শিরোনাম
সঙ্কটকালেও প্রশংসা কুড়াচ্ছে নার্সিং অধিদফতর
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:৫৫
সঙ্কটকালেও প্রশংসা কুড়াচ্ছে নার্সিং অধিদফতর
খলিলুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

সেবা ও মানবিকতা দিয়ে করোনা মহামারির সঙ্কটকালেওপ্রশংসা কুড়াচ্ছে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতর। স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে সারাদেশে একদিকে চলছে নার্সিং সেবা কার্যক্রম, অন্যদিকে চলছে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নার্সিং কর্মকর্তাদের আরো দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের প্রচেষ্টা। আর এই কার্যক্রমে গতি আনতে কোভিড ঝুঁকিতেও সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সিদ্দিকা আক্তার। কোভিড সংক্রমণের শুরুতে অধিদফতরের দায়িত্ব নিয়ে তিনি সারাদেশের নার্সিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো ও বিরাজমান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।


২০২০ সালের মার্চের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর সারাদেশে সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। করোনা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িতদের মাঝেও তৈরি হয় অজানা আতঙ্ক। অদেখা ভাইরাস আতঙ্কে মানুষ হয়ে পড়েন ঘরবন্দি। এই অবস্থায় দেশের নার্সদের সাহস ও উৎসাহ যোগাতে বিশেষ উদ্যোগ নেন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার। কোভিড আক্রান্তদের সেবায় ভীতি কাটাতে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে নার্সিং কর্মকর্তাদের মধ্যে সাহস যোগান। নার্সিং পেশায় বিরাজমান নানা সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে তাদেরকে উৎসাহ দেন। করোনাকালীন সময়ে এর ইতিবাচক ফলও মিলে।


২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহাপরিচালক হিসেবে যোগদানের পর সিদ্দিকা আক্তার ১০ হাজার নার্সের পদ সৃজনসহ ৫ হাজার ৭৫ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ প্রদান এবং শূণ্যপদসহ আরো ৮ হাজার ২৮৮ জন নার্সের পদায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্নের উদ্যোগ নেন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজার মিডওয়াইফের পদ সৃষ্টির প্রস্তাবনা পাঠান ও ১ হাজার ৪০১ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। অধিদফতরের কার্যক্রমে আরো গতি আনতে উদ্যোগ নেয়া হয় প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের। করোনা মহামারিকালেও মহাখালীতে অতিদ্রুত সম্পন্ন করা হয় অধিদফতরের নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ। গেল বছরের জুন থেকে নিজস্ব নতুন ভবনে শুরু হয়েছে অধিদফতরের কার্যক্রম। স্থাপন করা হয়েছে বেবি কর্ণারসহ ৩শ’ সিটের অত্যাধুনিক ডিজিটালাইজড অডিটোরিয়াম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নার্সিংয়ের প্রবক্তা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের মূর‌্যাল ও বঙ্গবন্ধু কর্ণার। ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে অধিদফতরের আওতাধীন সকল নার্স, মিডওয়াইফ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনলাইন ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। শক্তিশালী ও জোরদার করা হয়েছে ই-নথি কার্যক্রম।


সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গেল প্রায় দুই বছরে করোনার কারণে যেখানে বেশিরভাগ সরকারি অফিসের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে সেখানে গতি বেড়েছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের। করোনার ভয়াবহ প্রকোপের সময় নার্সিং কলেজ ও ইন্সটিটিউটে কর্মরত শিক্ষক ও প্রেষণে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের ছুটি বন্ধ রেখে তাদেরকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পদায়ন করা হয়।


অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশের নার্সিং শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে করোনাকালীন সময়েও বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। নার্সিং শিক্ষায় একই মান বজায় রাখতে সকল সরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠানে একই মানের অধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া ১৩টি নার্সিং কলেজের পূর্ণাঙ্গ জনবলের পদ সৃষ্টির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নার্সিং শিক্ষার প্রসারে ২০২০ সালের চেয়ে নার্সিংয়ে ৪ হাজার ৩০৫ ও মিডওয়াইফে ২ হাজার ১৩৫টি ভর্তির আসন বৃদ্ধি করা হয়েছে। নার্সিংয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়েনারে ৬০টি আসন বৃদ্ধিসহ সরকারি আরো ১০টি নার্সিং কলেজে এমএসসি নার্সিং, ৫টিতে ২ বছর মেয়াদী পোস্ট বেসিক নার্সিং ও ৪টিতে পোস্ট বেসিক বিএসসি মিডওয়াইফারি চালুর প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে।


দেশে বিদ্যমান নার্সিং কলেজ ও ইন্সটিটিউটের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের ৭টি নার্সিং কলেজের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে একটি আধুনিক নার্সিং কলেজ। দেশের যে ৯টি জেলায় এখনো সরকারি নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, সেসব জেলায় কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে নার্সিং অধিদফতর। এছাড়া পিপিপি এর আওতায় ঢাকার মহাখালীতে ইউনিভার্সেল নার্সিং কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।


বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন (বিএনএ) সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইসরাইল আলী সাদেক বিবার্তাকে বলেন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার দায়িত্ব নেয়ার পর করোনা সঙ্কটকালীন সময়েও বেশি গুরুত্ব দেন দেশের নার্সদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে। সেই লক্ষ্যে তিনি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকেও বিকেন্দ্রীকরণ করেন। আগে যেসব প্রশিক্ষণ ঢাকায় হতো, সেসব প্রশিক্ষণ বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজনের উদ্যোগ নেন। করোনাকালীন সময়ে দেশের ১১টি প্রশিক্ষণ ভ্যেনুতে ৪৮০ জন নার্সকে ২৮ দিনব্যাপী আইসিইউ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আরো ১২শ’ জনকে একই প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ চলমান রয়েছে। পেশাগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় ৩ হাজার নার্সকে ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণ এবং ৮শ’ নার্স ও মিডওয়াইফকে ‘ইনফেকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল’ এর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ২০২০-২১ অর্থ বছরে অপারেশনাল প্লানের অধীনে ১২শ’ নার্সকে আইসিইউ, ৬শ; জনকে আইপিসি, ২১০ জনকে পেডিয়াট্রিক, ৯ হাজারকে ফাউন্ডেশন, ১৬০ জনকে ইংরেজি ভাষা, ১২০ জনকে কম্পিউটার, ১২০ জনকে অর্থ ব্যবস্থাপনা, ১২০ জনকে গেরিয়াট্রিক নার্সিং প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নার্সিং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ইতোমধ্যে ২৫০ জনকে টিচিং মেথোডোলজি প্রশিক্ষণ দিয়ে পদায়ন ও দক্ষ শিক্ষক সমস্যা সমাধানে আরো ৮শ’ শিক্ষককে পদায়ন ও প্রশিক্ষণের কাজ চলমান রয়েছে। মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে ৫০-৬০ জন শিক্ষককে বিদেশ প্রশিক্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।


বিএনএ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সভাপতি শাহাদাতুন নূর লাকি বিবার্তাকে বলেন, দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কার্যক্রমে সমতা আনার লক্ষ্যে অভিন্ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। দক্ষ শিক্ষক গড়ে তুলতে জাতীয় পর্যায়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ কলেজ নির্মাণের প্রস্তাব করেছে অধিদফতর। প্রস্তাব করা হয়েছে স্বতন্ত্র নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ইউনিভার্সিটি স্থাপনের। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে স্টাইপেন্ড বৃদ্ধিসহ প্রতি বছর কৃতি ৩ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেয়ার প্রথা চালু করা হয়েছে। গেল দুই অর্থবছরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ২ জনকে দক্ষিণ কোরিয়া, ৩ জনকে থাইল্যান্ড ও ১ জনকে জাপানে পাঠানো হয়েছে। দেশের প্রতিটি নার্সিং কলেজে অত্যাধুনিক ভার্চুয়াল সিম্যুলেশন ল্যাব স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া ৩২ জন মিডওয়াইফকে সুইডেনের ডালার্না ইউনিভার্সিটির অধীনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি গবেষণা কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করতে অধিদফতরে চালু করা হয়েছে রিসার্চ শাখা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১ম শ্রেণির শূণ্যপদ পূরণের লক্ষ্যে ১৯০ জনের একটি পদোন্নতি তালিকা পাবলিক সার্ভিস কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।


বিএনএ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, কোভিড ভয়াবহতার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার। নার্সদের সাহস যোগাতে তিনি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোও পরিদর্শন করেন। তাদেরকে দেন নানা দিকনির্দেশনা। অসুস্থ নার্সিং কর্মকর্তাদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের ভাতা, কোভিডকালীন কর্মরত নার্সিং কর্মকর্তাদের জন্য প্রণোদনা ও কোয়ারেন্টাইন ভাতা দ্রুত পরিশোধের উদ্যোগ নেন তিনি। এতে দেশের নার্সদের মধ্যে আস্থা তৈরির পাশাপাশি উদ্দিপনাও বাড়ে। সিদ্দিকা আক্তার দায়িত্ব নেয়ার পর সরাসরি সাক্ষাতকারের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত কর্মস্থলে বদলি হয়েছেন ৩ হাজার ৯৪ জন নার্স। আইসিইউ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ২ হাজার ৩৪ জন এবং নার্স ও মিডওয়াইফ শিক্ষক হিসেবে পদায়িত হয়েছেন ২৫০ জন। বদলি বাণিজ্য ও দালালদের দৌরাত্মের যে বদনাম ছিল বর্তমান মহাপরিচালকের সময়ে সেই কলঙ্কমুক্ত হয়েছে অধিদফতর- এমন দাবি নার্সিং কর্মকর্তাদের।


বিবার্তা/খলিল/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com