করোনা সংক্রমণ কমানোর লক্ষে সরকারের দেয়া ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন চলছে। লকডাউনের এই সময়কে অনেকে পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের সাথে আনন্দ করে ছুটি হিসেবে অতিবাহিত করছেন। কেউ পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হচ্ছেন, কেউ এমনিতে ঘুরছেন।আবার কোথাও উৎসবমুখর পরিবেশে আয়োজন করা হচ্ছে ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ। ঈদের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিকেল হতেই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ভিড় জমাচ্ছে মানুষ। সেখানে মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যবিধি।
লকডাউনের সপ্তম দিন ২৮ জুলাই (বুধবার) বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুরের সাগুফতা হাউজিং, মিরপুর ১২ সেকশনের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা ঘুরে এই দৃশ্য দেখা গেছে। এখানে মানুষের আনাগোনায় পুরো এলাকা সরগরম থাকে রাত ৮ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত।
ঈদের পর থেকেই মানুষের ভিড় বাড়ছে বিভিন্ন হাউজিং প্রপার্টির এসব খালি জায়গাগুলোতে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন ঘোষণা করার ফলে সকল বিনোদন কেন্দ্র ও পার্ক বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ মানছেন না লকডাউন। ঈদের পর থেকেই ভিড় আবাসিক এলাকা থেকে কাছাকাছি এরকম খালি জায়গাগুলোতে। বিস্তীর্ণ এই খালি জায়গায় কিছু দূরে দূরে ছোট-বড় ফুটবল বা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন চোখে পড়ে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিকেল ৪ টার পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মোটর সাইকেল, প্রাইভেট কার, রিকশা বা হেঁটেই চলে আসেন মানুষজন। ভিড় বাড়তে থাকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এর মধ্যে ছোট ছোট ফুস্কা ঝালমুড়ির দোকানকে ঘিরেও মানুষের ভিড় ছিল। তাদের কারো মধ্যে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার আগ্রহ দেখা যায়নি। অধিকাংশ মানুষের মুখেই ছিল না কোনো মাস্ক। কেউ কেউ জটলা পাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সেলফি তুলছিলেন।
কালশি এলাকা থেকে আসা কলেজ শিক্ষার্থী তামান্না ইসলাম সপরিবারে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সেলফি তুলছিলেন। তিনি হাসতে হাসতে বিবার্তাকে বলেন, আমরা ঈদের পরে গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি। এর মধ্যে আর বের হওয়া হয়নি। তাই আজকে বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে একটু ঘুরতে বের হয়েছি। পার্ক বন্ধ। এখানে বিশাল খালি জায়গা। আর ভিড়ও কম। এজন্যই আসা।
ব্যাগে থাকা মাস্ক পরতে পরতে তিনি জানান ছবি তোলার জন্য মাস্ক খুলেছিলাম। এখন আবার পরে নিচ্ছি। একটু পরেই চলে যাবো। আর আমাদের করোনা ভ্যাক্সিন নেয়া আছে। তাই একটু ভয় কম লাগে আর কি।
কিছু দূরেই ১০/১৫ জনের একদল কিশোরকে দেখা গেল। দলবেঁধে টিকটক ভিডিওর বানাতে ব্যস্ত ছিল তারা। কারো মুখেই কোনো মাস্ক ছিল না। করোনার সময়ে স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণ জানতে চাইলে তাদের একজন রুবেল বিবার্তাকে জানান, আমাদের সবার বাসা একই এলাকায়। সবাই কলেজ ফ্রেন্ড। তাই এখানে সবাই মিলে একটু আড্ডা দিতে আর টিকটক ভিডিও বানাতে আসছি। শুনেছি কম বয়সের মানুষের নাকি করোনা হয় না। আর এত দিন ঘরে বসে থাকা যায় নাকি?
পাশের মিরপুর ডিওএইচএস থেকে বৃন্দাবনের খালি জায়গায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘুরতে এসেছেন ব্যাংক কর্মকর্তা রুহুল আমিন। লকডাউনে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি অনেকটা রেগে গিয়ে বিবার্তাকে বলেন, কি সমস্যা আপনাদের? আমার বাসা পাশের এলাকায়। আমি কী একটু ঘুরতে আসতে ওপারব না? আর আমি তো সরকারি জব করি। প্রতিদিন তো পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এই সপ্তাহে অফ ডেসহ কিছু দিন ছুটি নিয়েছি। ঈদের পরে আজকেই একটু বের হলাম। আর এটা নিরাপদ এলাকা। এখানে করোনা-ফরোনা নেই।
ছোট ফুস্কার দোকান ফুড শেয়ারে বসে খাচ্ছিলেন পল্লবী থেকে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তানিম আহমেদ। তাদের মধ্যে ছিল না কোনো শারীরিক দূরত্ব। আর মুখে তো মাস্ক ছিলই না। তানিম বিবার্তাকে বলেন, বাসায় বসে থাকতে থাকতে আর ভাল লাগে না। ঈদের পর থেকে আর বের হতে পারিনি। আজকে একটু রিস্ক নিয়েই ঘুরতে চলে এলাম। আর বের হবো না লকডাউন চলাকালে। তাই আজকে একটু ঘুরে নিচ্ছি। আর অনেক দিন থেকে বন্ধুদের সাথেও দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না। লেখাপড়া বিষয়েও কিছু কাজ ছিল। তাই দেখা করা, বের হওয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লকডাউনের ২য় দিন পল্লবী থানা পুলিশের একটি টহল টিম এই দোকানিকে সর্তক করে যান। বাইরে চেয়ার দিয়ে ক্রেতাদের না বসানোর ব্যাপারেও বলে যান। শুধু খাবার পার্সেল বা ডেলিভারি দেয়ার শর্তে দোকান খোলা রাখার অনুমতি পান তিনি। কিন্তু সে নির্দেশনার তোয়াক্কা না করেই দোকানদার কামাল হোসেন চেয়ার টেবিল বসিয়ে ফুস্কা বিক্রি করছেন। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে সেখানেও।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কামাল বিবার্তাকে বলেন, কি করবো ভাই, সবাই তো আর বাসায় পার্সেল নেয় না। আমার এখানে যারা কাস্টমার প্রায় সবাই এখানে ঘুরতে আসে। ফুস্কা, চটপটি খায়। এখন আমি বসতে না দিলে তারা খাবে কিভাবে? ২ দিন পার্সেল সিস্টেমে বিক্রি করে দেখছি, দিনে ৩০০ টাকার বিক্রি করতেই কষ্ট হয়ে যেত। এখন দিনে ১০০০/১২০০ টাকার বিক্রি করি। আমাদেরও তো পরিবার সংসার আছে, তাই না?
মিরপুর ১২ বাসস্ট্যান্ডে একটি টহল গাড়িতে থাকা পল্লবী থানার পুলিশের সদস্য এসআই শোয়াইব ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, আমরা সকালে একবার ডিউটি এলাকার সব জোন ঘুরে এসেছি। তখন তেমন মানুষ ছিল না। দুপুরের পরে সেখানে কিছু ভিড় হয় সেটা জানি, তবে তারা বেশিরভাগ আশপাশের আবাসিক এলাকা থেকেই আসেন। সন্ধ্যার পরে ও রাত ১১ টার দিকে আবার রাউন্ডে যাবো।
তিনি আরো বলেন, সবাই কিছু না কিছু অজুহাত বা কারণ দেখায় আমাদের কাছে। আবার আমাদের আসার খবর পেলেই সবাই দৌড়ে পালিয়ে যায়। পাশের আলুব্দি এলাকায় অলিগলিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমরা রাউন্ড শেষ করে চলে আসতেই আবার সবাই বের হয়ে আসে। এখন সবাইকে একজন একজন করে বুঝানো তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তবে আমাদের এই সীমিত লোকবল নিয়ে সর্বোচ্চটাই দেয়ার চেষ্টা করছি।
বিবার্তা/আদনান/গমেজ/জাই
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]