নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হবে বিনিয়োগ
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪, ১০:৪৮
নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হবে বিনিয়োগ
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর এই দিনটিতে একটা উপপাদ্য থাকে। এ বছর নারী দিবসের উপপাদ্য ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ; এগিয়ে নিতে হবে বিনিয়োগ’। দিনটি পালনে নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা ছাড়াও নারীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা গুরুত্ব পায়। তবে নারী দিবসের শুরুটা ছিল নারীর সমঅধিকার, মর্যাদা ও অসম মজুরির প্রতিবাদে।


১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের সুতা কারখানার কর্মজীবী নারীদের শিল্পকারখানায় শ্রম সময় কমানো, মানবিক আচরণবিধির প্রয়োগ, মজুরির বৈষম্য দূরীকরণসহ আরও অন্য ধরনের স্বাধীনতা প্রদানকে কেন্দ্র করে নারী শ্রমিকরা রাজপথে নেমে আসেন। সেদিন অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই ঐক্যবদ্ধ মিছিলে সরকারি বাহিনীর দমনপীড়ন সারা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। প্রকাশিত হয় নারীর প্রতি অমানবিক আচরণ ও অধিকার হরণের করুণ ইতিহাস।


নারীর এই ন্যায্য দাবি ও বঞ্চনার ইতিহাসে বিক্ষুব্ধ হন বিভিন্ন দেশের নারী নেত্রীরাও। সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন নারীর প্রতি এই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদে সোচ্চার হতে থাকেন বিশ্বের অসংখ্য নারী শ্রমিক। বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করে তাদের এই দাবি আদায়ের লক্ষ্য ক্রমেই জোটবদ্ধ হতে থাকে। এরই জোরালো উদ্যোগ হিসেবে ১৮৫৭ সালে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমনপীড়ন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিও একজন স্থপতি।


১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। সেই সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা।


বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হলে দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশ ৮ মার্চকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে দিবসটির তাৎপর্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।


উন্নয়নের গতিধারায় আজকের বাংলাদেশে নারী অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রারও চালিকাশক্তি। কৃষি, শিল্পকারখানা, অবকাঠামোগত নির্মাণ, অফিস-আদালতসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে নারীর কর্মক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, তাতে নির্দ্বিধায় বলা
যায় শ্রমবাজারে নারীরা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ।


তারপরও শ্রমজীবী নারীরা আজও নারী দিবসের যথার্থ সুফল থেকে অনেক দূরে। দেশের পোশাকশিল্প, যা দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার নিয়ন্ত্রক, সেক্ষেত্রে নারীদের যুগান্তকারী ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বর্তমানে আমাদের দেশে যদিও সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে নারী- পুরুষের মজুরিবৈষম্য নেই বললেই চলে, কিন্তু ব্যক্তিমালিকানাধীন কৃষি ও শিল্পের উৎপাদনশীলতায় নারী যে বৈষম্যের দুর্বিপাকে পড়ে, তা আন্তর্জাতিক শ্রম আইনেরও চরম লঙ্ঘন বলা যায়।


অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যেমন রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সেতু ও বহুতল ভবন নির্মাণে নারী শ্রমিকের ন্যায্য পাওনাকে যেভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়, পুরুষের তুলনায় তা যেমন দৃষ্টিকটু একইসঙ্গে নীতিবহির্ভূতও। আর অবকাঠামো নির্মাণে শত শত নারী শ্রমিকও এই বিভাজন থেকে মুক্ত নয়। নারী শুধু যে দেশের উৎপাদনশীলতায় কায়িক শ্রম দিচ্ছে তা নয়, গৃহস্থালির যাবতীয় কাজকর্মও একজন গৃহিণীকেই সামলাতে হয়। উপার্জনক্ষম মহিলারা এই গৃহকর্মের দায়বোধ থেকে নিজেকে বাঁচাতেও চায় না।
উন্নয়নের গতিধারায় আজকের নারীরা অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রারও চালিকাশক্তি। একটা সময় ছিল যখন নারীদের কোনো অধিকারই ছিল না। বিশ্বজুড়ে নারী অধিকার আদায় করতে হয়েছে দীর্ঘ সংগ্রাম করে।


বলা হয় মানুষ দু’পায়ে হাঁটলে আগায়। যে সমাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে সমমর্যাদায় কাজ করে তখন সমাজও অগ্রগামী হয়। তাই সমাজ রাষ্ট্র তথা দেশকে অগ্রগামী করতে নারীকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জায়গার ব্যবস্থাও জরুরি।
এ দেশের নারীরা যেমন ১৯৫২ বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তেমনি ১৯৭১ সালেও তারা অনেকে পুরুষের পাশাপাশি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে বাংলার লাখ লাখ নারীর অসীম ত্যাগও জড়িয়ে আছে।
এত অর্জন এত ত্যাগের পরও বাংলাদেশে শহরে-গ্রামে নারী নির্যাতন ও হত্যা এবং ফতোয়াবাজি নারী জীবনে অভিশাপ যেন শেষ হয় না।


বাংলাদেশে এখনও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন, আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারা বিদ্যমান। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা থেকে বাংলাদেশ এখনও সংরক্ষণ প্রত্যাহার করেনি, যে কারণে অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো এখনও বৈষম্যমূলক ধর্মভিত্তিক আইন দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটা বড় প্রতিবন্ধকতা উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নারীবিরোধী প্রচারণা। সম্প্রতি এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রভাব বিস্তার করেছে। ইউটিউবে ছেড়িয়েছে নারীবিরোধী ঘৃণ্য উক্তিতে ভরা ওয়াজের ক্লিপ । তাদের এসব প্রচারণা নারীর শিক্ষা ও চাকরির বিপক্ষে এবং বাল্যবিয়ের পক্ষে মানুষকে প্রভাবিত করে, যা সংবিধানের মূল চেতনাবিরোধী। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে শুধু মাত্র একদিনের জন্য না, প্রতিদিনের কর্মযোগে নারী যতক্ষণ না তার যথার্থ অধিকার ও মর্যাদা অর্জন করতে পারবে, সে পর্যন্ত দিবসটির তাৎপর্য সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠবে না।


লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com