পিডিবি'র কাছে গ্রাহকের অভিযোগ
কর্ণফুলীতে বিনামূল্যের প্রিপেইড মিটার লাগিয়ে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য!
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৪, ২০:২৩
কর্ণফুলীতে বিনামূল্যের প্রিপেইড মিটার লাগিয়ে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য!
জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় গ্রাহকদের জন্য দেওয়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর বিনামূল্যের প্রিপেইড মিটার বিক্রি হচ্ছে ৮-১০ হাজার টাকায়। এমনকি এসব ফ্রি মিটার লাগাতেও হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। বিষয়টি নিয়ে পিডিবি গ্রাহকরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।


এদিকে, দুর্নীতির বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছেন না পটিয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের (ভারপ্রাপ্ত) নির্বাহী প্রকৌশলীও। কেননা, তিনি কর্ণফুলী পিডিবির উপকেন্দ্রে খুবই কম আসেন। এ সুযোগে পিডিবির উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রণয় আচার্য্যের নেতৃত্বে উপ-সহকারী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাজু মণ্ডল পুরো অফিসে নয়-ছয় সেবা দিচ্ছেন।


তারা দিনে-দুপুরে পিডিবি উপ-কেন্দ্রে অফিস রুমের দরজা বন্ধ রেখে নানা অনিয়ম করছেন বলে গ্রাহকদের অহরহ অভিযোগ। অনেক গ্রাহক বলছেন, দীর্ঘদিন যারা পিডিবির হয়ে কর্ণফুলীতে কর্মরত আছেন, তারাই বেপরোয়া। বদলি না হয়ে বছরের পর বছর সিন্ডিকেট তৈরি করে রেখেছেন।



এতে পিডিবির উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা অস্থায়ী জনবল ও ফিডারে ফিডারে সোর্স বসিয়ে রেখেছেন। তারাই গ্রাহকদের শিকারে পরিণত করেন। এতে গ্রাহকরা না পাচ্ছেন সেবা- না পাচ্ছেন অভিযোগের সঠিক সুরাহা।



এসব বিষয়ে গত তিন দিন ধরে তথ্য উপাত্ত চাইতে গেলেও পিডিবি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের নানা ভাবে হয়রানি করেন। একেক সময় একেক তথ্য দেন। এমনকি তারা প্রিপেইড মিটার সংক্রান্ত কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।


সরেজমিনে কর্ণফুলীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অনেক বাসা-বাড়িতেই এসব প্রিপেইড মিটার লাগানো হয়েছে। তবে কোনো মিটার পিডিবির লোকজন ফ্রি দেয়নি। অন্তত সর্বনিম্ন ২০০ টাকা হলেও লাগানোর ফি নিয়েছেন। আর মিটার বাবদ ৮-১০ হাজার টাকা করে যার কাছে যেমন পেরেছেন, আদায় করছেন।


অনেকেই অভিযোগ করে বলেছেন পিডিবির প্রি-পেইড মিটার নিতে ৮-১০ হাজার লাগে। কিন্তু এ অভিযোগ মানতে নারাজ পিডিবির সহকারী প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী বিষয়টি সত্যতা স্বীকার করেছেন।


এ প্রসঙ্গে অভিযোগকারী চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের জাহেদ হোসাইন নামে এক গ্রাহক বিবার্তাকে বলেন, 'আমার বাসায় আগে বড় ভাইয়ের বিদ্যুৎ লাইন ছিল। পরে পৃথক হয়ে প্রি-পেইড মিটার লাগিয়েছি। এতে ১০ হাজার টাকা লেগেছে। পিডিবি অফিসে মিটারের আবেদন জমা দিয়েছি। পরে লাইনম্যান ও স্থানীয় সোর্সের কাছে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পর পিডিবির লোকজন একটি প্রি-পেইড মিটার লাগিয়ে দিয়েছে। মিটারটির শেষের চার ডিজিট-৯১৬৯।'


শিকলবাহার মো. শাহাব উদ্দিন শিহাব বিবার্তাকে বলেন, 'আমি একটি নতুন প্রি-পেইড মিটার লাগিয়েছি। ১০ হাজার টাকা জমা দিতে বলছে। আবেদন করার পর অফিসের লাইন ম্যানকে টাকা দিয়েছি, তারাই সরকারি মিটার লাগিয়ে দিয়েছে। এসব মিটার বিনামূল্যে তা জানা ছিল না আমার।' একই কথা জানালেন কর্ণফুলীর সাজ্জাদ হোসেন আরমানও।


চরপাথরঘাটা এলাকার ইসহাক আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, 'ফেব্রুয়ারিতে আমি একটি এফজিএফ ব্রান্ডের সিঙ্গেল ফেজ স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার নিয়েছি ১০ হাজার টাকায়। মিটার মডেল নম্বর-পি১২এস০১। মিটারের শেষ চার ডিজিট ২১৪২। কিন্তু পিডিবি অফিস টাকার রিসিভ দিয়েছে ২ হাজার ৫৭০ টাকার। ওখানের মিটারের দাম লেখা ছিলো ১ হাজার ২৫০ টাকা। আর্থিং রড বাবদ ১২০ টাকা। পিভিসি ক্যাবল ১ হাজার ২০০ টাকা। বাকি ৭ হাজার ৪৩০ টাকার কোন রশিদ নেই। অথচ রশিদে স্বাক্ষর দিয়েছেন পিডিবির পটিয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীগণ।


শিকলবাহার আকরাম শেখ নামে আরেক গ্রাহক বিবার্তাকে জানান, 'পুরাতন মিটার নিয়ে নতুন মিটার লাগাতে আমার থেকে ২০০ টাকা নিয়েছে। পাশের বাড়ির একটা লোক আর্থিক অবস্থা খারাপ তাই লোকটি নাকি ১৬০ টাকা দিয়েছে- তা গ্রহণ করেনি।'


শিকলবাহা পেয়াদার পাড়া এলাকার শেখ আনসার বিবার্তাকে বলেন, 'আগের মিটার নিয়ে নতুন মিটার দিছে সেটা সত্য কিন্তু ৮ হাজার টাকা নিয়েছে পিডিবির লোকজন। আমরা তো জানতাম না ফ্রি মিটার এসব।'


এছাড়াও মুনিরুল ইসলাম সেলিম অভিযোগ করেন, 'প্রি পেইড মিটারে বেশি টাকা কাটা হচ্ছে। রিচার্জ করলেই টাকা কর্তন এমন অভিযোগ পুরো কর্ণফুলী জুড়ে। এ কারণে দেখা গেছে, পিডিবি অফিস গ্রাহকদের মাঝে জনসচেতনতা বাড়াতে পারেনি, ডিমান্ড চার্জ ও টোটাল চার্জের বিষয়ে পরিষ্কার কোন মেসেজ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।


আব্দুর রহমান নামে আরেক গ্রাহক বিবার্তাকে বলেন, '২ কিলোওয়াট মিটার দিয়ে মটর, এসি ইত্যাদি চলে না। তাই ১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ করে ৪ কিলোওয়াট মিটার করেছে। এখন ভৌতিক বিলের ভয়ে ভীত।'


খোয়াজনগর এলাকার মোহাম্মদ আলী বিবার্তাকে বলেন, 'আমি ৯ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে মিটার নিয়েছি। তাও ৪-৫ মাস ঘুরে৷' চরপাথরঘাটার দিদার হোসেন বিবার্তাকে জানান, তিনি নতুন মিটার নিয়েছেন ১০ হাজার ৫০০ টাকায়। এ রকম হাজারো অভিযোগ পিডিবি কর্ণফুলী অফিসের বিরুদ্ধে।


খোয়াজনগর এলাকার মিরাজ বলেন, 'প্রিপেইড মিটার যে বিনামূল্যে তা জানা ছিল না। বিনামূল্যের মিটার আমাদের কিনতে হয়েছে উচ্চ মূল্যে। আবার প্রতি মাসে চার্জও কাটা হবে। মাসে গ্রাহককে এর জন্য ৪০ টাকা চার্জ দিতে হবে। রয়েছে ভ্যাট ও ডিমান্ড এবং টোটাল চার্জ।'



সাধারণ গ্রাহকদের আরও অভিযোগ, বিনামূল্যের প্রি-পেইড মিটার লাগাচ্ছে অফিসের লোকজন। তারা মিটার প্রতি ২০০-৫০০ টাকা দিলেই এসব মিটার দিচ্ছেন। লোকজন বলছেন, পিডিবির অফিসটা লুটপাটের একটা জায়গা। সাধারণ মানুষ তাদের হাতে জিম্মি।



এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির কর্ণফুলী মইজ্জ্যারটেক উপ-কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রণয় আচার্য্য বিবার্তাকে বলেন, 'আসলে মিটারগুলো লাগাচ্ছে সরাসরি ঢাকার লোক। আমরা মাইকিং করে বলেছি। এসব মিটার লাগাতে যাতে কেউ টাকা না দেয়। এ রকম কেউ যদি টাকা দিয়ে থাকে তাহলে আমাদের কাছে নাম ঠিকানাসহ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।'


এ প্রসঙ্গে জানতে পটিয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের (ভারপ্রাপ্ত) নির্বাহী প্রকৌশলী আ. স. ম. রেজাউন নবীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।


তবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জোনের পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেল বিউবো'র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) উজ্জ্বল কুমার মোহন্ত বিবার্তাকে বলেন, 'কর্ণফুলীতে গ্রাহক ১৭ হাজার নয়। পটিয়াসহ ৪৩ হাজার ৬৮৯টি প্রি-পেইড মিটার বসাবে। ঢাকা থেকে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব প্রি-পেইড মিটারগুলো বসানো হচ্ছে। এতে কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছেন চীনা কোম্পানি হেক্সিং।'


তিনি আরও বলেন, 'কর্ণফুলীতে ৩১ হাজার ২০০ গ্রাহক, এটি কে বলছে আপনাদের? মোট গ্রাহক আরো বেশি। আমার জানা মতে ৬০ হাজারের অধিক। আপনাদের ভুল তথ্য দিয়েছে। কেননা এর আগে আমরাও প্রি পেইড মিটার বসিয়েছি। যেগুলো বাদ ছিল সেগুলো এখন ঢাকার একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে বসানো হচ্ছে।'


তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহন্ত এক পর্যায়ে বিনামূল্যে মিটারগুলো বিতরণের কথা স্বীকার করে বলেন, 'এসব মিটার একদম বিনামূল্যে লাগানোর কথা। কিন্তু কারা টাকা নিচ্ছে আমরা জানি না। আমি খবর নিচ্ছি। আর কেউ যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন- তবে আমরা ওই প্রজেক্টের লোকজনের সাথে কথা বলবো। পাশাপাশি ব্যবস্থা নেবো।'


বিবার্তা/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com