় দেড় মাস পর অর্থাৎ গত ২৭ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে সুপারিশকৃতদের চূড়ান্ত সুপারিশের জন্য প্রথমবারের মতো অনলাইনে ভি-রোল ফরম পূরণের নির্দেশ দেয় এনটিআরসিএ। এরপর আরও দুই দফায় ফরম পূরণের সময় বাড়িয়ে ২৬ জুন করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ৬ থেকে ১১তম নিবন্ধনধারী প্রাথমিক সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীদের সরাসরি এনটিআরসিএ অফিসে সার্টিফিকেটের হার্ডকপি জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে নির্ধারিত সময়ে প্রায় ২৮ হাজার প্রার্থী ভি-রোল ফরম পূরণ করে অনলাইনে জমা দিয়েছেন। আর তাদেরই চূড়ান্ত সুপারিশ হওয়ার কথা। কিন্তু নানা কারণে প্রায় ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রাথমিকভাবে নির্বাচিতদের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়নি। এ নিয়ে দফায় দফায় স্মারকলিপি প্রদানসহ মানববন্ধনও করেছে চূড়ান্ত সুপারিশের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষকরা। এরপর নড়েচড়ে বসে এনটিআরসিএ। পুলিশ ভেরিফিকেশন চলমান রেখে প্রার্থীদের চূড়ান্ত সুপারিশ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর টেবিলে এই ফাইল উঠলেও সুপারিশবঞ্চিত এক প্রার্থী রিটের কারণে আটকে যায় প্রক্রিয়া।


জানা যায়, প্রাথমিক সুপারিশের পর একজন রিট করলেও তার বিষয়টি সমাধান করে এনটিআরসিএ। কিন্তু এবার কিশোরগঞ্জের সাবেকুন নাহার নামে এক নিবন্ধনধারীর রিটে আটকে গেছে সবার সুপারিশ। ওই প্রার্থীর মার্কস ছিল ৬৩। কিন্তু তার আবেদনকৃত পদে ৬১ পাওয়া একজনকে সুপারিশ করা হয়েছিল। যে কারণে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। পরে চূড়ান্ত সুপারিশের ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেয়া হয়েছে।


এদিকে একেকবার একেক ইস্যুর কারণে চূড়ান্ত সুপারিশ আটকে যাওয়ায় প্রতিবাদ জানিয়ে সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর এনটিআরসিএর কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনও করেছেন প্রার্থীরা। চূড়ান্ত সুপারিশের দাবিতে ২৮ হাজার শিক্ষকের প্রতিনিধিরা শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবকে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দাবি আদায়ে তারা আল্টিমেটামও দিয়েছেন।


এ বিষয়ে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশপ্রাপ্তদের চূড়ান্ত সুপারিশের দাবিতে আন্দোলন করা সংগঠন "চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশী ফোরাম" এর নেতৃত্বে থাকা মো. ইমরান খান বিবার্তাকে বলেন, ‘আমরা আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করেছি। এর মধ্যে আমাদের চূড়ান্ত সুপারিশ করা না হলে, আগামী ২০ সেপ্টেম্বর থেকে থেকে এনটিআরসিএর কার্যালয়ের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে।


চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির চূড়ান্ত সুপারিশে গড়িমসির কথা জানিয়ে প্রাথমিকভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক আশিকুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, এই গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষক হয়েছি- এটা পরিবার, সমাজ, আত্মীয়স্বজনসহ সবাই জেনেছে। কিন্তু এখনো আমি চূড়ান্ত সুপারিশের মাধ্যমে জয়েন করতে না পারায়, আমাকে নিয়ে সবার-ই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর এটা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কেননা, সবাই তো আমাকে কর্মক্ষেত্রে দেখতে চাই। এদিকে চাকরির বয়সও শেষ। তাই শেষ ভরসা ছিল এই চাকরি। কিন্ত এখানেও যে, এতো গড়িমসি সেটা দেখে খুবই খারাপ লাগছে।


এই চাকরিপ্রার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আসলে সত্যি বলতে আমাদের বেকারদের নিয়ে ভাবার যেন কেউ নেই? নির্ধারিত দায়িত্ব দেওয়া থাকলেও সবাই যেন নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত। একজন বেকারের একটা চাকরির সাথে তার পরিবারসহ কত কিছু জড়িত, সেটা ভাবকে কে?


চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে প্রাথমিকভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক আরাফাতুল ইসলাম আরাফাত বিবার্তাকে বলেন, কতটা ত্যাগ -তিতিক্ষা আর কষ্টের পর এই যুগে এখন একটা চাকরি মেলে, সেটা কেবল এই পথে যারা হেঁটেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু এরপরেও কেউ যদি চাকরি পেয়ে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়, সেটা কি মেনে নেওয়া যায় ? এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক সংকটের শেষ নেই। যার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই বিষয়টা কার না জানা? কিন্তু এরপরেও আমাদের প্রাথমিকভাবে সুপারিশের পর ৬ মাসের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও চূড়ান্ত সুপারিশের খবর নেই!


ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, চাকরি পেয়েও চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রাথমিকভাবে সুপারিশকৃতরা হতাশায় দিনাতিপাত করছে। এর দায়ভার কার? আমরা চাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অবিলম্বে চূড়ান্ত সুপারিশ করা হোক। তাহলে তা শিক্ষাব্যবস্থাসহ সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে।


চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রাথমিকভাবে সুপারিশকৃতদের অভিযোগের বিষয়ে এনটিআরসিএ বলছে, একদিকে প্রার্থীদের অনলাইন ভেরেফিকেশন ফরমে ভুল তথ্য থাকা, অন্যদিকে অনেকে তথ্য পূরণ না করার কারণে এই কাজে দেরি হয়েছিল। তবে তারা দ্রুততার সাথে কাজটি করার চেষ্টা করেছেন। পরে আবার রিট হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সুপারিশের ওপর দেওয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে যাওয়া হবে। তারা আশা করছেন, সেখানে হাইকোর্টের আদেশটি স্থগিত হবে।


চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে চূড়ান্ত সুপারিশে দেরি হওয়ার বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ এর (এনটিআরসিএ) সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, আমরা শতভাগ রেডি প্রার্থীদের চূড়ান্ত সুপারিশ করার জন্য। কিন্তু এক প্রার্থী রিট করায় উক্ত রিটে নিয়োগের ওপর ছয় মাসের স্টে এসেছে। আমরা ওই রিটের জবাব রেডি করেছি। আশা করছি একটি হেয়ারিং হলেই প্রবলেমটা সমাধান হয়ে যাবে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।


গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফল নিয়ে অসঙ্গতির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফল নিয়ে যাদের অসঙ্গতির অভিযোগ রয়েছে, তাদের অভিযোগপত্র দিতে আমরা বারবার বলেছিলাম। আমরা ভেরিফাই করে দেখবো। কোন সমস্যা থাকলে আমরা অবশ্যই দেখবো। দুই একটা ভুল হতে পারে। কিন্তু অসঙ্গতি বলতে মানুষ যেটা বোঝাচ্ছে, সেটা আসলেই না। আমরা তো মিলিয়ে দেখেছি।কাজেই যাদের অভিযোগ রয়েছে, তারা আবেদন দিলে আমরা ফাইনাল সুপারিশের আগে সব ঠিক করে দেবো।


সার্বিক বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান মো. এনামুল কাদের খান বিবার্তাকে বলেন, মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে শিক্ষকদের চূড়ান্ত সুপারিশ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটরের মতামত চাওয়া হয়েছে। তারা দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ করার চেষ্টা করছেন। আমরা আশা করছি খুব শীঘ্রই চূড়ান্ত ফল দিতে পারবো। আর সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে।


বিবার্তা/ রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com