বিশেষ প্রতিবেদন
ম্যানেজ করেই চলছে মইজ্জ্যারটেকের হাক্কানী পশুখাদ্য কারখানা!
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৪, ২২:৪৫
ম্যানেজ করেই চলছে মইজ্জ্যারটেকের হাক্কানী পশুখাদ্য কারখানা!
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর মইজ্জ্যারটেকে কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ১০ বছর ধরে ম্যানেজ করেই চলছে ‘হাক্কানী কর্পোরেশন লিমিটেড’ নামক একটি পশুখাদ্য কারখানা। অথচ প্রতিষ্ঠানটির নেই পরিবেশ অধিদফতর ও মৎস্য বিভাগের লাইসেন্স।


মইজ্জ্যারটেকের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি কারখানার তীব্র গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে চরপাথরঘাটা, শিকলবাহা ও চরলক্ষ্যার আশপাশের এলাকা। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে এখানকার শিশুরা। এছাড়া এখানকার বর্জ্য যাচ্ছে নালা হয়ে খালে। দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদীও।


নুরুল আলম ও জুয়েল নামে দুই ব্যবসায়ী বিবার্তাকে বলেন, ‘মইজ্জ্যারটেক এলাকা হয়ে আসা-যাওয়া কালে পাশের মুরগির খাদ্য উৎপাদনকারী কারখানার পচা গন্ধে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।’


জানা গেছে, কারখানাটিতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা অভিযানে সিলগালা করে বন্ধ করলেও পুনরায় চালু করেন হোতারা। মনে হচ্ছে কারখানাটির কাছে বিএসটিআই, পরিবেশ অধিদফতর ও উপজেলা প্রশাসনও অসহায়। না হলে কয়েকবার সিলগালার পরও কীভাবে চালু হয় কারখানাটি। এটাই স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা।


নিয়মনীতি না মানার অভিযোগ থাকলেও কারখানার লোকজন প্রকাশ্যে বলছে, সব ম্যানেজ করেই তারা কারখানাটি চালাচ্ছেন। অথচ পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে পশু খাদ্য উৎপাদনের কারখানাটি।


তথ্য পাওয়া যায়, ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শামসুল তাবরেজ পরিবেশ দূষণের কারণে কারখানাটি সিলগালা করেন। এরপর গত ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর ওই কারখানায় অভিযান চালান কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী। তখন ট্যানারির পচা বর্জ্যের সংমিশ্রণে মাছ ও মুরগির খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র না থাকায় ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের ২১ অক্টোবর একই অপরাধে হাক্কানি কর্পোরেশন লিমিটেড নামক এই প্রতিষ্ঠানকে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা করেছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মামুনুর রশিদ।


অথচ, গরু-ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগির ফার্ম, খাদ্য তৈরি কারখানা ও এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। যেখানে এ ধরনের কারখানা লোকালয় থেকে দূরে গড়ে তোলার কথা। কিন্তু একদম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে উঠছে এই খাদ্য কারখানা। ফলে, ওইসব এলাকার পরিবেশ মারাত্মক ভাবে দূষিত হচ্ছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন।


তথ্য মিলে, ২০১৫ সালে কর্ণফুলীর মইজ্যারটেক এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। এ কারখানার সামনে কোনো সাইনবোর্ড নেই। আছে জমির মালিক মুছা সওদাগরের নামফলক। অতীতে আন্দোলনের মুখে কারখানাটি তিন মাসের মধ্যে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও মালিকপক্ষ কথা রাখেনি। বর্তমানে কারখানাটির কার্যক্রম আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কেননা, কারখানায় ট্যানারি, মাছ ও হাঁস-মুরগির উচ্ছিষ্ট দিয়ে মুরগির ফিড তৈরির পাউডার ও তৈল উৎপাদন করা হয়। কারখানার পাশে রয়েছে চরপাথরঘাটা হামিদিয়া বাগদাদিয়া হেফজখানা, এতিমখানা, মাদ্রাসা ও মসজিদ। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছে ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।


নাম প্রকাশ না করা শর্তে মাদ্রাসার এক শিক্ষক বলেন, ‘মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও হেফজখানার দরজা-জানালা ২৪ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয়। গভীর রাতে এত বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায় যে, দম বন্ধ হয়ে আসে।’


উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রুমন তালুকদার বিবার্তাকে বলেন, 'আমরা যখন গত বছর ওই কারখানাতে অভিযানে করেছিলাম, তখন প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে তাদের অনুমোদন ছিল। কিন্তু এখন তা কার্যকর আছে কিনা জানি না। মেয়াদ আপডেট করেছে কিনা দেখে বলতে পারব। কারখানার বাহিরে দুর্গন্ধ না ছড়ানোর জন্য ইটিপি প্ল্যান বসানোর কথা ছিল। তাও বসায়নি হয় তো। এ বিষয়ে খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’


কারখানার পরিচালক শাহ মোহাম্মদ একরামকে একাধিকবার কল করলেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি এ বিষয়ে জানতে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাবের আহমদকে একাধিকবার কল করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।


এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নূর হাসান সজীব বিবার্তাকে জানান, হাক্কানী পশু খাদ্য কারখানায় ইতিমধ্যে আমরা অভিযান করেছি। অনেক আগেই তাদের পরিবেশ ছাড়পত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। ছাড়পত্রের মেয়াদ বৃদ্ধি জন্য তারা আবেদন করেছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর সার্বিক কার্যক্রমে ও পরিবেশ বিবেচনা করে তাদের ছাড়পত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’


কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী বিবার্তাকে জানান, ‘এলাকার মানুষের এসব সমস্যাগুলো নিয়ে উপজেলা মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় জনপ্রতিনিধিদের আলোচনা করা উচিত। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আরো দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। আর এলাকার মানুষের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই কারখানায় আমি অভিযান চালিয়ে দুই লাখ করে মোট ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছি। এরপরেও যেহেতু অভিযোগ আসতেছে- খবর নিচ্ছি।’


কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুমা জান্নাত বিবার্তাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি না। খোঁজ খবর নিয়ে জনস্বার্থে আইনি ব্যবস্থা নেব।’


বিবার্তা/জাহেদ/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com