
নদী মাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্র জালের মত বিস্তৃত রয়েছে বিভিন্ন নদ-নদী। তবে সময়ের বিবর্তনে নানা সংকটে পলি জমে একে একে বিলীণ হচ্ছে নদীগুলো। ইতোমধ্যে মরা কপোতাক্ষের প্রাণ ফেরাতে সরকার হাতে নিয়েছে কপোতাক্ষ খননের। একই পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে শিবসা ও শালতা।
তবে শালতার অবস্থা শিবসার চেয়ে ভয়াবহ। ইতোমধ্যে শালতার নব্যতা হ্রাসে পরিণত হয়েছে মরা খালে। কোন কোন এলাকায় বিশেষ করে প্রায় ১৮ কিলোমিটার নদীর চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া দুস্কর। অনেক এলাকা সমতল ভূমির সাথে মিশে বে-দখল হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে বাড়ি-ঘর। কোথাও ফলছে ফসল। আবার কোথাও বাঁধ দিয়ে মাছের চাষ হচ্ছে।
খুলনার পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও সাতক্ষীরার তালা সীমাণার বুক চিরে বয়ে চলা এক সময়ের খরস্রোতা শালতার বর্তমান চিত্র এমন।
পাইকগাছার শিবসা থেকে উৎপত্তি নদীটি মিশেছে বুড়িভদ্রায়। শালতার উপর নির্ভর করে চলতো বিস্তীর্ণ জনপদের সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা। সেচ মৌসুমে শালতার পানি জাগিয়ে তুলতো বিস্তীর্ণ মাঠ। মৎস্যজীবিদের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম ছিল এটি।
শীতকালীন সব্জি চাষেও মূল ভরসা ছিল শালতা। সেই আশা জাগানিয়া আশীর্বাদের শালতা এখন জনপদের অভিশাপ! বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাষিত হতে না পেরে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনেক আগেই পরিবর্তন ঘটেছে নৌকার।
তবে বসে নেই শালতা জনপদের মানুষ। অবহেলিত জনপদের বঞ্চিত মানুষের জীবিকার উৎস্য শালতায় প্রাণ ফেরাতে নেমেছে রাজপথে। গঠন হয়েছে শালতা বাঁচাও আন্দোলন কমিটি। প্রতিনিয়ত নানা কর্মসূচি দিয়ে তারা ছুটে চলেছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। একটি নদীর প্রাণ ফেরাতে তারা আজ মানববন্ধনের মত শক্ত কর্মসূচিও দিচ্ছে।
শালতা তীরবর্তী পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও তালার প্রত্যন্ত এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে মিলেছে জানা অজানা অনেক তথ্য। কপোতাক্ষ’র পলিভরাটে যৌবনহানির পর পাইকগাছার কপিলমুনি,তালা উপজেলার খলিলনগর,তালা সদর,তেঁতুলিয়া এবং ইসলামকাটী ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের কমপক্ষে ১ লাখ মানুষের দুর্ভোগের যেন আজ আর অন্ত নেই।
গ্রামের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলাতী এবং নদী ভরাটি এলাকা ইজারা দেয়ায় বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম জলাবদ্ধতার। পানির অন্যতম আঁধার শেষ হওয়ায় ঐসকল এলাকায় আজ আর আগের মত ফসল ফলেনা।
কৃষি থেকে পেশা বদল হয়েছে বহু মানুষের। অনেকেই হয়ে পড়েছে বেকার। অনেককেই আলিঙ্গন করতে হয়েছে উর্বরতা বিধ্বংসী লোনা পানির চিংড়ির সাথে। এক কথায় ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছে তাদের। ইতোমধ্যে তাদের আয়োজনে বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ ও পানি কমিটির সহযোগিতায় শালতা নদী পুনর্জীবনের লক্ষ্যে নদী অববাহিকার ভুক্তভোগী মানুষ ও জন প্রতিনিধিদের নিয়ে দফায় দফায় চলছে সভা-সমাবেশ ও মানব বন্ধন কর্মসূচি।
এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি, সীমাণা নির্ধারণপূর্বক খনন হোক শালতা। সাথে সাথে রক্ষা করতে হবে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে বন্দোবস্তকৃত জমি,উচ্ছেদ করতে হবে সকল অবৈধ স্থাপনা। সরকারি ম্যাপে এই নদীর চওড়া কোথাও ৪৫০ ফুট, কোথাও ৫০০ ফুট আবার কোথাও ৪০০ ফুট।
ডুমুরিয়া উপজেলার বৈটায়ারা গ্রামের বাসিন্দা দিপংঙ্কর মন্ডল (৫২) জনান, শালতা স্রোতের তোড়ে এক সময় ভেসে গেছে বহু ঘর-বাড়ী, মানুষ, গবাদি পশু। আর আজকের শালতার বুকে বসতবাড়ী,ফসলের ক্ষেত ও মাছের চাষ।
মাত্র দু’দশক আগেও নদীটি ৫শ’ ফুট চওড়া ছিল বলে দাবি করে তিনি বলেন,আর এখন অনেক জায়গায় নদীর চিহ্নটি পর্যন্ত নেই। এক সময় নদীর স্থান দিয়ে চলত লঞ্চ, স্টিমার। আর এখন সেখান দিয়ে চলে মটরসাইকেল, ভ্যান।
তালার হাজরাকাটীর সুভাষ ঘোষ বলেন,নদীর জীবদ্দশায় বিলাঞ্চলে ফলত বিভিন্ন প্রজাতির ধান। হরকোজ,বালাম, পাটনাই সহ বিভিন্ন ধানের খ্যাতি ছিল দেশজোড়া। নদী মৃত্যুর সাথে সাথে হারিয়ে গেছে সে সব ধানের জাতও।
শালতা বাঁচাও কমিটির সভাপতি তালার খলিলনগর সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সরদার ইমান আলী জানান, জোয়ার-ভাটার মৃত্যুতে শালতারও মৃত্যু হয়েছে। এলাকার সাধারণ মানুষের ভাল থাকতে শালতা খননের বিকল্প নেই। একই মন্তব্য কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দারও একই মত পোষণ করেন।
খলিলনগরের সাবেক আরেক চেয়ারম্যান ও তালা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক প্রনব ঘোষ বাবলু জানান, শালতা খনন হলে পাইকগাছা, তালা, ডুমুরিয়া উপজেলার অন্তত ৪০টি গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে। মৎস্যজীবীরাও ফিরে পাবে তাদের জীবিকার উৎস্য।
তালা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার জানান,সরকার চাইলে বিস্তীর্ণ জনপদের সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য শালতা খনন প্রকল্প হাতে নিতে পারেন।
সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) সংসদ সদস্য এ্যড. মুস্তফা লুৎফুলাহ জানান, তিনি পাঁচবার শালতা খননের বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করলেও কোন গুরুত্ব আসেনি।
শালতা খননে গত ১০ ডিসেম্বর পুনরায় একটি ডিও পাঠিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, শালতার মূল অংশ খুলনার ডুমুরিয়ার উপর দিয়ে বযে গেছে তাই তার সদিচ্ছা জরুরী।
শালতার বর্তমান সংকটে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী (যশোর অঞ্চল) প্রবীর গোস্বামীর প্রতিক্রিয়া জানতে তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সর্বশেষ শালতা তীরবর্তী মানুষের প্রাণের দাবি, খনন হোক শালতা। জীবন-জীবিকায় ফিরে আসুক প্রাণ। এমন প্রত্যাশায় শালতা বাঁচাও আন্দোলন কমিটিও এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে।
বিবার্তা/সেলিম/ইমদাদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]