শিরোনাম
করোনায় মানবসেবা, তারাই রিয়েল হিরো (পর্ব-৫)
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২১, ১৮:২৮
করোনায় মানবসেবা, তারাই রিয়েল হিরো (পর্ব-৫)
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

চলমান মহামারি করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী এক মহা আতঙ্কের নাম। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে মানুষের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ফলে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে অনেকে অনীহা প্রকাশ করছে।এক্ষেত্রে নিকট আত্মীয়রাও অনেক সময় করোনায় আক্রান্তদের এড়িয়ে চলছে।


পিতা তার সন্তানের লাশের পাশে না যাওয়ার, সন্তান তার পিতার লাশের কফিন কাঁধে না নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ কঠিন পরিস্থিতিতেও কিছু মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে নেমে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।


এমনই একজন অদম্য আত্মপ্রত্যয়ী যুবক তানভীর হাসান সৈকত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক সদস্য এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির উপ সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক।



দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কঠোর লকডাউনের মাঝেও হতদরিদ্রদের জন্য নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। দেশে করোনার শুরুর দিকে টানা ১২১ দিন ভাসমান, অসহায়, হতদরিদ্রদের মাঝে নিজে রান্না করে খাবার বিতরণ করেছেন। এমন উদ্যোগ শুধু দেশব্যাপী নয়, আলোচিত হয়েছিল বিশ্বব্যাপী। মিলেছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। গত বছর ১৯ আগস্ট ‘বিশ্ব মানবিক দিবস’ উপলক্ষে জাতিসংঘ এ মানবহিতৈষী ছাত্রনেতাকে ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।


স্বীকৃতির পর আরো বেশি কাজ করেছেন সৈকত। করোনাকালীন এ সঙ্কটে বিভিন্ন সময়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। এখনো তার বিনামূল্যে অসহায়দের জন্য খাদ্য সহায়তা ও করোনার টিকা রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চালু রয়েছে।



জানা গেছে, বাংলাদেশে যখন ২০২০ সালের মার্চ মাসে প্রথম করোনা হানা দেয় তখন সরকার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছুটি পেয়ে নিজ এলাকায় যাননি সৈকত। না যাওয়ার কারণ অসহায় মানুষের প্রতি তার ভাবনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈকত ভাবলেন, করোনার কারণে যেহেতু লকডাউনের কবলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাহলে দিনমজুর, ভাসমান, অসহায়, হতদরিদ্র মানুষের কি হবে? তারা খাবে কি? এ ভাবনা থেকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িালেন তিনি। নিজের কাছে মাত্র ১৩ হাজার টাকা থাকলেও দমে যাননি সৈকত। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় নিজের রান্না করা খাবার বিতরণ কর্মসূচি। এরপর বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়ে টানা ১২১ দিন চালিয়ে গেছেন এ কার্যক্রম। এরপর লকডাউন উঠে গেলে এ কার্যক্রম স্থগিত করেন তিনি।


শুধু এখানেই থেমে নেই সৈকতের মানবসেবা। গতবছর উত্তরাঞ্চলে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণ বিতরণ করেছেন এ ছাত্রনেতা। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় ভোলার চর ফ্যাশনে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি পরিবারকে মাটির ঘর তুলে দিয়েছেন সৈকত। সেখানে অসহায়দের মাঝে খাদ্য সামগ্রীও বিতরণ করেছেন তিনি।



দেশে করোনা ভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ রোধে গত ১ জুলাই থেকে সারা দেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করায় অসহায় অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে খাদ্য সংকটে ভুগছে। এসব মানুষের কথা ভেবে আবারো কাজ শুরু করেছেন সৈকত ও তার বন্ধুরা।


গত ৩ জুলাই থেকে বিধিনিষেধের শেষ দিন বুধবার (১৮ জুলাই) পর্যন্ত উদ্বাস্তু, উপার্জনহীন, ফুটপাথে ঘুমানো, প্রতিবন্ধী, মানসিক ভারসাম্যহীন দুস্থ মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। প্রথম দিকে একবেলা খাবার দিলেও পরবর্তীতে ছিন্নমূল মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন দুই বেলা। নিজে ও বন্ধুদের সহযোগীতায় প্রতি বেলা প্রায় ৩০০-৫০০ মানুষের জন্য রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন তিনি।


দেশে করোনা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত কোন ঈদে বাড়ি যাননি সৈকত। রাস্তার অসহায় মানুষগুলোর কথা ভেবে, তাদের সাথে হাসি-আনন্দে কাটিয়ে দিয়েছেন করোনাকালীন ৪টি ঈদ।



গত কোরবানির ঈদে ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আরেক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকা ছিন্নমূল মানুষের ঈদ আনন্দ নিশ্চিত করতে দুটি খাসি কোরবানী দিয়েছেন তিনি। তানভীর হাসান সৈকতের ব্যতিক্রমধর্মী এই উদ্যোগে ক্যাম্পাসের অসহায় শিশুরা আনন্দে মিছিলও করেছে। ঈদের দিন ভাসমান, ছিন্নমূল, রাস্তায় থাকা প্রতিবন্ধী মানুষের সেমাই দিয়ে মিষ্টিমুখ করিয়েছেন সৈকত। এরপর খাসির গোশত দিয়ে কাচ্চি রান্না করে অসহায়দের মাঝে বিতরণ করেন তিনি।



দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রামণ বাড়লেও তথ্যপ্রযুক্তি সুবিধায় পিছিয়ে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষ ভ্যাক্সিনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে আগ্রহ দেখায়নি। এজন্য সৈকত নিলেন নতুন উদ্যোগ। ভ্যাক্সিনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝিয়ে ভ্যাক্সিন নিতে অসহায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এখন বিনামূল্যে অসহায়দের খাদ্য সামগ্রী সহায়তা করছেন করোনা টিকা রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসিতে চলছে এ কার্যক্রম। এখানে প্রথমে ভ্যাক্সিনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। রেজিস্ট্রেশন করলেই খাদ্য সামগ্রী দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ১ম ডোজের পর ২য় বার খাদ্য সামগ্রী দেয়া হচ্ছে এবং ২য় ডোজের পর ৩য় বার খাদ্য সামগ্রী দেয়ার প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে । এতে করে মানুষের মাঝে ভ্যাক্সিন নেয়ার আগ্রহ বেড়েছে। এখন অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভ্যাক্সিনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করছে।



সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তানভীর হাসান সৈকত বিবার্তাকে বলেন, আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের রাজনীতির একজন ছাত্রনেতা। বঙ্গবন্ধু সবসময় খেটে খাওয়া অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং আমাদেরও সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে করোনাকালীন সঙ্কটে গত বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছি। এখনো কার্যক্রম চলছে।


তিনি বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যে বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়। সে হিসেবে সাধারণ মানুষের প্রতি আলাদা দায়বদ্ধতা তো আছেই। এ দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা থেকে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি।


অসহায়দের করোনার টিকা রেজিস্ট্রেশন করে দেয়ার বিষয়ে সৈকত বলেন, সরকারের কাঙ্ক্ষিত ভ্যাক্সিন সমতা অর্জনে মোট জনগণের বৃহৎ অংশ এই নিম্ন আয়ের মানুষকে অবশ্যই ভ্যাক্সিনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের বর্তমান উদ্যোগের মাধ্যমে একদিকে তাদের ক্ষুধার, খাদ্যের সংকট নিরসনের চেষ্টা করছি, অপরদিকে সুবিধাবঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর মানুষকে করোনা মোকাবিলায় প্রধান হাতিয়ার ভ্যাক্সিনের আওতায় আনার কাজে সহযোগিতা করছি।


তিনি বলেন, গত ঈদের দিন অসহায় শিশুদের কথা ভেবে গরু না পারলেও দুটি খাসি কিনেছি আমরা। সেই খাসিগুলো নিয়ে পথশিশুদের উৎসাহের শেষ নেই। একে অপরকে ডেকে আনছে খাসিগুলো দেখার জন্য, খাসি দুটিকে নিয়ে মিছিল করেছে এই পথশিশুরা। কার আগে কে এদেরকে পাতা খাওয়াবে সেই প্রতিযোগিতা চলেছে। তাদের এই নির্মল উচ্ছ্বাস আর হৈচৈ আমাদের মনকে তৃপ্ত করেছে।


মানবিক এ ছাত্রনেতা বলেন, এ সঙ্কটে অসহায় জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তারা মানবিক সেবা দিয়ে যাবেন। সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে এসে হতদরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।


বিবার্তা/রাসেল/গমেজ/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com