টাঙ্গাইলে দুই বছরেও শেষ হয়নি ব্রিজের কাজ, জনদুর্ভোগ চরমে
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:১২
টাঙ্গাইলে দুই বছরেও শেষ হয়নি ব্রিজের কাজ, জনদুর্ভোগ চরমে
ইমরুল হাসান বাবু, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

দুই বছরেও শেষ হয়নি টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের ব্রিজ নির্মাণ কাজ। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় জনসাধারণ। চরম ভোগান্তি সত্ত্বেও প্রভাবশালী ওই নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহসও পাচ্ছেন না স্থানীয়রা।


এদিকে নির্মাণ কাজের সময় নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তবে রহস্যজনক কারণে নীরব ব্রিজ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।


জানা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের বেগুনটাল খালে নির্মাণাধীন ওই ব্রিজের কাজটি করছেন মো. তোফাজ্জল হোসেন খান তোফা। তিনি টাঙ্গাইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের টানা দুইবারের সাধারণ সম্পাদক ও হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদের দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান।


বাসাখানপুর বাজার হুগড়া ইউপি ভায়া বেগুনটাল বাজারের খালের উপর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ খান এর নামে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৭৫ টাকা ব্যায়ে ৫০ মিটার গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ কাজের টেন্ডার দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), টাঙ্গাইল। ব্রিজ নির্মাণের কাজটি পায় ‘মেসার্স কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালের ৫ জুলাই নির্মাণ কাজ শুরু আর ২০২১ সালে ৪ এপ্রিল সমাপ্তির সময়সীমা বেঁধে দেয় এলজিইডি।


স্থানীয়দের অভিযোগ, বেগুনটাল ব্রিজটি নির্মাণে দীর্ঘ সময় লাগায় চরম সমস্যায় রয়েছেন তারা। এই ব্রিজ হয়ে যমুনা নদী পথে সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর, টাঙ্গাইলের কাকুয়া ও কাতুলী ইউনিয়নের তোরাবগঞ্জসহ ইউনিয়নের পূর্ব হুগড়া, চক গোপাল, সাতানি হুগড়া, ধুলবাড়ী, কচুয়া, বারবয়লা, মহেশপুর, গইরাগাছা, মালতিপাড়া, আনাহলা, চিনাখালী, গন্ধবপুর, বইরাপাড়া, ভাঙ্গাবাড়ী, নরসিংহপুর, গোপাল কেউটিসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করেন। ব্রিজ না থাকায় প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যাত্রীরা।


সরেজমিন দেখা গেছে, ব্রিজটির নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় রীতিমত বন্ধ রয়েছে ট্রাক, বাসসহ বিভিন্ন ধরণের বড়গাড়ি পারাপার। চলাচলে সুবিধায় ব্রিজের নিচে বিকল্প পথ হিসেবে করা হয়েছে ডাইভারশন। ওই ডাইভারশন সড়ক দিয়ে সিএনজি, ব্যাটারিচালিক অটোরিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল আর পায়ে হেঁটে মানুষ চলাচল করতে পারছেন। তবে ডাইভারশনটি মূল সড়ক থেকে অনেকটা নিচু হওয়ায় বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যাওয়াসহ শুষ্ক মৌসুমে পারাপারে চরম সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।


ভুক্তভোগী ও স্থানীয় ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন বিবার্তাকে বলেন, এই ইউনিয়নের পশ্চিমাংশের যমুনা নদীর তীরবর্তী কাকুয়া ও কাতুলীর তোরাবগঞ্জসহ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম এই ব্রিজ। ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. তোফাজ্জল হোসেন তোফা এর ঠিকাদার। এরপরও দুই বছরে শেষ হয়নি ব্রিজটির নির্মাণ কাজ। ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে ব্রিজটির কাজ সম্পন্ন হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।


শাহ জামাল হোসেন বিবার্তাকে বলেন, দুই বছরের বেশি সময় গেলেও ব্রিজটি নির্মাণ হয়নি। এর ফলে চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন তারা। ব্রিজের ঠিকাদার ও ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গত নির্বাচনে হেরে যাওয়াসহ গ্রামে না আসায় ব্রিজটির কাজ হচ্ছে না বলে ধারণা করছেন তিনি।


তিনি আরো বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান এলাকাবাসীর আস্থাভাজন। ঠিকাদার যে কোন প্রক্রিয়ায় ব্রিজটির কাজ শেষ করবেন এমন বিশ্বাসেই কোন দফতরে অভিযোগ বা যোগাযোগ করেননি।


ভ্যানচালক মহর আলী বিবার্তাকে বলেন, হুগড়া নির্মাণাধীন মসজিদের কাজের জন্য দশ বস্তা সিমেন্ট নিয়ে যাচ্ছি। ডাইভারশন দিয়ে অনেক কষ্ট করেও রাস্তায় উঠতে পারছিলাম না। স্থানীয় কয়েকজন যুবক আমাকে সাহায্য করে উপরে উঠিয়ে দিছে। এভাবে দুই বছর যাবৎ মালামাল আনা-নেয়া করছি।


তিনি বলেন, কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, ব্রিজের ঠিকাদার হচ্ছেন আমাদের সাবেক চেয়ারম্যান। উনাকে কাজ শেষের জন্য তাগাদা দিলে বলেন শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে, এরপর শেষ হয় না।


ঠিকাদাররা জানায়, ব্রিজের কাজে তিন বছর সময় নেয়া হয়েছে। শুরুতে কিছু কাজ হলেও বন্যার আগ কাজ একবারে বন্ধ। এ সময় ব্রিজের অনেক মালামাল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা। তবে বর্তমান চেয়ারম্যান ব্রিজের কাজ শেষ করে মালামাল নেয়ার কথা বলে বাঁধা দেন।


ব্রিজের রড মিস্ত্রির সহযোগী হৃদয় সরকার বিবার্তাকে বলেন, সেন্টারিংয়ের কাঠ আর রড না থাকায় ব্রিজের কাজ বন্ধ রয়েছে। ঠিকাদার রড পাঠাব পাঠাব বললেও রড আসছে না।


ব্রিজ নির্মাণের সময়সীমা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য সানোয়ার হোসেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ব্রিজ নির্মাণের জন্য পাঁচ বছর সময় নির্ধারণ করা হয়েছে বলে ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়েছে।


টাঙ্গাইল সদর উপজেলা এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী তোরাব আলী বিবার্তাকে বলেন, কাগজ কলমে কাজটির ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ হলেও ব্রিজের কাজ করছেন হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. তোফাজ্জল হোসেন খান তোফা, বাপ্পি ও মাহাবুব নামের কয়েকজন ঠিকাদার। ব্রিজের মূল কাজের মধ্যে দুটি স্লাব বাদ রয়েছে। তবে এরই মধ্যে পিলার, পাইল ও একটি স্লাবের কাজ শেষ হয়েছে। এখন থেকে টানা কাজ করলে এপ্রিল মাসের মধ্যে কাজটি শেষ করা সম্ভব হবে।


সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. তোফাজ্জল হোসেন খান তোফা বিবার্তাকে বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে বেগুনটাল ব্রিজ নির্মাণের কাজটি করছি। ব্যক্তিগত কারণে আর সময় ঠিকমত না দিতে পারায় ব্রিজের কাজটি সঠিক সময়ে শেষ করা যায়নি। ব্রিজের তিনটি স্লাবের মধ্যে একটির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি দুটি স্লাব দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে বলে জানান তিনি।


ব্রিজটি নির্মাণ না হওয়ায় এলাকাবাসীর চরম ভোগান্তির কথা স্বীকার করেছেন হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যন মো. নূরে আলম তুহিন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ব্রিজের কাজ শেষ না করাসহ বিকল্প ডাইভারশন ব্যবস্থা না করায় মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠায় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমি দুই দফা কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করে দিয়েছি। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে ব্রিজের নিচ দিয়ে মাটি ফেলে বিকল্প ডাইভারশনও করে দিয়েছি।


তিনি আরো বলেন, জনগণের ভোগান্তির বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্যকে জানানো হয়েছে। তিনি আগামী বর্ষার আগেই ব্রিজটির কাজ শেষ করার জন্য এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিবেন বলে জানিয়েছেন।


স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বিবার্তাকে জানান, এই প্রজেক্টের ফান্ড সংকট থাকায় ব্রিজ নির্মাণের কাজ সময় মত শেষ করা যায়নি। পুনরায় সময়সীমা বৃদ্ধি করাসহ ফান্ড দেয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী দুই মাসের মধ্যেই কাজটি শেষ হবে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মো. ছানোয়ার হোসেন বিবার্তাকে জানান, রড, সিমেন্টসহ কাজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ প্রজেক্টে ফান্ড না থাকার অজুহাত দেখাচ্ছেন ঠিকাদাররা। এ কারণে আমি চলতি অর্থ বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদ দেয়াসহ ঠিকাদারদের কাজ শেষ করতে না পারলে অফিসকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সারেন্ডার করতে বলে দিয়েছি। সারেন্ডারকারী ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে সরকার নিয়ম অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


বিবার্তা/রোমেল/জামাল

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com