শিরোনাম
আদালতের আদেশ, এরিকের মা নন বিদিশা
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২১, ১২:৩৭
আদালতের আদেশ, এরিকের মা নন বিদিশা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বিদিশা সিদ্দিক। প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন যে শিশুকে পুজি করে তিনি এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করছেন তার সত্যিকারের জন্ম নিয়েও নানা রকম প্রশ্ন উঠেছে। এই শাহাতারা জারাব এরিক এরশাদ যে বিদিশার সন্তান নয়, কোর্ট এবিষয়ে ফয়সালাও দিয়েছেন। পারিবারিক আদালতে এ সংক্রান্ত মামলায় বিদিশা হেরে গেছেন। এরশাদের আইনজীবীর জেরার মুখে বিদিশা সব সত্য স্বীকারও করেছেন। বিদিশা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আদালত বিদিশার আপিলও খারিজ করে দেন। আপিল নং- ৬১/২০১১। অথচ এখন আবার ওই পরিচয়কে সামনে এনে ছেলের মায়ের দাবি নিয়ে এইচএম এরশাদ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যাওয়ার ৪ মাসের মাথায় নভেম্বরে বিদিশা এ বাসায় ওঠেন।


অবৈধভাবে অর্জিত দেশি-বিদেশি ২১ কোটি টাকার বেশি অর্থ গোপন করার অপরাধে ২০০৫ সালের ১৬ জুন মামলাও হয় বিদিশার বিরুদ্ধে। ২০১৬ সাল থেকে একটি প্রতারণা মামলার ফেরারী আসামিও ছিলেন বিদিশা। পরে এ মামলায় জামিন নিয়েছেন কিনা তা রয়েছে অজানা।


বিদিশা সিদ্দিকের নানা অনিয়ম, অর্থ পাচার, একাধিক পাসপোর্ট, বিদেশ সফর, তার বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা, এরিকের জন্ম রহস্যসহ বিভিন্ন প্রমাণাদি বিবার্তার কাছে এসে পৌঁছেছে।


প্রয়াত এরশাদ জীবদ্দশায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এরিকের দেখভালের জন্য গঠিত এরশাদ ট্রাস্টি বোর্ডে হলফনামায় স্পটভাবে লিখে গিয়েছেন আমার মৃত্যুর পর এই ট্রাস্টের সম্পত্তি বা এই প্রেসিডেন্ট পার্ক বাসভবনে বিদিশা প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু এরশাদ মৃত্যুর চার মাস না পেরুতেই এরিককে দেখতে ও খাবার দেয়ার কথা বলে ঢুকে পড়েন বাসায়। খাবার খাওয়ানের কথা বলে ঢুকলেও আর বের হননি বিদিশা সিদ্দিক। প্রয়াত এরশাদ জীবিতকালে বিদিশাকে নিয়ে যা আশংকা করেছিলেন বাস্তবে তাই হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পার্কে প্রবেশ করেই এক সপ্তাহের বের করে দেন এরশাদের সকল বিশস্ত কর্মচারীদের। এরপর থেকেই অনেকটা নির্বিঘ্নে সময় পার করছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায়।


বিবার্তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বিদিশার অজানা অনেক না তথ্য। তার জন্ম তারিখ নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। ১৯৮৩ তিনি পাসপোর্টে (এফ২২১৩৬৫১) উল্লেখ করেন তার জন্ম তারিখ ০১.০৭.১৯৬৭। স্বামী- পারভেজ আহমেদ পিটার স্টুয়ার্ট হুইসন। ১৯/০৭/২০০১ সালে আরেকটি পাসপোর্ট ইস্যু করেন যেখানে তার জন্ম তারিখ ০৬/০৩/১৯৭১।



বিদিশা একটি মামলার জেরায় (পারিবারিক মোকদ্দমা নং-৮৮৮/২০০৯) স্বীকার করেছেন তিনি নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। একটি প্রতারণা মামলায় ০৪/০১/২০১৬ তারিখে তার বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেফতারী পরোয়ানা। মামলার বাদী মোশাররফ হোসেন বিবার্তাকে জানান, গুলশানে একটি ফ্লাট দেয়ার শর্তে বিদিশা ৭৫ লক্ষ বায়না টাকা নেন। বিনিময়ে আমাকে ভুয়া চেক প্রদান করেন, যা আমি চেক জমা দিয়ে জানতে পারি। মামলা নং ২৮৩।


বিদিশার প্রথম স্বামী স্টুয়ার্ট হুইসনের ঘরে প্রথম সন্তান উইলাম জেমস হুইসনের জন্ম ২৩/১১/১৯৮৭, ২য় মেয়ে সন্তান ইজাবেথ এমা হুইসনের জন্ম দেন ১৬/৭/৯০ সালে। ১৯৯৪ সালে তিনি দেশে এসে ব্যবসায়ী কাজী আশরাফের হাত ধরে ধানমণ্ডির ৫ নং রোডের ১৩/এ চারটি ভাতের হোটল দেন। পরবর্তীতে সেই ব্যবসায়ীর ৪৮ লক্ষ টাকার লেনদেন নিয়ে মতবিরোধ হলে চলে যান আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ আশ্রয়ে। তার সান্নিধ্যে থাকেন দুই বছর। তার মাধ্যমে বিদিশার পরিচয় হয় তৎকালীন ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রদূত শাহাতারা জারাবের সঙ্গে। পরবর্তীতে এই রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমেই পরিচিত হোন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে। শুরু এরশাদের সাথে বিদিশার পথচলা।


স্বামী পিটার স্টুয়ার্ট হুইসনকে তালাক দেন ৩১/০১/১৯৯৯ সালে। রেষ্ট্রিঃ ১০৪। (সেখানে বিদিশার জন্ম তারিখ ০১/০৭/১৯৬৭ উল্লেখ করা)। ২৭/০২/২০০০ সালে বিদিশা নতুন পাসপোর্ট করেন। ২০০১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে চলে যান বিদিশা। তখন তার পাসপোর্টে স্বামীর নাম পিটার স্টুয়ার্ড হুইসন (তখন সে তালাকপ্রাপ্ত)। পাসপোর্ট নম্বর পি ০১৮৭৯০৯। সিঙ্গাপুরের ভিসা নম্বর সিবি ৫৮২২৯১। ১৩ দিনের মাথায় ১৩ মার্চ সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন বিদিশা। আসার সময় তার সাথে পাসপোর্টে কোনো সন্তানাদি নেই। (এরশাদ ২৬/০২/২০০১ তারিখ থেকে ২৩/১২/২০০১ পর্যন্ত কারাভোগ করে সুপ্রিম কোর্ট আপীল নং ২২৬/২০০০ সালে ৫ কোটি ৭৪ জরিমানা দিয়ে মুক্তি পান)। সেই সময় বিদিশা এরিক ওয়ান হুইসনের নামে একটি জন্ম নিবন্ধন করান। যার জন্ম তারিখ ১১/০৩/২০০১। পিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে পিটার স্টুয়ার্ট হুইসন। যার কপিও বিবার্তার কাছে রয়েছে। পরে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক হারত আলীর সহযোগিতায় ১৯/০৭/২০০১ তারিখে ছেলে এরিক ওয়ান হুইসনের নামে পাসপোর্ট ইস্যু করেন। পাসপোর্ট নং- ২২০৫৪/২০০১। ৫ অক্টোবর ২০০১ তারিখে এরিক ওয়ান হুইসনের নামে ইউকে ভিসা ইস্যু করা হয় (পাসপোর্ট পেজ নং২৯)।



১২ এপ্রিল এরিক ওয়ান হুইসনকে নিয়ে বিদিশা পাড়ি জমান লন্ডনে। ২২ এপ্রিল ২০০২ তারিখে সেখানে নতুন একটি পাসপোর্ট করান এরিক হুইসনের। তখনও পিতার নাম পিটার স্টুয়ার্ট হুইসন।


পরবর্তীতে দেশে মা আনোয়ারা সিদ্দিকের কাছে লালনপালনের জন্য এরিক ওয়ান হুইসনকে রেখে আসেন বিদিশা। সেই সন্তানকে নিয়েই এরশাদের দ্বারস্থ হোন বিদিশা। এরশাদ ও বিদিশা একে নিজেদের সন্তান মিডিয়ার সামনে ঘোষণা দিলেন। নাম রাখলেন শাহাতারা এরশাদ এরিক। পিতা- এইচ এম এরশাদ, মাতা বিদিশা এরশাদ। জন্মনিবন্ধন এভিডেভিড করিয়ে করেন নতুন পাসপোর্ট। পাসপোর্ট নং আর ০৬৮৬৯১৭। জন্ম তারিখ সেই ১১/০৩/২০০১। ৭ জানুয়ারি বিদিশাও করেন নতুন পাসপোর্ট। স্বামীর নাম এইচ এম এরশাদ। নিজ নাম বিদিশা এরশাদ। এরপর থেকে বিদিশাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি।


বিধিবাম, প্রশ্ন দেখা দেয় একই তারিখে দুই সন্তানের জন্ম নিয়ে। এরিক ওয়ান হুইসন- পিতা- স্টুয়ার্ট পিটার হুইসন। জন্ম ১১/০৩/২০০১। অন্য দিকে শাহাতারা এরিক এরশাদ। পিতা এইচ এম এরশাদ। জন্ম ১১/০৩/২০০১। মাতা বিদিশা!!! প্রকৃত পিতার পরিচয় উদ্ঘাটনে খোদ এরশাদও বিদিশার বিরুদ্ধে আদালতে একটি ব্যাভিচারের মামলা করেন। মামলা নম্বর ১৬২/২০০৫। তবে জীবদ্দশায় লোকলজ্জার ভয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের আশঙ্কায় এ মামলা আর চালাতে চাননি এরশাদ।



বিবার্তার অনুসন্ধানে ওঠে আসে বিদিশার জালিয়াতির আরো ভয়ানক তথ্য।


২০০০ সালের ২২ জুন গুলশান ২ নম্বরে অবস্থিত কামাল আতার্তুক এভিনিউয়ে গুলশান মা ও শিশু ক্লিনিকে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করান নাজনীন নামের ২০ বছরের জনৈক এক মহিলা। তার প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ আসে। এরপর ২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজারবাগের মুহাম্মদিয়া মেডিকেল সার্ভিসেস লি. নামে একটি ক্লিনিকে আলট্রাসনোগ্রাম করে বাচ্চার পজিশন দেখেন নাজনীন। অত্র হাসপাতালের ডা. ফেরদৌস আরা'র দ্বারস্থ হোন সেই নাজনীন। পরিক্ষা করেন সেই হাসপাতালের ল্যাবের দায়িত্বে থাকা ডা. কানিজ খাতুন জান্নাত। যার আইডি নং ১৯১৬। পরে নাজনীনের নামে মেডিকেলের এ নথিপত্রে নিজ হাতে নিজের নাম লিখে ওভার রাইটিং করেন বিদিশা। লেখা হয় নন রেসিডেন্ট। নাজনীনের নাম কেটে কলমে লেখা হয় বিদিশা সিদ্দিক। ডা. কানিজ খাতুন জান্নাতের নাম কেটে জেআই বন তান (সিঙ্গাপুর) লেখা হয়। নাজনীনের কাগজপত্র চুরি করে নিজের নামে ডুপ্লিকেট কাগজ তৈরি করতে চেয়েছিলেন বিদিশা। বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় গোপনে সেই কাগজ রেখে দেন বিদিশা। অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একদিন এইচএম এরশাদ নিজেই চাঞ্চল্যকর এ কাগজ পেয়ে যান। পরবর্তীতে এইসব প্রমাণাদি এরশাদ তার একজন বিশস্ত একজনের কাছে দিয়ে রাখেন। এরকম আরো প্রমাণাদি বিবার্তার হাতেও পৌঁছেছে।


বিদিশার বক্তব্য অনুসারে এরশাদ ও বিদিশার বিয়ে হয় ২৭ মার্চ ২০০০ সালে। এরশাদ বিদিশাকে তালাকের নোটিশ দেন ০৩/০৬/২০০৫ তারিখে। ডিসিসি'র যুগ্ম জেলা জজ শালিসি'র প্রধান মাসুদুর রহমান ১১/০৯/২০০৫ তারিখে তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর করেন।


পরে বিদিশা ছেলের দাবিতে পারিবারিক আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করেন (৮৮৮/২০০৯)। ঐ মোকদ্দমায় ১৭/০৫/১০ তারিখে এরশাদের আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বিদিশাকে জেরা করলে তিনি জানান, আমি নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। ১/৭/৬৭ সালে আমার জন্ম। ৮৫ সালে গ্রীনরোড কাজী অফিসে বাবার বন্ধু পারভেজ আহমেদ পিটার স্টুয়ার্ট হুইসনের সাথে বিয়ে হয়। নথিতে দেখা গেছে এরশাদের সাথে বিয়ের সময় জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ০৬/০৩/৭১। এবিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে নিশ্চুপ থাকেন বিদিশা। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনার পাসপোর্টে দেখা গেছে আপনি ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০০১ থেকে ১৩ মার্চ ২০০১ পর্যন্ত দেশেই ছিলেন না। তাহলে ১১ মার্চ কিভাবে সন্তানের জন্ম দিলেন? ২৭/০৩/২০১১ তারিখে আদালত (জজ শাম্মী আখতার) সার্বিক বিযয়ে পর্যালোচনা করে জানান, বিদিশা(বাদী) তার হেফাজতে নাবালক(এরিক)'র সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল নিহীত হবে তা প্রমাণ করতে সক্ষম হননি। এরিক তার হকদার নয় বলেও সিদ্ধান্ত দেন আদালত। বিদিশা উচ্চ আদালতে গেলে তাও খারিজ হয়ে যায়(আপীল নং৬১/২০১১)।



এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ও এইচএম গোলাম রেজা বিবার্তা কে বলেন, শাহাতা জারাব এরিক এরশাদ স্যারের সন্তান নন। বিদিশা প্রতারণা করে জন্মনিবন্ধনে পিতা হিসাবে এরশাদের নাম যুক্ত করেছেন। পারিবারিক আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে। বিদিশা সম্পত্তির লোভে যেকোনো সময় এই অটিস্টিক শিশুকে হত্যা করতে পারেন বলে আশঙ্কা করেন রেজা। তিনি বলেন, এরিক দেখভাল নয়, শুধুমাত্র সম্পত্তি দখল করারই বিদিশার উদ্দেশ্য। যেহেতু বিষয়টি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর বিষয়। তাই সরকারের উচিত হবে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিষটির একটি সুরহা করা।


এরিক এরশাদ সত্যিকারের মা, প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান, একই দিনে দুই সন্তানের জন্ম ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলে শনিবার সন্ধ্যায় বিদিশা সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, আপনি আমার বই পড়েন। বিষয়টি কিছুই না। তারা এখন ঈর্ষান্বিত। জাতীয় পার্টির কমিটি ঘোষণা করছে এরিক। এ জন্য তাদের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।


উল্লেখ্য, বিদিশার লেখা "শত্রুর সঙ্গে বসবাস" বইতে একাধিকবার এরশাদকে দুশ্চরিত্র বলে উল্লেখ করেছেন বিদিশা। সেই এরশাদের বাসভবনই দখল করে আছেন বিদিশা সিদ্দিক।


বিবার্তা/এবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com