শিরোনাম
সেই জজ মিয়া কোথায়, কেমন কাটছে দিন?
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০১৯, ০৯:০৮
সেই জজ মিয়া কোথায়, কেমন কাটছে দিন?
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বোকারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামের মৃত আবদুর রশিদের ছেলে জজ মিয়া। জন্ম ঢাকার তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায়।


বাবার ভাঙাড়ি ব্যবসার সুবাদে পরিবারের সঙ্গে প্রথমে তিব্বত বস্তি; পরে নাখালপাড়া নূরানী মসজিদের পাশে থাকতেন। বাবার মৃত্যুর পর পঞ্চম শ্রেণি পাস জজ মিয়ার পড়াশোনা আর হয়নি। কিছুদিন বড় ভাই আলমগীরসহ বাবার ভাঙাড়ি ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন। পরে রাজধানীর গুলিস্তানে হকারের কাজ করতেন।


২০০৪ সালে ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান এই জজ মিয়াকে দিয়েই সাজানো হয় মিথ্যা মামলা।


এতবড় ঘটনাটি নোয়াখালীর একজন সাধারণ মানুষ কী করে বাস্তবায়ন করলেন, সেই সূত্র না মেলায় গোয়েন্দা সংস্থার সাজানো এ চিত্রনাট্যটি গণমাধ্যমসহ সব মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।


হামলার শিকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলীয় রাজনৈতিক নেতারাও সাফ জানিয়ে দেন ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছেন জজ মিয়া। অবশেষে অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি পান জজ মিয়া, এখন এ মামলার অন্যতম সাক্ষীও তিনি।


হামলার পর জজ মিয়া নাকজ সাজিয়ে তাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় মিথ্যা স্বীকারোক্তি। এর আগে জজ মিয়াকে বিদেশে ভালো চাকরির প্রলোভন দেয়া হয়। কিছুদিন জজ মিয়ার পরিবারকে সিআইডি প্রতি মাসে দুই হাজার করে টাকাও দেয়। এক সময় সেই টাকাও বন্ধ হয়ে যায়।


মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় তার পরিবার। পাঁচ বছর কারাভোগের পর ২০০৯ সালে জজ মিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পান। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু সেই আশ্বাস পড়ে আছে খাতা-কলমেই। আজও অবসান হয়নি জজ মিয়ার নিদারুণ কষ্টের জীবন। গাড়ি চালিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন তিনি।


পুলিশি নির্যাতনের স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে তাকে।


জজ মিয়া বলেন, ‘আমি তো সবই হারাইছি। আমার কিছুই নেই। গ্রামের বাড়িতে বাপ-দাদার একটু ভিটা ছিল। তা-ও ২১ আগস্টের মামলা চালাতে গিয়ে শেষ। ওই ঘটনায় যারা আহত হয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তো তাদের কমবেশি সাহায্য করছেন। কিন্তু আমার কিছুই হলো না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাই, আমাকে একটু পুনর্বসাসন করেন।’


তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাকে জেল থেকে বের করে। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। কয়েক বছর আগে আসাদুজ্জামান নূর স্যারের (সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী) মাধ্যমে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন। আমি নিজ এলাকার এমপির কাছ থেকে একটা ডিও লেটার এনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে জমাও দিয়েছি। এরপর আর কিছু জানি না। কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আশায় আছি যে কোনো দিন হয়তো আমাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ডাকা হবে।’


জজ মিয়া বলেন, ‘দেড় বছর আগে বিয়ে করেছি। আল্লাহ আমারে একটা কন্যাসন্তান দিছে। আমার মেয়েটার জন্য তো আমার কিছু রেখে যেতে হবে।’


এক প্রশ্নের জবাবে জজ মিয়া বলেন, ‘আমি দোষী না হয়েও প্রায় পাঁচ বছর জেল খেটেছি। আর সিআইডিতে রিমান্ডে থাকাবস্থায় যে নির্যাতন করা হয়েছে, তার ব্যথা এখনো টের পাই। মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য আমারে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। কারা নির্যাতন করেছে আমি চোখে দেখতে পারিনি। তবে আমাকে গ্রেফতারের পর পুলিশ কর্মকর্তা রুহুল আমিন, মুন্সি আতিক, আব্দুর রশীদ জিজ্ঞাসাবাদ করে।


তারা মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়। আমি তাদের যতই বলি জীবনে আমি গ্রেনেড চোখে দেখিনি, নামও শুনিনি, তারা সব কিছু জেনেশুনেও আমারে বিশ্বাস করতে চায়নি। তারা আমারে সাদা কাগজে মিথ্যা সাজানো স্বীকারোক্তি লিখে মুখস্থ করায়। পরে আদালতে আমি সেই কথা বলি। তারা তিনজন মিলে আমারে ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়।’


‘যারা ঘটনা ভিন্ন খাতে নিছে, প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করেছে, তাদের শাস্তি চাই। সরকার যেন মামলার রায় কার্যকর করে অপরাধীদের শাস্তি দেয়, এটাই আমার চাওয়া। আমি সব সময় বিএনপি-জামায়াতকে ভয় পাই। এই বুঝি আমার ওপর তারা হামলা করে। ভয়ে আমি কোনো ফেসবুক আইডিও খুলিনি।’


কোথায় সেই জজ মিয়া, কী করছেনএখন


স্বজনরা জানান, বিনা দোষে টানা চার বছর জেলের ঘানি টানতে গিয়ে প্রচুর দেনা হয়ে যায় তার। অভাব অনটনের সংসারে যারা সহযোগিতা করেছিলেন, তারা প্রদেয় অর্থ ফেরত চাইলে ২০০৯ সালে নিজের সাড়ে ৭ শতাংশ পৈতৃক জমি দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইদের কাছে ১ লাখ ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি করে নোয়াখালী ছাড়েন জজ মিয়া।


নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মৌচাক এলাকার একটি টিনশেড বাড়িতে দুই রুম নিয়ে বৃদ্ধা মা, ছোট বোন ও ছোট ভাইকে নিয়ে জালাল উদ্দীন ড্রাইভার ওরফে জজ মিয়া বসবাস করছেন। যদিও মাস ৩ আগে তিনি বসবাস করতেন রাজধানীর কদমতলী থানার রায়েরবাগ এলাকায়।


কিন্তু সেই এলাকার মানুষ তাকে ‘জজ মিয়া’ হিসেবে চিনে ফেলায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। ফলে তিনি বাসা পরিবর্তন করে বর্তমান ঠিকানায় চলে এসেছেন।


জজ মিয়া ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমি জজ মিয়া নই। আমি জালাল উদ্দীন। ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেন, দেখুন আমার ভোটার আইডি কার্ডে জালাল উদ্দীন নাম।’


বিবার্তা/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com