শিরোনাম
ঢাবির ২ বইয়ের সম্পাদনা ব্যয় ২০ লাখ, যেখানে বাংলা একাডেমির সর্বোচ্চ ৪০ হাজার!
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২১, ১৭:২৯
ঢাবির ২ বইয়ের সম্পাদনা ব্যয় ২০ লাখ, যেখানে বাংলা একাডেমির সর্বোচ্চ ৪০ হাজার!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৫টি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এসব গ্রন্থের মধ্যে দু’টি গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো আর্থিক বিধি-বিধান না মেনে অর্থ ব্যয়ে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। প্রকাশিতব্য এ দু’টি গ্রন্থের সম্পাদনায় জড়িত দুই সম্পাদক/পরিচালকের জন্য বরাদ্দ ৯ লাখসহ সম্পাদনায় মোট ব্যয় করা হয়েছে ২০ লাখের অধিক টাকা। অথচ বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতি গ্রন্থ সম্পাদনায় সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের অনুষ্ঠান ঘিরে গ্রন্থ প্রকাশের এই আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট মহলে।


সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৫টি গ্রন্থ প্রকাশের খাতওয়ারী বাজেট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের। এগুলোর মধ্যে ক্রমিক নং ৫ এবং ক্রমিক নং ৬ -এ উল্লেখিত দুটি গ্রন্থের জন্য সম্পাদক ও সম্পাদনা সহযোগীদের সম্মানীসহ অন্যান্য খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো আর্থিক বিধি-বিধান মানা হয়নি।



বিবার্তা২৪ ডটনেটের হাতে আসা প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ক্রমিক ৫ এ উল্লেখিত History of Dhaka University গ্রন্থের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন প্রাক্তন অধ্যাপক ড. শরিফ উদ্দিন আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন এই অধ্যাপক বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। এ গ্রন্থ সম্পাদনার জন্য তার সম্মানী বরাদ্দ করা হয়েছে তিন লাখ টাকা এবং সম্পাদনা সহযোগী সম্মানী ২ জনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে দুই লাখ টাকা এবং এসিস্ট্যান্ট /খণ্ডকালীন রিসার্চ সহকারীর সম্মানী ধরা হয় ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।


এখানে শেষ নয়, এই গ্রন্থের সম্পাদনা পরিষদের সদস্যদের সম্মানী মিটিং বাবদ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এছাড়া টাইপিং ব্যয় ১ লাখ, সেমিনার/ওয়ার্কশপ ব্যয় ১ লাখ, প্রুফ রিডিং সম্মানী দেড় লাখ, ল্যাঙ্গুয়েজ এডিটিং ৫০ হাজার, মুদ্রণ ও বাধাঁই (১০০০ কপি) ১৭ লাখ ১৫ হাজার এবং বিবিধ খাতে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই বইয়ের সম্পাদনাসহ অবশিষ্ট কাজে মোট বরাদ্দ হয়েছে ৩২ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এই গ্রন্থের লেখকদের সম্মানী বাবদ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এই গ্রন্থের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকা- যা নজিরবিহীন।



অন্যদিকে, ক্রমিক ৬ এ উল্লেখিত The Role of Dhaka University in Making and Shaping Bangladesh নামক গ্রন্থের সম্পাদক/পরিচালক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমিরেটাস অধ্যাপক প্রফেসর ড. এ.কে আজাদ চৌধুরী। তাকে এ গ্রন্থটি সম্পাদনা পরিচালনার জন্য সম্মানী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬ লাখ টাকা এবং সম্পাদনা সহযোগী ২জনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে দুই লাখ চল্লিশ হাজার টাকা। এছাড়া প্রুফ রিডিং ব্যয় ৫৫ হাজার, রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট সম্মানী ২০ হাজার, তথ্য সংগ্রহ ব্যয় ১০ হাজার, টাইপিং ব্যয় ৩০ হাজার, শিক্ষাসামগ্রী ব্যয় ৮৯ হাজার, অনুবাদ ব্যয় ১২ হাজার, মুদ্রণ ও বাধাঁই (১০০০ কপি) ১০ লাখ ৭৮ হাজার, এবং বিবিধ খাতে ৩১ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। অর্থাৎ এই গ্রন্থের সম্পাদনাসহ অবশিষ্ট কাজে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এই গ্রন্থের লেখকদের সম্মানী বাবদ ( প্রভোস্ট ব্যতীত) ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এই গ্রন্থের জন্য মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।


অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিতব্য এই দুইটি গ্রন্থের জন্য লেখক সম্মানী বাদে শুধু সম্পাদনাসহ অবশিষ্ট কাজে ব্যয় হয়েছে ৫৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা। আর লেখক সম্মানীসহ ধরলে এটার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা।


শুধু সম্পাদনের কাজের ব্যয় হিসাব করলে ক্রমিক নং ৫ বইয়ের ব্যয় হিসাব দাঁড়ায়, সম্পাদনা সম্পাদক সম্মানী ৩ লাখ, সম্পাদনা সহযোগী সম্মানী ২ লাখ এবং এসিস্ট্যান্ট /খন্ডকালীন রিসার্চ সহকারীর সম্মানী ৩ লাখ ৬০ হাজার, গ্রন্থের সম্পাদনা পরিষদের সদস্যদের সম্মানী মিটিং বাবদ ১ লাখ ৯২ হাজার, সেমিনার/ওয়ার্কশপ ব্যয় ১ লাখসহ মোট ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকা।



ক্রমিক ৬ নং বইয়ের শুধু সম্পাদনার কাজের ব্যয় হিসাব করলে দেখা যায়, সম্পাদনা পরিচালনার সম্মানী ৬ লাখ, সম্পাদনা সহযোগী বরাদ্দ ২ লাখ ৪০ হাজার, রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট সম্মানী ২০ হাজার, তথ্য সংগ্রহ ব্যয় ১০ হাজারসহ মোট ব্যয় ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা।


অর্থাৎ এ দুই গ্রন্থে শুধু সম্পাদনা সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যয় হয়েছে ২০ লাখ ২২ হাজার টাকা।


তথ্য -উপাত্ত পর্যালোচনায় আরো জানা যায়, গত অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভাপতিত্বে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত সাব কমিটিসমূহের আহ্বায়ক /সদস্য সচিব কর্তৃক প্রদত্ত খাতওয়ারী বাজেট অনুমোদনের বিষয়টি আলোচনায় আসে আর সেখানে নিয়মের তোয়াক্কা না করে গ্রন্থ প্রকাশনার সাথে জড়িতদের অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়।


এরপর গ্রন্থ সম্পাদনার এ ব্যয়কে অস্বাভাবিক মনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বরাবর গত ১১ই অক্টোবর চিঠি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) এবং ফাইন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ।


বিবার্তা২৪ডটনেটের হাতে আসা সেই চিঠিতে দেখা যায়, ড. সামাদ বলেছেন, গ্রন্থ প্রকাশের বরাদ্দের অসঙ্গতি সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক, এক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম এবং বিধি-বিধানের ব্যতয় ঘটেছে। বরাদ্দ ন্যায় ও সমতাভিত্তিক হওয়া উচিত।


চিঠিতে তিনি গ্রন্থ প্রকাশের বিষয়ে অনিয়মের বর্ণনা দিয়ে নিজের বক্তব্যও স্পষ্ট করেছেন। বক্তব্যে ড. সামাদ বলেন, বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন থেকে প্রদত্ত বরাদ্দ সরকারী টাকা (Public money)। সুতরাং সরকারী টাকা রাষ্ট্র/ সরকারের বিধি বিধান মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যয় করা উচিত। বাজেট বরাদ্দের ন্যায় ও সমতাভিত্তিক না হওয়ায় আমি দ্বি-মত পোষণ করছি এবং এসব বিষয়ে আমার ওপর কোনো দায়-দায়িত্ব বর্তাবে না।


তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ।



পরে গ্রন্থ সম্পাদনার অস্বাভাবিক ব্যয়ের এই বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে বিবার্তা২৪ডটনেট। দেশের জনপ্রিয় এ অনলাইন পোর্টাল গ্রন্থ সম্পাদনার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির কাছে তাদের গ্রন্থ সম্পাদনার সর্বোচ্চ খরচ সম্পর্কে জানতে চায়।


এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক মো. মোবারক হোসেন বিবার্তাকে বলেন, আমাদের সম্পাদনা নানা রকমের আছে। সম্পাদনা পরিষদ থেকে যেমনটি থাকে। এটা একেক বইয়ের জন্য একেক রকম হয়ে থাকে। তবে সাধারণত আমরা সম্পাদনায় সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে থাকি। যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে দিয়েও বই এডিট করালে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা সম্মানি দেয়া হয়।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, এটা কাজের ভলিউমের ওপর নির্ভর করে। নির্দিষ্ট কোনো রেট নেই। যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোষ বইয়ের সম্পাদক মাসে ৪০ হাজার টাকা পেতেন। এটা কখনো ৪৫ হাজার হয়েছে। তবে কখনো ৫০ হাজার এখনো হয়নি। এটা প্রজেক্টের ক্ষেত্রেও হয়, আবার একক গ্রন্থের ক্ষেত্রেও হয়।


একক গ্রন্থ সম্পাদনার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা সম্মানি দিচ্ছেন আপনারা কত সম্মানি দিচ্ছেন প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরাও সর্বোচ্চ এরকম-ই দিচ্ছি। আর সর্বনিম্ন ২০ এর মতো।



বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থ সম্পাদনার বক্তব্য প্রায় একই। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমিক ৫ এ উল্লেখিত History of Dhaka University গ্রন্থের সম্পাদনা সম্পাদক অধ্যাপক (অব:) ড. শরিফ উদ্দিন আহমেদকে দেয়া হয়েছে তিন লাখ টাকা এবং ক্রমিক ৬ এ উল্লেখিত The Role of Dhaka University in Making and Shaping Bangladesh নামক গ্রন্থের জন্য সম্পাদনা পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমিরেটাস অধ্যাপক প্রফেসর ড. এ.কে আজাদ চৌধুরীর জন্য সম্মানী বরাদ্দ করা হয়েছে ৬ লাখ টাকা।


এ বিষয়ে জানতে প্রফেসর ড. এ.কে আজাদ চৌধুরীকে বিবার্তার পক্ষ থেকে ফোন দেয়া হয়। কয়েকবার ফোন রিসিভ হলেও তার দিক কোন কথা শোনা যায়নি। ফলে এ বিষয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।


এদিকে অধ্যাপক (অব:) ড. শরিফ উদ্দিন আহমেদকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।


সার্বিক বিষয়ে জানতে বিবার্তার পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে ফোন দেয়া হয়।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের দুই বইয়ে সম্পাদনা সম্মানী ২০ লাখের বেশি হওয়ার বিষয়ে তিনি বিবার্তাকে বলেন, নিয়মের মধ্যে যেভাবে হয়, যে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে হয় সেভাবে হয়েছে।



বিবার্তা/রাসেল/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com