বিশেষ প্রতিবেদন
টাঙ্গাইলে পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে গ্রিন অয়েল তৈরির কারখানা
প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৪, ১৯:৪৯
টাঙ্গাইলে পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে গ্রিন অয়েল তৈরির কারখানা
টাঙ্গাইল থেকে ইমরুল হাসান বাবু
প্রিন্ট অ-অ+

টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই আবাসিক এলাকায় নির্মিত কারখানায় তৈরি হচ্ছে গ্রিন অয়েল। গ্রিন অয়েল তৈরির মারাত্মক ধোঁয়ায় চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন এলাকায় বসবাসকারীরা। দাহ্য ওই পদার্থ তৈরিতে কাঠ পোড়ানোসহ কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তায় ব্যবহার হচ্ছে না বিশেষ কোনো পোশাক। এতে মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছেন কর্মরত শ্রমিকরাও।


শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতাসহ গ্রিন অয়েল তৈরির ধোঁয়ার দুর্গন্ধে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। দ্রুত কারখানাটি বন্ধ অথবা অন্যত্র সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।


টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের বররিয়া এলাকায় নির্মিত হয়েছে মা বাবার দোয়া গ্রিন অয়েল নামের ওই কারখানাটি।


স্থানীয়রা জানায়, সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নের বররিয়া এলাকার শলী মণ্ডল ও লিটন নামের দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রায় ২০ শতাংশ জমি ভাড়া নিয়ে উপজেলার গালা ইউনিয়নের বার্থা গ্রামের আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী মা বাবার দোয়া গ্রিন অয়েল কারখানাটি নির্মাণ করেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চলছে ওই কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম।


সরেজমিন দেখা গেছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বররিয়া গ্রাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানাটির চারপাশে খেলা করে ছোট্ট শিশুরা। দেখা গেছে, নির্মিত গ্রিন অয়েল কারখানার গেইটে নেই কোনো সাইন বোর্ড। কারখানায় কর্মরত ১০/১২ জন শ্রমিক। দিনরাত চলছে উৎপাদনের কাজ। ওই গ্রিন অয়েল তৈরিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ। দাহ্য ওই পদার্থ উৎপাদনে সম্পৃক্ত শ্রমিকরাও নিরাপত্তায় ব্যবহার করছেন না বিশেষ কোন পোশাক। কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের নেই স্বাস্থ্য সনদ।



কারখানায় কর্মরতরা জানায়, ডিজেলের গাদ (ক্রুট ও স্লাইস)পরিশোধন করে তৈরি করা হচ্ছে গ্রিন অয়েল। পাকা সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে উৎপাদিত ওই গ্রিন অয়েল। এর প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ৪০/৪৫ টাকা দরে। সপ্তাহে প্রায় ৪/৫ হাজার লিটার গ্রিন অয়েল উৎপাদন হচ্ছে কারখানাটিতে বলেও জানান তারা।


স্থানীয়দের অভিযোগ, নীতিমালা অমান্য করে এই আবাসিক এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বিষাক্ত পদার্থ তৈরির কারখানাটি। কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় এলাকার পরিবেশ নষ্ট হওয়াসহ মারাত্মকভাবে বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। জনবসতিহীন এলাকায় এ ধরনের কারখানা তৈরির বিধান থাকলেও আবাসিক এলাকার কারখানাটিকে বিভিন্ন দফতর থেকে সনদ দেওয়া হয়েছে! সনদদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কারখানা তৈরির স্থান পরিদর্শন করেছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দ্রুত কারখানাটি বন্ধ অথবা অন্যত্র সরিয়ে নিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।


বররিয়া গ্রামের বাসিন্দা রহিজ উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, তেল বিক্রি করার কথা বলে জমিটি ভাড়া নিয়েছিল বার্থা গ্রামের আনোয়ার। এখন এখানেই তেল উৎপাদন শুরু করেছে। কারখানায় উৎপাদিত তেলের গন্ধে এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পরেছে। এতে চরম কষ্ট ভোগ করছে এলাকাবাসী। আবাসিক এলাকায় কারখানাটি নির্মাণ করা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।


স্থানীয় বাবুল মিয়া বিবার্তাকে বলেন, বার্থা গ্রামের আনোয়ার কারখানাটি নির্মাণ করেছেন। স্থানীয়দের কাছে তথ্য গোপন রেখে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। গাদ পুড়িয়ে তেল বানানো হচ্ছে কারখানাটিতে। গাদ পোড়ানোর পচা গন্ধে এলাকায় থাকা কষ্টকর হয়ে উঠেছে।


সাবেক ইউপি সদস্য ও বররিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য সৈয়দ শাহীন বিবার্তাকে বলেন, কারখানাটি নির্মাণের বিষয়ে আমরা অবগত ছিলাম না। কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ার গন্ধে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পরেছে এই এলাকা। বসবাসকারীরা রয়েছে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।


কারখানার দুর্গন্ধে ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না স্থানীয়রা। শিশু, মহিলাসহ বৃদ্ধরা রয়েছে ফুসফুস, শ্বাসনালির নানা ব্যাধিসহ হাঁপানির মত স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। কারখানাটির বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর এলাকার সকলে মিলে একটি দরখাস্ত দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।


জমি মালিক শলী মণ্ডল বিবার্তাকে বলেন, আমার জমিটি পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছে বার্থা গ্রামের আনোয়ার। এখানে কীসের কারখানা নির্মাণ করা হবে সেটিও তাকে জানানো হয়নি। তবে ভাড়ার চুক্তিনামা দলিলে পরিবেশ নষ্টের মত কিছু অথবা অবৈধ কিছু নির্মাণ করা হলে, জমির মালিক যে কোন সময় চুক্তিনামা দলিল বাতিল করতে পারবে বলে উল্লেখ করা আছে।


কারখানায় অপারেটর পদে কর্মরত আখতার হোসেন বিবার্তাকে বলেন, জ্বালানি তেল তৈরি করা হচ্ছে কারখানায়। এটি মূলত পরিশোধন কারখানা। বিশেষ পোশাক বা স্বাস্থ্য সনদ আছে কিনা এমন প্রশ্ন এড়িয়ে আছে বলে বক্তব্য শেষ করেন তিনি।


কারখানার ম্যানেজার মো. আনিসুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, ডিজেলের গাদ (ক্রট ও স্লাইস) চট্টগ্রাম থেকে এনে এই কারখানায় পরিশোধন করে গ্রিন অয়েল তৈরি করা হচ্ছে। এই অয়েল সড়ক নির্মাণে কার্পেটিং এর কাজে ব্যবহার করা হয়। পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য টাকা জমা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া কারখানা পরিচালনার শিল্প সনদ, ভ্যাট লাইসেন্স, কলকারখানা সনদ, ফায়ার লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ জেলা প্রশাসকের এনওসি নেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কারখানার নির্গত ধোঁয়ায় যেটুকু দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, সেটি নিরসনে ইন্ডিয়া থেকে একটি কেমিক্যাল আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।


ম্যানেজার আরো জানান, আমরা কাগজপত্র করতে দিছি, কাগজপত্র ঠিক হতে একটু সময় লাগবে।


২নং ওয়ার্ড বররিয়ার ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম রতন বিবার্তাকে বলেন, কারখানার দুর্গন্ধে বসবাস করার অযোগ্য হয়ে উঠেছে এই এলাকা। এলাকাবাসীকে নিয়ে দ্রুতই কারখানাটি বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া হবে।


পরিবেশবিদ সোম নাথ লাহেড়ী বিবার্তাকে বলেন, জ্বালানি উৎপাদনে নিয়োজিত কারখানাগুলো আবাসিক এলাকায় নির্মাণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এ ধরনের কারখানার নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এতে গাছপালার পাতা পচে যাওয়াসহ ফসল ও ফলমূল উৎপাদন কমে যাবে।


এছাড়াও মানবদেহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হবে। বিশেষ করে শিশু, মহিলাসহ বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী হাঁপানী, ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।


টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, আবাসিক এলাকায় জ্বালানি কারখানা নির্মাণের নিয়ম নেই। এছাড়াও মা বাবার দোয়া গ্রিন অয়েল কারখানাটি নির্মাণ প্রসঙ্গে আমি অবগত নই। সরেজমিন পরিদর্শন করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।


টাঙ্গাইল কল কারখানার উপ-মহাপরিদর্শক মহর আলী বিবার্তাকে বলেন, কারখানাটি পরিদর্শন করা হবে। নিয়মের ব্যত্যয় পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


টাঙ্গাইল সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাসান-বিন-মুহাম্মদ আলী বিবার্তাকে জানান, গ্রিন ওয়েল কারখানার বিষয়ে তিনি অবগত নন। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।


বিবার্তা/রোমেল/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com