প্রাণের বইমেলা: শঙ্কায় প্রকাশকরা, বইপ্রেমী পাঠকও কি থাকবেন চিন্তামুক্ত?
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৩১
প্রাণের বইমেলা: শঙ্কায় প্রকাশকরা, বইপ্রেমী পাঠকও কি থাকবেন চিন্তামুক্ত?
সানজিদা আক্তার
প্রিন্ট অ-অ+

চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় এবারের বইমেলায় কাটতি কম হবে বলে আশঙ্কা করছেন প্রকাশক, বইপ্রেমী পাঠকসহ সংশ্লিষ্ট মহল। দেশে গত এক যুগে যে হারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, সেই হারে সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি- যদিও আয় বেড়েছে।  


লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের মহামিলন ঘটে অমর একুশে বইমেলায়। গত দুই বছর করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক টানাপোড়নের মধ্যে অমর একুশে বইমেলা হয়েছে। ওই দুইবছর চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন প্রকাশকরা।   


একটি ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক আলী আসিফ শাওন যিনি প্রচুর নতুন বই ও ম্যাগাজিন কিনতে পছন্দ করেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমি প্রতিমাসে একহাজার টাকার উপরে ম্যাগাজিন কিনতাম। প্রায়ই নতুন বই সংগ্রহ করতাম। এই মাস থেকে ম্যাগাজিন কেনাটা বন্ধ করে দিয়েছি। বিষয়টা ব্যয় সংকোচনের। বইমেলায় আগের মত বই কিনতে পারব বলে মনে হয় না। কারণ মোটামুটি সব বইয়েরই দাম বেড়ে গেছে বলেও জানান তিনি।


সমাজকর্মী এইচ এম মারুফ বিল্লাহ অর্থনৈতিক মন্দাকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বই না কেনাকে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। মন্দার হাত থেকে নিস্তার পায়নি ছোট-বড় ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য পেশার লোকজনও।


রেজাউল কবির নামের আরেকজন পাঠকও মারুফ বিল্লাহের মতো একই আশঙ্কা ব্যক্ত করে বিবার্তাকে বলেন, বইয়ের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে পাঠক কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।



অর্থনৈতিক মন্দা বইমেলায় বিরাট প্রভাব ফেলবে মন্তব্য করে নালন্দা  প্রকাশন-এর প্রকাশক রিদওয়ানুল রহমান বিবার্তাকে বলেন, ডলার সংকট ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট পরিমাণে কাগজের কাঁচামাল কিনতে পারছেন না। ফলে কাগজের দামও বেড়েছে। তাছাড়া প্রিন্টি, বাইন্ডিং ও প্যাকেজিং খরচও বেড়েছে। যার জন্য সব মিলিয়ে বইয়ের দামও বেড়েছে অন্য বছরের তুলনায়। 



বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি ও পুথিনিলয় প্রকাশনীর প্রকাশক শ্যামল পাল বিবার্তাকে বলেন, করোনার জন্য যেই অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হয়েছে তার বিশাল প্রভাব পড়বে এবারের বইমেলায়। কাগজের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় বইয়ের দামও বেড়েছে। 


‘আমরা প্রকাশকরা চিন্তায় আছি। বেছে বেছে বই প্রকাশ করছি। প্রাণের বইমেলা হলো আমাদের জ্ঞানের বাতিঘর। আশা করছি বই ভালোই বিক্রি হবে,’ তিনি বলেন।


কাগজের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বইয়ের দাম ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাগজের দাম দ্বিগুণ হলেও সেই অনুপাতে বইয়ের দাম বাড়ানো হবে না। প্রকাশক ও বিক্রেতা উভয়ে মিলে আমরা আলোচনা করে এ বছরের বইয়ের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে জানান তিনি।


২০২২ সালে করোনা মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ের পরে বইমেলা শুরু হওয়াতে ওই বছর প্রায় সাড়ে ৫২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমির বই বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকার। ওই মেলায় মোট বই প্রকাশ হয়েছে ৩ হাজার ৪১৬টি। 


করোনা মহামারির কারণে ২০২১-২০২২ সালে অমর একুশে বইমেলায় আশানুরূপ বই বিক্রি হয়নি বলে জানান প্রকাশকরা। প্রকাশনা শিল্পের মালামালের ঊর্ধ্বগতি প্রকাশকদের আবার দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে টানা দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই। 


গত ২১ নভেম্বর বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশকদের সংগঠন সৃজনশীল প্রকাশক ঐক্য থেকে অনুপম প্রকাশনীর প্রকাশক মিলন নাথ সরকারি প্রণোদনা দাবির পাশাপাশি আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির স্টল ভাড়া কমানোর দাবি করেন। কাগজের অস্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে দেশের প্রকাশনা শিল্প বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে লিখিত বক্তব্যে মিলন নাথ বলেন।


অন্যদিকে, গত ২৬ নভেম্বর বিকেলে বাংলাদেশ লেখক পাঠক প্রকাশক পরিষদ রাজধানীর কাঁটাবনে পাঠক সমাবেশে ‘কাগজের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটে প্রকাশনা শিল্প: একুশে বইমেলা ২০২৩ নিয়ে আমাদের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে অমর একুশে বইমেলায় স্টল ভাড়া সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করার দাবি জানান।


বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাবেক সভাপতি এবং আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি  স্টলের ভাড়া কমানোর পক্ষে কথা বলেন। 



খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মুদ্রণের খরচ অনেক বেড়েছে। সাধারণত ৮০ গ্রাম ডাবল ডিমাই অফসেট কাগজে বই ছাপা হয়। গত বছর এর দাম ছিল ২ হাজার ২০০ টাকা রিম, এখন তা ৩ হাজার ৭০০ টাকা। ১০০ গ্রাম কাগজের দাম ছিল ২৬০০ টাকা, বর্তমানে ৪৫০০ টাকা।



করোনা অতিমারির পর মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ শুরু করতে যাচ্ছে বাংলা একাডেমি। এবারে বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। পহেলা ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সশরীরে উদ্বোধনের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা।


বাংলা একাডেমির প্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক এবং অমর একুশে বইমেলার সদস্যসচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিবার্তাকে  জানান,  বইমেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদাকে সভাপতি করে ৩১ সদস্যের কমিটি হয়েছে। কমিটি নানা বিষয়ে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।


বাংলাদেশ শিল্পীকল্যাণ ট্রাষ্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসীম কুমার দে-কে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি কপিরাইট আইন ও বইমেলা নীতিমালার প্রতিপালন পর্যবেক্ষণ এবং কপিরাইট আইন ও বইমেলা নীতিমালা লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও জানান তিনি।


সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ গত সোমবার বিকালে বইমেলার প্রস্তুতি সরেজমিন দেখার পর প্রথম দিন থেকেই টাস্কফোর্স যেন সঠিকভাবে বিষয়গুলো মনিটরিং করে, সেই বিষয়ে কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। 


২০২২ সালের বইমেলায় আগে যেখানে প্রধান প্রবেশ পথ ছিল, সেটি এবার প্রস্থানের জন্য রাখা হয়েছে। মূল প্রবেশদ্বার রাখা হয়েছে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে। মন্দিরের প্রবেশদ্বার দিয়ে ক্রেতা-দর্শনার্থীরা মেলায় প্রবেশ করবে।


এবারের বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে মোট ৪৭০টি প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকছে। এরমধ্যে ৩৬৭টি সাধারণ প্রতিষ্ঠান। শিশু চত্বরে থাকছে ৬৯টি প্রতিষ্ঠান। প্যাভেলিয়ন থাকছে ৩৪টি। অন্যদিকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সাধারণ প্রতিষ্ঠান ১০৩টি ও প্যাভেলিয়ন আছে ১৪৭টি। সবমিলিয়ে ৫৭৩টি প্রতিষ্ঠান এবং সর্বমোট ৭০৪ টি (প্যাভেলিয়ন বাদে) স্টল থাকছে। মূল গেট থেকে ঢুকতেই শিশু চত্বর পাওয়া যাবে। সেখানে সিসিমপুরসহ শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য নানা আয়োজন থাকবে।


বইমেলার শেষদিন ২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণগত মানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থের মধ্য থেকে দেয়া হবে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’। এছাড়া প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য দেয়া হবে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’।


প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচার করে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ দেয়া হবে সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে।


এর বাইরে ২০২৩ সালে অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানকে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে।


বিবার্তা/সানজিদা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com