ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন মাসুদ পেজেশকিয়ান
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৪, ২১:৩৩
ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন মাসুদ পেজেশকিয়ান
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ইরানের নবম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেছেন ড. মাসুদ পেজেশকিয়ান। গত ৫ জুলাই রানঅফ নির্বাচনে সাঈদ জালিলিকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।


৩০ জুলাই, মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় ইরানের জাতীয় সংসদ ভবনের প্রধান হলে এ শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বিচার বিভাগীয় প্রধান গোলাম হোসেইন মোহসেনি এজেয়ি।


আনুষ্ঠানিক শপথে তিনি বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে, পবিত্র কোরআন ও ইরানের মানুষকে সামনে রেখে মহাশক্তিশালী আল্লাহর কাছে শপথ করছি আমি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ও এই দেশের সংবিধানের অভিভাবক হলাম।”


পেজেশকিয়ান বলেন, আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য আমার সমস্ত সক্ষমতা এবং যোগ্যতা উৎসর্গ করবো এবং আমি জনগণের সেবা ও জাতিকে উন্নত করতে ধর্ম ও নৈতিকতার প্রচার, ন্যায়পরায়ণতার প্রতি সমর্থন এবং ন্যায়বিচারের প্রসারে নিজেকে নিবেদিত করবো।


তার শপথে ৮০টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বিদেশি প্রতিনিধি দলগুলোতে রয়েছেন বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের সদস্য, রাষ্ট্রদূত এবং ৬০০ দেশি-বিদেশি সাংবাদিক।


এসময় তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, উজবেকিস্তানের সংসদ স্পিকার, মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কঙ্গোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপপ্রধান এনরিক মোরা, জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, দক্ষিণ আফ্রিকার উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দক্ষিণ কোরিয়ার উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সাংহাই সহযোগিতা পরিষদের মহাসচিব এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন।


দুদিন আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি আনুষ্ঠানিকভাবে মাসুদ পেজেশকিয়ানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমোদন দিয়েছেন।


এর আগে গেলো মে মাসে আজারবাইজানের সীমান্তের কাছে দুটি বাঁধ উদ্বোধন করেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এরপর হেলিকপ্টারে চড়ে ইরানের উত্তর-পশ্চিমের তাবরিজ শহরের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি ও তার সহযাত্রীরা। পথিমধ্যে পাহাড়ি এলাকায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি।


পরে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পাহাড়ি ও তুষারাবৃত এলাকায় ইরানি প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় অনুসন্ধানী দল।


দুর্ঘটনায় নিহত হন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালেক রহমাতি, পূর্ব আজারবাইজানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী আলে-হাশেম, প্রেসিডেন্ট গার্ডের প্রধান মেহেদি মুসাভি। প্রাণ হারিয়েছেন হেলিকপ্টারের পাইলট, কো-পাইলটও।


প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই রাইসির মৃত্যু হয়।


কে এই মাসুজদ পেজেশকিয়ান


সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত মাসুদ পেজেশকিয়ান পেশায় এক সময় চিকিৎসক ছিলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন।


৬৯ বছর বয়সী হার্ট বিশেষজ্ঞ মাসুদ পেজেশকিয়ান জানিয়েছেন, তিনি বাস্তবধর্মী একটি পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করবেন। এছাড়া পশ্চিমাদের সঙ্গে ২০১৫ সালে করা পারমাণবিক চুক্তিটিও পুনর্জীবিত করার অঙ্গিকারও করেছেন তিনি। ‘অখ্যাত’ এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ আরও বলেছেন, তিনি সামাজিক স্বাধীনতার পক্ষে এবং রাজনৈতিক একত্ববাদের বিরুদ্ধে কাজ করবেন।


ইরানে রয়েছে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা। ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে রয়েছেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা। পারমাণবিক কার্যক্রম ও মধ্যপ্রাচ্যে সশস্ত্র যোদ্ধাদের সহায়তা নিয়ে ইরানের যে নীতি রয়েছে সেটি বদলে ফেলার খুব বেশি ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নেই। কারণ প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি রাষ্ট্রের সব বিষয় নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।


তবে প্রেসিডেন্ট চাইলে নীতি পরিবর্তনে প্রভাব রাখতে পারবেন। এছাড়া আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উত্তরাধিকারী নির্বাচনের বিষয়টিও খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করবেন তিনি।


আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রতি অনুগত থাকবেন মাসুদ?


১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আজারবাইজান প্রদেশের মাহাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন মাসুদ পেজেশকিয়ান।


স্কুলের পাঠ এবং প্রথম ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জাবুল শহরে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। তবে সামরিক বাহিনীতে বেশিদিন স্থায়ী হননি মাসুদ। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে দ্বিতীয় ডিপ্লোমা করবেন।


১৯৭৬ সালে তিনি তাবরিজ মেডিকেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি ডিগ্রি এবং জেনারেল সার্জারির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করেন।


১৯৯৩ সালে ইরান ইউনিভার্সিটি অফ মেডিকেল সায়েন্সেস থেকে কার্ডিয়াক সার্জারিতে একটি উপ-স্পেশালিটি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে হার্ট সার্জারিতে বিশেষজ্ঞ হন মাসুদ পেজেশকিয়ান। এরপর তিনি পাঁচ বছর তাবরিজ ইউনিভার্সিটি অফ মেডিকেল সায়েন্সের প্রধানও ছিলেন।
পেজেশকিয়ানের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনে উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি যোগদান করেন।


এরপর ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রায় চার বছর খাতামি প্রশাসনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পেজেশকিয়ান।


ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় তাবরিজ অঞ্চল থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। তবে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন ২০০৮ সালে।


দেশটির দশম জাতীয় সংসদে তিনি উপ-স্পীকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং চলতি বছরের প্রথম দিকে যে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে আবারও তাবরিজের প্রতিনিধি হিসেবে বিজয়ী হন।


মাসুদ পেজেশকিয়ান এর আগেও দুইবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।


এরমধ্যে ২০১৩ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান। আর সবশেষ ২০২১ সালে, নির্বাচন করার জন্য তিনি নাম রেজিস্ট্রার্ড করলেও তখন ইরানের অভিভাবক পরিষদ তাকে অনুমোদন দেয়নি।


গেলো মে মাসে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মাসুদ পেজেশকিয়ান আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে শামিল হন।


নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান টিভি ও সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে একাধিকবার বলেছেন, তিনি খামেনির নীতিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না। এছাড়া ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দেয়ার কোনো ইচ্ছাও তার নেই।


মাসুদ ভোটারদের এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, নির্বাচনের আগে তিনি যেসব প্রতিশ্রতি দিয়েছেন; যদি সেগুলো পূরণ না করতে পারেন তাহলে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। শুধু শুধু সময় নষ্ট করবেন না।


মাসুদ পেজেশকিয়ানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন সাবেক সংস্কারবাদী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতেমি।


হিজাব নিয়ে অবস্থান


চলতি বছরের মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। তার আকস্মিক মৃত্যু হওয়ার পর দেশটিতে আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এতে জয় পেয়েছেন মাসুদ।


ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন কট্টরপন্থি রাজনীতিবিদ। তার সময়ে হিজাব আইন আরও কঠিন করা হয়। এছাড়া যারা হিজাব ছাড়া বাইরে বের হতেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতা দেখানো হতো।


মাসুদ পেজেশকিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম ধাপে ভোট দিয়ে বলেছিলেন, আমরা হিজাব আইনকে শ্রদ্ধা জানাব। কিন্তু নারীদের প্রতি কখনো বাড়াবাড়ি এবং অমানবিক আচরণ করা হবে না।


২০২২ সালে নৈতিকতা পুলিশের হাতে যখন মাহসা আমিনি নিহত হন তখন তার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানানোর দাবি জানিয়েছিলেন তিনি।


ব্যক্তিগত জীবন


১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধে চিকিৎসক ও যোদ্ধা হিসেবে সম্মুখভাগে কাজ করেছেন মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন।


১৯৯৪ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিজের স্ত্রী এবং এক সন্তানকে হারান তিনি। ওই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া দুই ছেলে ও মেয়েকে তিনি একাই বড় করেছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আর বিয়ে করেননি।


সূত্র: এএফপি, রয়টার্স


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com