শিরোনাম
গুলি-স্প্রিন্টারের ক্ষত নিয়ে অনিশ্চিত জীবন কুড়িগ্রাম সীমান্তবাসীর
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২১, ১৫:৩৮
গুলি-স্প্রিন্টারের ক্ষত নিয়ে অনিশ্চিত জীবন কুড়িগ্রাম সীমান্তবাসীর
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

কুড়িগ্রামে প্রায় ২৭৮.২৮ কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ২৪৬ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এসব সীমান্ত দিয়ে গরু, মাদক পাচার ও ঘাস কাটতে বা মাছ ধরতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র নৃশংসভাবে ছোঁড়া গুলি ও ককটেলের আঘাতে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন। আবার যারা বেঁচে ফিরছেন তাদের অনেকেই শারীরিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।


স্বাধীনতার পর গত ৪৫ বছরে কুড়িগ্রামের বিভিন্ন সীমান্তে ৭২জন বাংলাদেশিকে হত্যা এবং অর্ধ-শতাধিক ব্যক্তিকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। ফেলানীকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার পর কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখার মর্মস্পর্শী ঘটনাও এই জেলায় হয়েছে।


বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের সীমান্ত এলাকার মধ্যে ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, রৌমারী ও চর রাজীবপুর উপজেলা এলাকার মধ্যে রয়েছে বেশি অবৈধভাবে সীমান্তে যাতায়াত। এসব এলাকায় কমবেশি চোরাচালান হলেও সংঘর্ষে আহত-নিহতের ঘটনা বেশি ঘটেছে ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও রৌমারী উপজেলায়। তবে সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি মাদক পাচার নিয়ে সীমান্তে দুর্ঘটনা ঘটছে রৌমারী উপজেলায়।


রৌমারী ও চর রাজীবপুর উপজেলায় রয়েছে ৬৮ কিলোমিটারব্যাপী সীমান্ত এলাকা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় রাজ্য ঘেঁষা এই জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষকে জীবন জীবিকার কারণে সীমান্তে যেতে হয় প্রতিদিন। নোম্যান্সল্যান্ড কিংবা জিরো লাইনের কাছে অনেক মানুষের রয়েছে আবাদী জমি। তাদেরকে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে সেইসব জমি চাষাবাদ করতে হয়। আর এই কাজ করতে গিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে অনেককেই।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০০ সালে ফুলবাড়ীর খালিশা কোটাল গ্রামের দুইভাই সগির (২৫) ও একরামুল (৩০), ২০০১ সালে করলা গ্রামের সিরাজুল ইসলাম (২৬), ২০১০ সালে মইনুল (২২) ও মিঠু (২৬) বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। ২০০৯ সালে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আশরাফুল (১৪)। এছাড়াও বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ১০ জনকে। ২০১১ সালে ৭ জানুয়ারি ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে বিএসএফ। সে ঘটনা বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হলেও বন্ধ হয়নি সেই নির্মমতা।


রৌমারী-রাজিবপুর সীমান্তে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে ৫৮ জন। ধরে নিয়ে গেছে ৩৫ জনেরও বেশি বাংলাদেশিকে। সব মিলিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী গত ৪৫ বছরে কুড়িগ্রামের সীমান্তে ৭২ জন বাংলাদেশীকে হত্যা এবং অর্ধ-শতাধিক ব্যক্তিকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে বিএসএফ।


সরেজমিন রৌমারীতে ঘুরে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ছাট কড়াইবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা টুনু মিয়ার ছেলে মানিক মিয়া (৩৫)। প্রায় তিন বছর আগে সীমান্ত দিয়ে গরু এবং চোরাচালান করতে গিয়ে বিএসএফ’র ককটেলের আঘাতে প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। ডান হাত-পা অবশ। শরীরের বিভিন্ন অংশে রয়েছে ককটেলের স্প্রিন্টার। স্প্রিন্টারের যন্ত্রনা এখনও সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। বর্তমানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন করছে মানিক মিয়া।


একই ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের বাসিন্দা জোব্বার আলীর ছেলে রেজাউল করিম রেজা। দেড় বছর আগে সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান করতে গিয়ে বিএসএফ’র ককটেলের আঘাতে দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন। একই গ্রামের বাসিন্দা ইদ্রিস আলীর ছেলে অহিদুর রহমান (৩৬) প্রায় ৫ বছর আগে এই চোরাচালান করতে গিয়ে বিএসএফ’র ককটেল হামলার স্বীকার হয়ে আজ এক চোখ অন্ধ অপর চোখটিও নষ্ট হওয়ার উপক্রম। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।


আহতদের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধত্ব বরণ করেছেন দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের বাসিন্দা সেকেন্দার আলীর ছেলে মঞ্জু মিয়া (৪০), জাকির হোসেনের ছেলে কলেজছাত্র হাসান, রবিউল ইসলামের ছেলে ছক্কু মিয়া, জহুরুল ইসলামের ছেলে মঞ্জু, একই ইউনিয়নের ছাটকড়াইবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা মালেকের ছেলে জালাল উদ্দিন (৩৫) এবং রৌমারী সদর ইউনিয়নের ভন্দুরচরের বাসিন্দা মৃত ফরহাদ হোসেনের ছেলে লাল মিয়া (৪৫), নতুন বন্দরের মশিউর রহমান (৫৫)।


এছাড়াও ২০১৮সালের ৩০ এপ্রিল বিকেলে ফুলবাড়ী উপজেলার গোড়কমন্ডল সীমান্তে আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার ৯৩০/৮ এর পাশে বাংলাদেশের ২০ গজ অভ্যন্তরে রাসেল নিজেদের গরুর ঘাস কাটতে যায়। এসময় ৩৮বিএসএফ ব্যাটালিয়নের নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্য রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে স্কুলছাত্র রাসেলের মুখে রাবার বুলেট ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। দীর্ঘ একমাস চিকিৎসা শেষে তার ডান চোখটি অন্ধ হয়ে যায়। একটি চোখের দৃষ্টি হারিয়ে অপরটিও এখন হুমকির মুখে পড়েছে। বিএসএফ’র কারণে অন্ধ হবার পাশাপাশি এখনও স্প্রিন্টারের টুকরো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন রাসেল।


রাসেল বলেন, বাড়ির গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে নিজ দেশেই বিএসএফ’র রাবার বুলেটের আঘাতে আজ আমি এক চোখে অন্ধ। বাম চোখ দিয়েও ভালো দেখতে পাচ্ছি না। অভাবের সংসারে তিন বছর আগেই বহু টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেছে। ভারত সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। কিন্তু করোনার মহামারীতে তার আর কোন খোঁজ রাখেনি। অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কোন ফল হয়নি। আমার ভবিষ্যৎ এখন পুরোটাই অন্ধ।


রাসেলের মা আঞ্জু আরা বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলের কোন অপরাধ ছিলো না। অথচ বিএসএফ’র নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ছেলে আমার অন্ধ হয়ে গেছে। স্বপ্ন ছিলো পড়াশোনা করে অভাবের সংসারে একটু হাল ধরবে। কিন্তু সব শেষ। অন্যায়ভাবে বাংলাদেশে এসে বিএসএফ’র গুলি করার দোষ প্রমাণিত হইছে। তাদের সরকার আমার ছেলে চিকিৎসাসহ ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও এই তিন বছরের আর তাদের কোন খোঁজ নেয়নি।


মানিক মিয়া বলেন, প্রায় তিন বছর আগে গরুর জন্য ঘাস আনতে গিয়ে বিএসএফ’র হামলার স্বীকার হয়ে আজ আমি অচল। আমার পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছি।


রেজাউল করিম রেজা বলেন, সীমান্ত এলাকায় কোন কাজ নেই। অভাবের তাড়নায় চোরাচালান করতে গিয়ে বিএসএফ’র ককটেল হামলায় আমার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। জমি-জমা যা ছিলো বিক্রি করে ঢাকায় চিকিৎসা করেছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এখন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে।


ধর্মপুর গ্রামের বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, গত তিন বছরে চোরাচালান করতে গিয়ে ১০জন নিহত হয়েছে বিএসএফ’র হাতে। বহু লোক পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এখন এসব পরিবার খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। গরু ও চোরাকারবারী দলের ২৫/৩০ জনের দল রয়েছে। তাড়া গরু বা চোরাচালান করতে পারলে আহত পরিবারগুলোকে এক থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে যায়। তাই দিয়ে তাদের সংসার চলে।


দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের মেম্বার মিজানুর রহমান বলেন, চোরাচালান ও গরুর ঘাস কাটতে গিয়ে বা মাছ ধরতে গিয়ে অনেকেই নিহত হয়েছেন। আবার অনেকেই আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আমার ইউনিয়নে ১০ জনের অধিক এমন অন্ধ ও শারিরিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করা ব্যক্তি রয়েছে।


সীমান্তের এসব ঘটনা নিয়ে রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-ইমরান বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুলতার কারণে সীমান্তে চোরাচালানসহ অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। এসব অপরাধে জড়িয়ে যারা পঙ্গুত্ব বা অন্ধত্ব বরণ করেছে তার সঠিক হিসেব আমাদের কাছে নেই। সীমান্ত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা গেলে আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতায় সীমান্ত অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।


বিবার্তা/বিপ্লব/আশিক/এমও

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com