ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে জনগণকে জিম্মি করে ধর্মঘট ডেকে ভাড়া বাড়িয়েছেন পরিবহনমালিকরা। তাদের ইচ্ছানুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করার পরও তারাই আবার যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন। সিটিং বা গেট লক সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সেটিও তারা মানছেন না।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে পরিবহনমালিক, চালক ও হেলপারদের বেপরোয়া আচরণে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রথা চালু থাকলেও বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নেয়া হচ্ছে না।
হাফ ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রায়ই পরিবহন শ্রমিকদের বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। এমনকি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী লাঞ্ছনা কিংবা মারামারির ঘটনাও ঘটছে। একমাত্র সরকারি সড়ক পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসেও শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নেয়া হচ্ছে না। ফলে হাফ ভাড়া নিশ্চিতের দাবিতে অনেকটা বাধ্য হয়ে রাজধানীজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা।
গত এক সপ্তাহে পরিবহন শ্রমিকরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে হেনস্থা, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা, সরকারি তিতুমীর কলেজের ৪ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত, সাইন্স কলেজের শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিতকরাসহ একাধিক জায়গায় শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করেছে। সর্বশেষ ২১ নভেম্বর হাফ ভাড়া নিয়ে ‘ঠিকানা পরিবহন’ -এর একটি বাসে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়।
ফেসবুকে দেয়া পোস্টে বদরুন্নেসা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থী লিখেন, আমার বাসা শনির আখড়া। এখান থেকে কলেজের (বকশী বাজার এলাকা) ভাড়া ১০ টাকা, প্রতিদিন ১০ টাকা দিয়েই যাচ্ছি। আজকে কলেজে যাওয়ার সময় ঠিকানা বাসে করে গিয়েছিলাম। তো আজকে হেলপারকে ২০ টাকার নোট দিলে সে ভাড়া রাখছে ১৫ টাকা। আমি তাকে ভালো করেই বলছিলাম আমার ১০ টাকা ফেরত দিতে, বাট সে দেয় তো নাই উল্টা বলে ‘দিমু না কী করবি কর’। এরপর চিল্লানোর পর সে বলে ‘গলা বড় করবি না, পাঁচ টাকা নে না হয় নাইমা যা। বাসের একটা মানুষও তাকে একটা কথাও বলে নাই। কেউ কিচ্ছু বলে নাই। ইভেন একটা পুলিশও ছিল, সেও কিছুই বলে নাই। এরপর নামার সময় পাঁচ টাকা হাতে ধরায় দিয়ে বলে “নে তোর টাকা, প্রতিদিনই তো আসবি একদিন ধইরা .... কোথাকার।
এ ঘটনার জেরে ওই দিন শাপলা চত্বরে আন্দোলনে নামেন নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা। বকশীবাজার মোড় অবরোধ করেন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। অবরোধ তুলে নেয়ার আগে তারা ৯টি দাবি উত্থাপন করেন। দাবি আদায় না হলেও ফের সড়ক অবরোধ করার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া ২৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবে বাসের চালক সহকারীরা কোনো ধরণের নিয়মনীতি না মেনে দুই থেকে তিনগুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে। ওয়েবিলের নামে সর্বনিম্ন ১৫ টাকা বাস ভাড়া আদায় করছে। বেশিরভাগ সময়ই তাদের দাবি অনুযায়ী ২০-৪০ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। তা না হলে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে।
পরিবহন মালিকরা বলছেন ভর্তুকি না দিলে বেসরকারি বাসে হাফ ভাড়া নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশে এমন কোনো আইন বা নীতিমালাও নেই।
আইনগতভাবে হাফ ভাড়ার বিষয়টির কোনো ভিত্তি না থাকলেও ঢাকার গণপরিবহনে সেটি একটি চিরায়ত প্রথা। যদিও বাসমালিকেরা সেই প্রথা মানতে চান না। বাসের বাইরে বা ভেতরে লিখে রাখেন ‘হাফ পাস নেই’। তবে পুলিশদের জন্য আবার ‘ফুল পাস’ রাখতে আপত্তি নেই তাদের।
আইনগত ভিত্তি না থাকলেও হাফ ভাড়া শিক্ষার্থীদের অধিকার। পাকিস্তান শাসনামলে আন্দোলন করেই সেই অধিকার আদায় করেছে শিক্ষার্থীরা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ‘১১ দফা’ নামে শিক্ষার্থীদের যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কর্মসূচি আমরা দেখতে পাই, সেখানেই হাফ ভাড়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা সরকারের পক্ষ থেকে মালিকদের সঙ্গে বসে বিষয়টি সুরাহার দাবি জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। তবে কবে করা হবে তা স্পষ্ট নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে হাফ ভাড়া দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। আমরা কিছুদিন আগে গণপরিবহন যাত্রীদের সুবিধায় ১৩ দফা দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছি। তার মধ্যে অন্যতম দাবি ছিলো শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া ব্যবস্থা চালু করা।আওয়ামী লীগের ৬ দফায় ছিলো ছাত্র-ছাত্রীদের হাফ পাশ নিশ্চিত করা। আমাদের দাবি শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া যেন দ্রুত নিশ্চিত করা হয়।
তিনি আরো বলেন, পরিবহন শুধু ব্যবসা খাত নয় এটি একটি সেবা খাতও। পরিবহন মালিকরা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে হাফ ভাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বিবার্তাকে বলেন, এই মূহুর্তে দেশে হাফ ভাড়া নেয়ার অবস্থা নেই। এটা বিআরটিসিতে থাকে, সেখানে ভর্তুকি দেয়া হয়। বেসরকারি গাড়িতে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। এখানে হাফ ভাড়া নেয়ার বিষয় নেই।
তিনি আরো বলেন, ঢাকা শহরে লাখ লাখ শিক্ষার্থী আছে। প্রতিদিন প্রতিটি গাড়িতে ৮-১০ জন শিক্ষার্থী চলাচল করে। তাদের হাফ ভাড়া দেয়াটা কি সেবার মধ্যে পড়ে? হাফ ভাড়া নিলে এ টাকাটা আমাদের কে দেবে?
বিবার্তা/সোহেল/আবদাল/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]