কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ
উপাধ্যক্ষকে স্বপদে পুনর্বহাল রাখতে মন্ত্রণালয় ও মাউশির নির্দেশ, কলেজ কর্তৃপক্ষের গড়িমসি
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪, ২০:১০
উপাধ্যক্ষকে স্বপদে পুনর্বহাল রাখতে মন্ত্রণালয় ও মাউশির নির্দেশ, কলেজ কর্তৃপক্ষের গড়িমসি
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের সাময়িক বরখাস্ত উপাধ্যক্ষ সাবিনা ইয়াছমিনকে স্বপদে পুনর্বহালের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্দেশনা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর কর্তৃক অনুরোধ জানানো হলেও দীর্ঘ দিন বিষয়টি আমলে না নিয়ে গড়িমসি করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।


কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ- কুষ্টিয়া জেলার সদর উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কুষ্টিয়া শহরের অভ্যন্তরে সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে প্রায় ২ একর জমির উপর কলেজটি অবস্থিত। এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত। কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ শিক্ষার উন্নয়নে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।



শিক্ষার উন্নয়নে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে নানা অনিয়ম ও বাণিজ্যিক স্বার্থে ক্ষুণ্ন হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘ দিনের সুনাম। তারই অংশ হিসেবে কলেজটির উপাধ্যক্ষ সাবিনা ইয়াছমিনকে ২০১৬ সালে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তের কারণে বলা হয়, সাবিনা ইয়াছমিনের নিয়োগ বৈধ নয়। অতঃপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের অনুরোধক্রমে তাকে স্বপদে পুনর্বহাল করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালে তাকে পুনরায় বরখাস্ত করা হয়! এমনকি বিগত এক বছর যাবত তার বেতন-ভাতা বন্ধ রাখা হয়েছে।



উপাধ্যক্ষ সাবিনা ইয়াছমিনের সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারপূর্বক স্বপদে পুনর্বহালের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পত্র নং- ৩৭,০০,০০০০,০৭০.৬৯.০০১.২০(অংশ-১)-১৪৭, তারিখ: ২৭/০৪/২০২২খ্রি. এর মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক (১) মাউশি অধিদপ্তরের পত্র নং- ৩৭,০২,০০০০.১০৫,৩১,০৬১.২০১৮/২০২১/৭; তারিখ: ০৬/০৭/২০২২খ্রি., (২) মাউশি অধিদপ্তরের স্মারক নং- ৩৭.০২.০০০০.১০৫,৩১,০৬১.২০১৮.৩৩৮৫/৯, তারিখ: ১২/১০/২০২২ খ্রি (৩) মাউশি অধিদপ্তরের স্মারক নং- ৩৭.০২,০০০০ ১০৫.৩১.০৬১.২০১৮/১৩০/১০, তারিখ: ১০/০১/২০২৩ খ্রি., (৪) মাউশি অধিদপ্তরের স্মারক নং- ৩৭.০১.০০০০.১০৫.৩১.০৬১.২০১৮/৮৭৪/১০, তারিখ: ০২/০৩/৯০২৩ খ্রি.- অর্থাৎ উল্লিখিত পত্রের মাধ্যমে সাবিনা ইয়াছমিনকে পুনর্বহালের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তাকে পুনর্বহালের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শেষপর্যন্ত সাবিনা ইয়াছমিনকে পুনর্বহাল না করায় তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পুনর্বহালের জন্য আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে স্বপদে পুনর্বহালের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পত্র নং- ৩৭,০০,০০০০,০৯৫ ০৯৯.০৭.২০২৩.৪৫১; তারিখ: ০৭/০৯/২০২৩ খ্রি. পত্রে পুনরায় নির্দেশনা প্রদান করেন।


কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের সাবিনা ইয়াছমিনকে উপাধ্যক্ষ পদে পুনর্বহাল করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্দেশনা এবং উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর কর্তৃক অনুরোধ জানানো হলেও সেই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরে থাক আমলেই নিচ্ছে না কলেজ কর্তৃপক্ষ।


সরেজমিনে কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. হাবিবুল ইসলাম এবং ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষের পদে আছেন আতাহার আলি।


উপাধ্যক্ষ সাবিনা ইয়াছমিনকে স্বপদে পুনর্বহাল কেন করা হচ্ছে না জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. হাবিবুল ইসলাম বিবার্তাকে জানান, সাবিনা ইয়াসমিনের নিয়োগ বৈধ না, উপাধ্যক্ষ হওয়ার কাম্য অভিজ্ঞতা সাবিনা ইয়াছমিনের নেই।


এদিকে সাবিনা ইয়াছমিন বিবার্তাকে জানান, অভিজ্ঞতা বিবেচনা করেই কলেজ আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। আমার কাম্য অভিজ্ঞতা আছে। আর কাগজপত্র যদি ঠিক না থাকে তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি আমাকে স্বপদে পুনর্বহালের আদেশ কীভাবে দিচ্ছে? আমার সকল কাগজপত্র ঠিক আছে দেখেই তো তারা নির্দেশ দিচ্ছে- কিন্তু কলেজ তা মানছে না।


ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. হাবিবুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, সাবিনা ইয়াছমিন কলেজে আসেন না, তাকে বরখাস্ত করা হলেও তার তো কলেজে আসার কথা। আর কলেজে না আসলে তাকে বেতন দেওয়া হবে কীভাবে?


এদিকে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাকুরির শর্তাবলি রেগুলেশনে উল্লেখ আছে, অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজের কোন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত বা অব্যাহতি প্রদানের পূর্বে অভিযুক্ত শিক্ষককে তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডন করিবার এবং বক্তব্য থাকিলে তাহা পেশ করিবার এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দান করিতে হইবে।



তদন্ত চলাকালীন সময়ে অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হইলে তাঁহাকে তাঁহার মূল বেতনের ৫০% অর্থ জীবন ধারণ ভাতা হিসাবে প্রদান করিতে হইবে। উল্লেখ্য, কোন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করিলে ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে বিভাগীয় কার্যধারা সম্পন্ন করিতে হইবে। যদি বিশেষ কোন কারণে ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে বিভাগীয় কার্যধারা সম্পন্ন না করা যায় তাহা হইলে সাময়িক বরখাস্তকৃত শিক্ষককে পূর্ণ বেতন প্রদান করিতে হইবে।


তবে শর্ত থাকে যে, পেশাগত অসদাচরণ অথবা নৈতিক স্খলনের অভিযোগের বিষয়টি গভর্নিং বডি কর্তৃক নিযুক্ত ৫ (পাঁচ) সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি দ্বারা তদন্ত করিতে হইবে।



সাবিনা ইয়াছমিন বিবার্তাকে জানান, কলেজ বলে আমার নামে মামলা আছে, কিন্তু আসলে মামলার কোনো আদেশ নাই। মামলা করলেই কারো চাকরি যায় না। মামলার আদেশ থাকতে হবে। আমাকে হয়রানি করার জন্য কলেজই একাধিক মামলা করেছে এবং ৬/৭টি তদন্ত হয়েছে। সবগুলি আমার পক্ষে মতামত দিয়েছে।


জানতে চাইলে সাবিনা ইয়াছমিন বিবার্তাকে বলেন, মো. হাবিবুল ইসলামের বক্তব্য শতভাগ মিথ্যা। বিগত ০৩/০৪/২০১৯ তারিখে সাময়িক বরখাস্ত পত্রে আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক উভয় পক্ষের শুনানিন্তে অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান হওয়ায় আমাকে স্বপদে পুনর্বহাল করার বিষয়ে একাধিক পত্রে নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা কলেজ কর্তৃপক্ষ অমান্য করে চলেছে। তারই প্রেক্ষিতে আমার পুনর্বহালের জন্য কলেজে সশরীরে উপস্থিত থেকে সভাপতি/অধ্যক্ষ বরাবর আবেদন করি, কিন্তু তারা এখনো পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেননি। তাছাড়া আমার সাময়িক বরখাস্ত আদেশটি সম্পূর্ণ অবৈধ ছিল, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১২/০৬/২০২৩ তারিখে তদন্তে প্রমাণিত।


তিনি বিবার্তাকে আরো জানান, আমাকে এপ্রিল ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত মূল বেতনের ৫০ ভাগ টাকা দেয়া হত। অক্টোবর ২০২২ হতে অদ্যবধি কোন বেতন দেয়া হয় না। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭(গ) ধারায় বলা আছে সাময়িক বরখাস্ত কাল ৬০ দিনের বেশি হলে তাকে শতভাগ বেতন ভাতাদি পরিশোধ করতে হবে।


সাবিনা ইয়াছমিন বিবার্তাকে বলেন, আইন অমান্য করে আমার চেয়ারে অন্য একজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে, এমনকি আমার কক্ষের দরজার উপরের নামফলকও ভেঙে ফেলা হয়েছে।


কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ দুটি পদই ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে চলছে। এই প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. হাবিবুল ইসলাম বিবার্তাকে জানান, নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুতই শুরু করা হবে।


উল্লেখ্য, সাবিনা ইয়াছমিনকে স্বপদে পুনর্বহাল প্রসঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় এই মর্মে যে, উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, অত্র কলেজের সাময়িক বরখাস্তকৃত উপাধ্যক্ষ জনাব সাবিনা ইয়াছমিন কর্তৃক দাখিলকৃত আবেদন নিষ্পত্তিকল্পে শুনানি অনুষ্ঠানে প্রদত্ত তার এবং অধ্যক্ষ জনাব মো. নওয়াব আলী-এর বক্তব্য, দাখিলকৃত কাগজপত্র, কলেজ পরিদর্শন শাখার সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনায় জনাব সাবিনা ইয়াছমিন, সাময়িক বরখাস্তকৃত উপাধ্যক্ষ, কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ, কুষ্টিয়া-এর বিষয়ে আনীত বিভিন্ন অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া তার কাম্যযোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার অভিযোগের বিষয়টি ইতোপূর্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিষ্পত্তি করে এবং তাকে স্ব-পদে পুনর্বহাল করা হয়। সার্বিক বিবেচনায় জনাব সাবিনা ইয়াছমিন-এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ভিত্তি না থাকায় তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারপূর্বক তাকে স্ব-পদে পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো।


সাবিনা ইয়াছমিনকে স্বপদে পুনর্বহালের নির্দেশনা কলেজ কর্তৃপক্ষ কেন আমলে নিচ্ছে না জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জজ কোর্টের পিপি ও কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি অ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী বিবার্তাকে বলেন, অল মেটার পেন্ডিং বিফর দ্য হাইকোর্ট, হাইকোর্টে সমস্ত ম্যাটার পেন্ডিং, উনার (সাবিনা ইয়াছমিন) চাকরিতে বহাল, অন্যান্য সকল বিষয় পেন্ডিং।


শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা প্রসঙ্গে অনুপ কুমার নন্দী বিবার্তাকে বলেন, আমাকে তো নির্দেশনা দেয়নি, আমি আসলামই একটা মিটিং করে কেবল, আমি তো এখনো কলেজের চেয়ারেই বসিনি। বিষয়টা আমার সামনে যখন আসবে আমি তখন জানব। তবে ওই মেটারগুলো পেন্ডিং এটা আমি জানি।


সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, আমাদের দিক থেকে তার (সাবিনা ইয়াছমিন) পক্ষে যা যা করণীয় সেটা করা হয়েছে, কলেজকে অবহিত করা হয়েছে, এটা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তাদের কতগুলো নিজস্ব যুক্তি আছে যে, উনি যখন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তখন প্রভাব খাটিয়ে এসেছেন।


আমরা তো একটা পত্র দেই, আদেশ দেই, অনুসরণ না করলে আমরা আবার আদেশ দেই, কিন্তু আমি তো পুলিশি কাজ করতে পারবো না। আমাদের পক্ষে যা করণীয় তা করা হয়েছে, এরপর রয়েছে পুলিশি কাজ, যেটা আমার এরিয়া না।


যদি কলেজ কর্তৃপক্ষ না শোনে, সেক্ষেত্রে একজন ভুক্তভোগী শিক্ষকের কী করার থাকে? তার আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। আমাদের পক্ষে যা যা করণীয়, করে দিয়েছি।


বিবার্তা/এসবি/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com