বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : বিশ্বময় এক দুর্লভ রেফারেন্স
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪, ১০:০৭
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : বিশ্বময় এক দুর্লভ রেফারেন্স
প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল
প্রিন্ট অ-অ+

৭ মার্চ। বাঙালি জাতির জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৯৭ সালের এই দিনে বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অতিমানবীয় বক্তৃতার মাধ্যমে বাঙালিকে একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড উপহার দেন। আধুনিক বিশ্বে সংরক্ষিত কয়েকটি বিখ্যাত বক্তৃতার সাথে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তুলনা করলে এর শ্রেষ্ঠত্ব অদ্বিতীয় বলেই বিবেচিত হয়, এটি প্রমাণিত।


ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ড. জ্যাকব এফ. ফিল্ড কর্তৃক সম্পাদিত এবং ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত, ‘We shall Fight on the Beaches : The Speeches that Inspired History’ গ্রন্থে সংকলিত আড়াই হাজার বছরের ৪১টি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য ভাষণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করে। গ্রন্থটিতে তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল বক্তব্য ও মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত দিক নির্দেশনাসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর আপসহীন ভূমিকা তুলে ধরেন।


৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেন, 'পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতার গ্লানি থেকে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থাকবে, ততদিন ৭ মার্চের ভাষণ সংগ্রামের শক্তি যোগাবে। এ ভাষণ শুধু বাঙালির নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা।' ১৯৭১ সালে লন্ডনের রয়টার্স লিখেছে, ‘বিশ্বের ইতিহাসে এরকম আর একটি পরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছে এবং দেশ পরিচালনার সঠিক দিক নির্দেশনা সুচারুভাবে উল্লেখ করা হয়েছে’।


এ ভাষণ নিয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘শেখ মুজিব এতটাই কৌশলী ছিলেন যে তিনি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সুকৌশলে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। আমরা কিছুই করতে পারলাম না। শুধু দর্শক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম’। ১৯৭১ সালে ফ্রান্সের সংবাদ সংস্থা এ.এফ.পি তাদের সংবাদ মাধ্যমে ৭ মার্চ সম্পর্কে লিখেছে ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই দিনই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে’।


মার্কিন ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে তাদের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে, ‘শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণের আলোকেই’। ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ৭ মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবী স্বীকার করে’।


পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা ৭ মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করে ১৯৭২ সালে তাদের সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করে, ‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে এরকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি এনে দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা’।


১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ পর্যালোচনা করে মার্কিন সাময়িকী দ্যা টাইম ম্যাগাজিন ১৯৯৭ সালে প্রকাশ করে, ‘শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল। একান্তই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভাষায় তিনি যা বলেছেন, তাতে বাঙালির বুঝতে বাকি রইল না যে স্বাধীন ভূ-খণ্ড অর্জনের জন্য মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম জরুরি... 'আমাদের আর দাবায়া রাখতে পারবা না’।


১৯৭১ এর ৫ এপ্রিল দ্যা নিউজ উইক ম্যাগাজিনের ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলা হয়। মার্কিন নেতা লুথার কিং যেমন বলছেন আই হ্যাভ এ ড্রিম। বঙ্গবন্ধু বলছে আর আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইভিনিং ষ্টার পত্রিকা ১২ মার্চ ১৯৭১ সালে লিখেছে, ‘১ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নং সড়কের বাড়িটি পরিণত হয় অনেকটা ব্রিটিশ ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে। বস্তুত তখন তিনি সরকার প্রধানে পরিণত হন। সকল শ্রেণি পেশার মানুষ দলে দলে ধানমন্ডির বাসভবনে আসতে থাকে। এই অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব খুঁজে পায় আপামর বাঙালি জনসাধারণ। তখন সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন শেখ মুজিবুরের অধীনে চলে যায়’।


যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টর দলিলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি উল্লেখ আছে। ১৯৭১ সালে ঢাকায় নিয়োজিত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিক ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘পূর্বে রেকর্ড করা শেখ মুজিবের কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা পাকিস্তানের রেডিওতে ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য শোনা যায়। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ (রাত ১২টা পর) যেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে, আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তান হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তিনি জনগণকে আত্মগোপন করতে এবং সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আক্রমণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন’।


বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে জাপানের আসাহী ইভিনিং নিউজ, আর্জেন্টিনার দৈনিক বুয়েন্স আয়ান্স, নিউ ইয়র্ক টাইমস এক যোগে সংবাদ শিরোনাম করে এইভাবে, ‘২৬ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিব’।


চমক হলো একটি ভাষণ কিভাবে বিশ্বজুড়ে সকল জাতির নিকট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে? চলুন, জেনে নিই এর সঠিক ব্যাখ্যা। ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে সেদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল। কোথাও এতটুকু ভাটা পড়েনি। অপশাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে সাহস, শক্তি, বজ্রকণ্ঠ একাকার হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি শব্দ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি বাক্যে ছিল যুক্তি। শব্দচয়ন, বাচন-ভঙ্গিমা আর তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় মাত্র ১৮ মিনিটের এ ভাষণ উপস্থিত ১০ লক্ষ দর্শক-শ্রোতার রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। স্বাধীনতা অর্জনে উম্মাদনা তৈরি করে।


এ ভাষণ আবেশী চুম্বকের মত মুহূর্তেই আবিষ্ট করে দেয় গোটা জাতিকে। যে ভাষণের মধ্যে নিহিত ছিল একটি জাতির মর্মকথা। বাঙালির জন্মকথা। একটি জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাস। তাই তো ইউনেস্কো অবিস্মরণীয় এ ভাষণকে ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।


এ ভাষণের মূল আকর্ষণ কোথায় একটু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি। ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বুঝিয়ে দিলেন রক্ত-মাংস-অস্থিমজ্জায় আমি তোমাদেরই লোক। তাই তো তাঁর সরল উচ্চারম ‘ভাইয়েরা আমার’। এরপর অত্যন্ত শান্ত গলায় জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধু তাঁর অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরেন এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়েই তিনি প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করবেন মর্মে প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। কিভাবে এদেশের জনগণ্রর সাথে বেইমানি করা হয়েছে ভাষণে সেই বঞ্চনা, প্রতারণা, উপেক্ষা আর দোষারোপের ষড়যন্ত্র আরেকটু বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু যাতে জনগণের ভিতর আবেগ উৎসারিত হয় এবং দেশপ্রেমে ব্রতী হয়।
ভাষণের মাঝামাঝি তিনি আবির্ভূত হলেন শোষিত বাংলার সাধারণ মানুষের ত্রাতার ভূমিকায়। মহানায়কের মতো বলিষ্ঠ অবয়বে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের নিকট পূর্ব বাংলার জনগণের দাবিসমূহ ইস্পাত কঠিন ভাষায় পেশ করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধু এসময় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে প্রবঞ্চক পাকিস্তানি সরকার কী কী সমস্যা তৈরি করতে পারে সেই ব্যাপারেও জনগণকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন।


দীর্ঘ সংগ্রামের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে আর সময় নেননি এ মুক্তিকামী মহানায়ক। ডাক দিলেন মুক্তিযুদ্ধের। বলেই ফেললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ এবং সরাসরি শত্রু হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আখ্যায়িত করতেও ছাড়েননি তিনি। সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’কেননা, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না’। জীবনের ঝুঁকি থাকলেও সাড়ে সাত কোটি বাঙালির দায়িত্ব নিতে ভোলেননি তিনি। নিজের হাতেই তুলে নিলেন শাসনভার। নির্দেশ দিলেন সকল সরকারি কর্মচারী, ব্যাংক কর্মীদের করণীয় সম্পর্কে। ভাষণে এক বাক্যে তিনি তাঁর আজন্ম অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরে বলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়’।


বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানি হায়েনারা এমনিতেই ছেড়ে দিবে না। রক্তের বন্যায় রঞ্জিত হবে বাংলা। তবুও এটাই সময় যুদ্ধের যাবার। তাই সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করে বাঙালিকে সেই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে তাঁর আশার বাণী, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’। শেষের বাক্যদু’টি যেন জ্বলন্ত বারুদ! বঙ্গবন্ধু অবহেলিত বাংলার ভাগ্য নিয়ে যারা খেলা করছে তাদের সকল জল্পনা কল্পনাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাঁর অন্তরের লালিত স্বপ্নের সফল পরিণতির কথা ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। যা কিনা আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ ভূখণ্ডের আপামর জনগণের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়।


সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে নবীন প্রজন্ম, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী সবার জন্যই এ ভাষণে রয়েছে অনেক কিছু শিক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ সর্বকালে সমসাময়িক। ৭ মার্চের ভাষণ একটি জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টির মহাকাব্য। বহুমাত্রিকতায় এ ভাষণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ ভাষণ আমাদের মুক্তির মন্ত্র, সংগ্রামের চেতনা, আত্মত্যাগের প্রেরণা। বিশ্বজুড়ে এর ওপর নানাবিধ গবেষণা চলছে। তাই তো, শোষিত মুক্তিকামী মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি পরিণত হয়েছে এক দুর্লভ রেফারেন্সে।


লেখক : প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল, ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।


বিবার্তা/এসবি/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com