শিরোনাম
করোনায় মানবসেবা, তারাই রিয়েল হিরো (পর্ব-২)
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২১, ১৬:৪৭
করোনায় মানবসেবা, তারাই রিয়েল হিরো (পর্ব-২)
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

চলমান করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বব্যাপী এক মহা আতঙ্কের নাম। এ ভাইরাস প্রাণঘাতী সংক্রামক হওয়ায় মানুষের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ফলে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে অনেকে অনীহা প্রকাশ করছেন। নিকট আত্মীয়রাও অনেক সময় এক্ষেত্রে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছেন। পিতা তার সন্তানের লাশের পাশে না যাওয়ার, সন্তান তার পিতার লাশের কফিন কাঁধে না নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ কঠিন পরিস্থিতিতেও কিছু মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে নেমে অসহায় জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।


এমনই তিনজন অদম্য আত্মপ্রত্যয়ী যুবক জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে দেশব্যাপী দিয়ে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উপ-বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক সবুর খান কলিন্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সবুজ শুরু করেন বিনামূল্যের এই অক্সিজেন সেবার কার্যক্রম।



দেশে যখন ২০২০ সালের মার্চে প্রথম করোনার প্রকোপ শুরু হয় তখন দেখা যাচ্ছিল, এতে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এটাকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে দেয়। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে পড়তো মহাসঙ্কটে। এ বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে মানবসেবায় এগিয়ে আসা এ তরুণদের। এরপর সাদ বিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন তরুণ মিলে ২০২০ সালে ২৫ জুন থেকে ‘একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা’ স্লোগান নিয়ে জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিস দেয়া শুরু করেন। ১২ টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন তাদের অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ১৬০ টি।


জানা যায়, জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিস শুরুর দিকে ঢাকা কেন্দ্রীক থাকলেও এরপর বিভাগীয় শহর ও জেলা পর্যায়ে সেবা দেয়া শুরু হয়। গতবছরের ২৫ জুন রাজধানীতে এই সেবা শুরু হয়। এরপর ২৫ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগ,২৯ জুলাই ময়মনসিংহ বিভাগে কাজ শুরু করে এই স্বেচ্ছাসেবীরা।



একই বছরের ৩ আগস্ট ফেনী জেলার মাধ্যমে শুরু হয় জেলাভিত্তিক কার্যক্রম। ৬ আগস্ট শুরু হয় কুরিয়ারের মাধ্যমে সারাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ কার্যক্রম। এরপর ৮ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলায় ও ২৬ নভেম্বর শুরু হয় বগুড়া জেলায় অক্সিজেন সেবা পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম। বর্তমানে কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ এবং খুলনায় এ কার্যক্রম চলছে। এছাড়া কুরিয়ারে সারাদেশেই পাঠানো হচ্ছে অক্সিজেন সেবা। এ সার্ভিস শুরুর পর থেকে ১৩ মাসে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৭০০ জন মানুষ সেবা নিয়েছেন।


বিবার্তায় আরো পড়ুন>>>করোনায় মানবসেবা, তারাই রিয়েল হিরো (পর্ব-১)


নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সহযোগিতায় তারা এ সেবা শুরু করলেও এখন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এগিয়ে আসছেন। তবে তারা টাকা নেন না। কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ সরঞ্জাম দিলে তারা গ্রহণ করেন। প্রতি মাসে একবার করে আর্থিক বিবরণীর হিসেব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করে স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়ে কার্যক্রমকে গতিশীল রাখছেন তারা।


শুধু তাই নয়, দেশে যখন করোনা মারাত্মক রূপ ধারণ করে মানুষের মৃত্যু হতে শুরু করলো তখন মানুষ আতঙ্কে কাছে না গেলেও এমন পরিস্থিতিতেও মাঠ পর্যায়ে গিয়ে সিলিন্ডার বিতরণ করেছেন জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবকরা। ঈদ উৎসবেও সেবা দেয়া থেকে বিরত থাকেননি এই তরুণরা। গত ঈদের দিন বুধবার (২১ জুলাই) সারাদেশে ১৭ জন রোগীকে অক্সিজেন সার্ভিস দিয়েছেন তারা।



করোনা মহামারীতে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া এ মানবহিতৈষীদের নেতৃত্ব দেয়া সাদ বিন কাদের চৌধুরী নিজে সপরিবারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া সারাদেশে তাদের ২০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবুও তারা দমে যাননি। নিজেরা সুস্থ হয়ে ফের মাঠে নেমে অসহায় জনগণের জন্য কাজ করেছেন।


জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, আমাদের সেবাটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। বিনামূল্যে মানে বিনামূল্যে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন থাকা সাপেক্ষে এই সেবাটি সমাজের সব শ্রেণী পেশা মানুষের জন্য উন্মুক্ত। সম্পূর্ণ বিশ্বাসের উপর আমরা সেবা দিয়ে থাকি। আমরা অক্সিজেন ভাড়া ও বিক্রি করিনা।অক্সিজেনের ফুল সেট দেই, সাথে থাকে অক্সিজেন মাস্ক অথবা নজেল ক্যানলা। অর্থাৎ বাহির থেকে কোন কিছুই রোগীর পরিবারকে ক্রয় করতে হয় না। অক্সিজেন মাস্ক অথবা নজেল ক্যানলা প্রতি রোগীর জন্য একটি করে। অর্থাৎ এগুলোএকবার করেই ব্যবহার করা হয়। ঢাকাতে ১০ দিনের জন্য একজন রোগী অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে পারে। যথাসময়ে ফেরত দিতে না পারলে কোন জরিমানার বিধান নেই। তাই অনেকক্ষেত্রে আমাদের সিলিন্ডার যথাসময়ে ফেরত আসে না। আমরা বুঝিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। বাকিটা কমনসেন্স এর উপর ছেড়ে দেই।


তারা বলেন, কোন জামানত-জমা নেই না।অক্সিজেন রিফিল বাবদ টাকা নেই না। অক্সিজেন ফেরত দেয়ার সময় রিফিল করে দিতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিলে কোন যাতায়াত ভাড়া নেই না। আমাদের কোন সার্ভিস চার্জ নেই। এই কাজের সাথে জড়িত স্বেচ্ছাসেবকরা সবাই শিক্ষার্থী, তারা স্টাফ না। তারা সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে এই সেবার কাজ করেন। তারা আমাদের যোদ্ধা, আমাদের শক্তি।



অক্সিজেন সার্ভিসের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উদ্যোক্তা সাদ বিন কাদের চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, করোনার এ কঠিন সময়ে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এদের মধ্যে অনেক পরিবারের অবস্থা ভালো না থাকায় তারা অক্সিজেনের জন্য হিমশিম খাচ্ছিলেন। এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমরা জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিস দেয়া শুরু করি। যা এখনো চলমান রয়েছে।


ঈদের দিন সার্ভিসের বিষয়ে তিনি বিবার্তাকে বলেন, যারা শ্বাসকষ্টে আছেন তারা তো ঈদের দিনও এটা থেকে রেহাই পাবেন না। তাই আমরা উৎসবের দিনও সার্ভিস অব্যাহত রেখেছি। মানুষ মানুষের জন্য। আমাদের যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে এ সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে।


তিনি আরো বলেন, আমি নিজে সপরিবারে করোনা আক্রান্ত হয়েছি এবং আমাদের টিমের ২০ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপরও আমরা আমাদের সেবা চালিয়ে গেছি।এ সেবা দেশের এই সঙ্কটে অব্যাহত থাকবে। মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।


বিবার্তা/রাসেল/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com