‘হেফাজতের আপত্তির মুখে’ লালন মেলা বন্ধ
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:২৭
‘হেফাজতের আপত্তির মুখে’ লালন মেলা বন্ধ
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

হেফাজতে ইসলাম ও স্থানীয় মুসল্লিদের আপত্তির মুখে বন্ধ হয়ে গেছে 'মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা' নামের একটি অনুষ্ঠান। শুক্রবার ও শনিবার (২২ ও ২৩ নভেস্বর) অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের অনুমতি না থাকায় এই মেলা বন্ধ হয়ে যায়।


ফলে মেলায় অংশ নিতে কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা লালন ভক্তদের ফিরে যেতে হয়েছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় দশ বছর ধরে নিয়মিত এই মেলা ও অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে আসছে।


মেলার আয়োজক ফকির শাহজালাল বলেন, হেফাজত ও এলাকার মুসল্লি কারণে এমন একটা সাধারণ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু বন্ধই না, এ নিয়ে আমিও আছি হুমকির মধ্যে।


অনুষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের ভাষ্য, লালন মেলার নামে সেখানে “অপসংস্কৃতির” চর্চা হতো বলেই এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের অনুরোধে জেলা প্রশাসক অনুষ্ঠানটি বন্ধ করেছে।


এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও নারায়ণগঞ্জের নেতা আব্দুল আউয়াল বলেন, ওইখানে মেলার নাম করে মেয়েগুলোকে তারা এমনভাবে নাচায়, যেটা মেনে নেওয়া না।


তবে মেলা বন্ধ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মীরা। তারা বিষয়টিকে জেলা প্রশাসনের ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।


এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, এই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এটি যদি বন্ধ করা না হতো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যেত।


উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সনমান্দি ইউনিয়নে আয়নাল শাহ দরগা নামে পুরোনো একটি মাজারও ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মদনপুর এলাকায় অবস্থিত দেওয়ানবাগ মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।


নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার কাশিপুরের মধ্য নরসিংহপুর গ্রামে এক দশক ধরে নিয়মিত এই ‘মহতী সাধু সঙ্গ ও লালন মেলা’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে ‘মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’র ব্যানারে।


এ বছরের ২২ ও ২৩ নভেম্বর অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার প্রতি বছরের মতো মেলার আয়োজনের আগে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে অনুমতি চাওয়া হয়।


এই অনুষ্ঠানের সপ্তাহ খানেক আগে গত ১৫ই নভেম্বর হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় কিছু নেতাকর্মী ও কিছু মুসল্লি এই মেলাকে ধর্ম বিদ্বেষী অনুষ্ঠান আখ্যা দিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধের হুমকি দিয়ে ওই এলাকায় মিছিল করে।


কাশিপুরের মুক্তিধাম আশ্রমের অদূরে জড়ো হয়ে সেখানে বক্তব্য দেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল আউয়ালও।


সেখান থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতারা ঘোষণা দেন, তাদের আপত্তির পরও যদি সেখানে মেলা আয়োজন করা হয় তাহলে তা যে কোন মূল্যে প্রতিহত করবেন তারা।


পরে অবশ্য নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মীরা এর প্রতিবাদে পাল্টা কর্মসূচি পালন করে নারায়ণগঞ্জ শহরে।


নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সিনিয়র সহসভাপতি রাফিউর রাব্বী বলেন, আমরা জেলা প্রশাসককে বলেছিলাম দীর্ঘদিনের এই মেলার আয়োজন বন্ধ হলে একটা খারাপ উদাহরণ তৈরি হবে। জেলা প্রশাসনও প্রথমে আমাদের সাথে একমত ছিল।


সাংস্কৃতিক কর্মীদের এই কর্মসূচির মধ্যেই ওই নরসিংহপুর এলাকার মসজিদগুলোতে মাইকে মেলা বিরোধী প্রচারণা চালানো হয় বলে জানায় আয়োজন শাহজালাল ফকির।


এরপরই জেলা প্রশাসন এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে বৈঠিকে বসে। এরপর মেলার অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।


জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, আমরা কোন অনুষ্ঠান করার আগে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়েই অনুমতি দেই। এই মেলাকে ঘিরে ওই এলাকায় অনেকগুলো মসজিদের মুসল্লি ও হেফাজতে ইসলাম মিছিল মিটিং শুরু করে। এই কারণে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেয় নাই বলেই আমরা অনুমতি দিতে পারি নাই”।


“আমাদের কাছে মনে হয়েছে ওনারা যদি এরপরও মেলাটা করে তাহলে হয়তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটতে পারে। এ কারণেই আসলে বন্ধ করতে হয়েছে ওই মেলা” বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মি. হক।


অন্যান্য বছরের মতো এবারও মেলা আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল মুক্তিধাম আশ্রম কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে প্যান্ডেল তৈরিসহ নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়।


আয়োজক ফকির শাহজালাল জানান, এক মাস আগে চিঠি দেয়ার পর তিনি প্যান্ডেল তৈরির কাজও এগিয়ে নিয়েছিলেন।


তিনি জানান, “বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে লালনভক্তদের অনেকেই বৃহস্পতিবার রাতেই আসেন নরসিংহপুরের মেলা প্রাঙ্গনে। কিন্তু প্রশাসনের অনুমতি না মেলার অযুহাতে প্যান্ডেল খুলে ফেলতে বাধ্য করা হয়”।


হেফাজতে ইসলামের নেতা আব্দুল আউয়ালের অভিযোগ, মেলাকে কেন্দ্র করে এই জায়গায় মাদক ও অপসংস্কৃতির চর্চার কারণে স্থানীয় মুসল্লিদের দাবির প্রেক্ষিতে তারা মেলা আয়োজনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।


আব্দুল আউয়াল বলেন, “মেলার নামে তারা এখানে গান-বাদ্য ও মেয়েদের দিয়ে নাচানাচি করে। মদ হিরোইন নিয়ে গান বাদ্য বাজিয়ে মানুষকে ডিস্টার্ব করে”।


যে কারণে তারা বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে জেলা প্রশাসককে মেলা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেছেন, বলছিলেন মি. আউয়াল।


যদিও এই অভিযোগের বিষয় আয়োজক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো- স্থানীয় মুসল্লিদের নিয়ে হেফাজত ইসলাম অপপ্রচার চালিয়ে দীর্ঘদিনের এই অনুষ্ঠান বন্ধ করেছে।


ফকির শাহজালাল বলেন, মসজিদে মাইকিং করা হয়েছে লালন নাস্তিক। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এখানে অনুষ্ঠান হয়। কখনো কোন ধরনের মাদক বা অশ্লীলতার ঘটনা ঘটেনি। হঠাৎ এই ধরনের অভিযোগ এনে এটাকে বন্ধ করা হয়েছে। প্রতিবছর এই মেলায় অংশগ্রহণ করতে আসনে লালন ভক্ত ও বাউল শিল্পীরা। গত দশ বছর তো কেউ এমন অভিযোগ নিয়ে আসেনি। এবার কেন এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে?


দীর্ঘ দিনের এই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মীরা।


নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক ফারহানা মানিক বলেন, যদি মেলায় মাদক ও অনৈতিক কোন কাজ হয়ে থাকে তাহলে প্রশাসনের উচিত ছিল সেদিকে নজর দেয়া। কিন্তু সেটি না করে মেলাই বন্ধ করে দেয়া হলো। এটা তো কোন সমাধান না”।


আয়োজক কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের অনুষ্ঠানে অনুমতি না দিয়ে প্রশাসন হেফাজতে ইসলামের কাছে নতি স্বীকার করেছে।


আয়োজক ফকির শাহজালাল বলেন, শুধু অনুষ্ঠান বন্ধ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। এখন আমাকে নাস্তিক বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে।


তিনি জানান, সেখানে কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে যারা এসেছিলো তাদেরকে পুলিশ এসে চলে যেতে বাধ্য করেছে।


সাংস্কৃতিক কর্মী রাফিউর রাব্বী বলেন, বর্তমানে এই ধরনের কর্মকাণ্ড খুব সুদুর প্রসারী খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটিই আমাদের কাছে উদ্বেগের বিষয়।


নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসন বলছে একটা পক্ষ এর বিরুদ্ধে এমন অবস্থা তৈরি করেছে যে কারণে তারাও এটি নিয়ে কিছুটা শঙ্কায় রয়েছে।


জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক বলেন, এখানে পাঁচশোর ওপরে মাদ্রাসা আছে। প্রতিনিয়ত হুমকি দেয়া হচ্ছিল। যদি তারা শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান করত এখানে রক্তপাতের শঙ্কা ছিল। এই হামলায় যদি রক্তপাতের ঘটনা ঘটতো এই মুহুর্তে সেটি সামাল দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে যেতো। সে কারণে এ বছরের জন্য আয়োজন বন্ধ করা হয়েছে। মিনিমাম ক্ষতিতে কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়, আমরা সেই চেষ্টাই করেছি।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com