‘জয় বাংলা’ যেভাবে গণমানুষের স্লোগান হলো
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০৪
‘জয় বাংলা’ যেভাবে গণমানুষের স্লোগান হলো
হাবিবুর রহমান রোমেল
প্রিন্ট অ-অ+

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে আপনি যদি একজনমাত্র মানুষের নাম উল্লেখ করতে চান, একটামাত্র মানুষের ত্যাগ আর ভালোবাসার কথা সমস্বরে গলা উঁচিয়ে বলতে চান- তিনি মুজিব। বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।


বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয়সম মানুষকে নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই অথবা সেই ধৃষ্টতা আমি দেখাতেও চাই না। বরং তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের 'জয় বাংলা', বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র প্রেরণাদায়ক স্লোগান 'জয় বাংলা' নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলতে চাই, আলোচনা করতে চাই।
কথা শুরু করা যাক 'জয় বাংলা' শব্দবন্ধের জন্ম ও এর আক্ষরিক অভিধানিক অর্থ এবং তাৎপর্য নিয়ে-


‘জয় বাংলা’ শব্দবন্ধের জন্মের ইতিহাসটা এই রকম- ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাস। ওই আন্দোলনে তিনি জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন। পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের স্বদেশ প্রেম এবং আত্মত্যাগে মুগ্ধ হয়ে তার কারামুক্তি উপলক্ষ্যে কালিপদ রায়চৌধুরীর অনুরোধে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২২ সালে ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতায় সর্বপ্রথম 'জয় বাংলা' শব্দযুগল ব্যবহার করেন। কবিতাটি 'ভাঙার গান' কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত হয়েছে। নিচে ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কাব্য থেকে উদ্ধৃত হল-


‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ,
জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি, জয় প্রাণ অন্তহীন।'


এই শব্দযুগল সম্পর্কে আরেকটি তথ্য হলো- প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত নবপর্যায় (১৯৪০) ‘নবযুগ’ ৩ বৈশাখ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ (১৯৪২) সংখ্যায় 'বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেন-


‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও:


এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির-আমাদের।
দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয়
তাড়াব আমরা করি না ভয়
যত পরদেশি দস্যু ডাকাত
রামাদের গামাদের
বাংলা বাঙালির হোক। বাংলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।’


১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন, যার বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। নবযুগ পত্রিকার সেই উদ্দীপ্ত প্রবন্ধ তাকে তখন বা পরে উজ্জীবিত করে থাকতে পারে।


একসূত্রে বলা হয়েছে যে, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ১৭ মার্চের 'শিক্ষা দিবস' যৌথভাবে পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর ডাকা সভায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতী হেলালুর রহমান প্রথম 'জয় বাংলা' স্লোগান দেন। তবে কথিত আছে ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে পল্টনের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান তার ভাষণে 'জয় বাংলা' উচ্চারণ করেন।


সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রায় দশ লাখ মানুষের জমায়েতে জাতির উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার তাঁর জগৎ বিখ্যাত ঐতিহাসিক ভাষণ সমাপ্ত করেছিলেন 'জয় বাংলা' স্লোগান দিয়ে। তারপর থেকেই 'জয় বাংলা' স্লোগান হিসেবে বাঙালির কাছে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ভাষণ শেষে উচ্চারিত শব্দদ্বয় বাঙালিকে দেশাত্মবোধকে জাগ্রত করে। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সভা, মিছিল ও আন্দোলনে 'জয় বাংলা' স্লোগানটি ব্যবহৃত হতে থাকে।
'জয়' বিশেষ্য পদ। আভিধানিক অর্থ বিপক্ষকে পরজিত করণ; যুদ্ধাদি দ্বারা অধিকার; দমন, বশে আনয়ন। 'বাংলা' হলো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের আবাস, ভূখণ্ড, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনার ঐক্য। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকার লোকেরাও বাঙালির ঐক্য বোঝাতে 'জয় বাংলা' ব্যবহার করে। এর আগে বাঙালি কখনো এত তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয়নি, যাতে একটি শব্দবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ।


বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ (১৮৮২), মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো’ (১৯৪২), নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘দিল্লি চলো’ (১৯৪৩) এসব ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’ (১৯৭১) স্লোগান এমন এক যাদুমন্ত্র- যার মধ্যে নিহিত আছে বিজয়ের অসীম শক্তি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এই স্লোগান বীজমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। চার বর্ণের ছোট্ট দুটি শব্দের গতি ও শক্তি কীভাবে একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র যুদ্ধে উৎসাহিত করে দেশ মাতৃকাকে রক্ষার জন্য- পৃথিবীর ইতিহাসে ‘জয় বাংলা’ তার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ।


'জয় বাংলা’ ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের প্রেরণার উৎস। যুদ্ধ শুরুর পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে 'জয় বাংলা' স্লোগানটি ব্যবহার করা হতো। বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষরসঙ্গীত ছিল ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। সফল অপারেশন শেষে বা যুদ্ধ জয়ের পর অবধারিতভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাসিত উচ্চারণ ছিল 'জয় বাংলা'।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘...বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগানটি নজরুলের কবিতা থেকে নিয়েছিলেন।…’
২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য মহামান্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় প্রদান করেন।


‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পর জাতীয় দিবসগুলোতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকর্তা সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যাতে উচ্চারণ এবং সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ যাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন সেই নির্দেশ প্রদান করেন।


‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা প্রদান চেয়ে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বশির আহমেদ হাইকোর্টে রিট করেন। ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২ মার্চ ২০২২ তারিখে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে।


উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে (এমওডব্লিউ) ঠাঁই পাওয়ার শর্ত হলো পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে কতটা বিশাল, তা সহজেই অনুমেয়।


পশ্চিমবঙ্গে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো ভারতে বাঙালির জাতীয় সংগঠন ‘বাংলা পক্ষ’ জয় বাংলা স্লোগান দেয়।


২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির স্লোগান জয় শ্রীরাম স্লোগানের প্রত্যুত্তরে তৃণমূল কংগ্রেস ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ব্যবহার শুরু করে। নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি এই স্লোগান জয়ে সাহায্য করেছে বলে কৃতিত্বও দেন।


'...এবারেরা সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।'
জয় বাংলা আজ শুধুই বাঙালির স্বাধীনতার স্লোগান নয়, ঐতিহাসিক ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচুকরা তাঁর কোমল-কঠিত আত্মপ্রত্যয়ী, তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের ঐক্যের স্লোগান- মুক্তির স্লোগান- 'জয় বাংলা'।


পরিশিষ্ট: ১১ মে, ১৯৭১ সালে মুজিবনগর প্রেস থেকে সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রেজিস্টার্ড নম্বর-১ এবং পত্রিকাটি সরকারি অনুদান লাভ করে।


জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।


লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com