শিরোনাম
কবিতা, সম্প্রীতি ও ইতালি ভ্রমণ
প্রকাশ : ২২ জুন ২০২১, ১২:১৭
কবিতা, সম্প্রীতি ও ইতালি ভ্রমণ
মুহাম্মদ সামাদ
প্রিন্ট অ-অ+

এক.
এই লেখার শুরুতে ইতালির মিলানে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কর্তৃক আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (ইউরোপ) মি. মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খস্তুগীর বরাবর প্রেরিত একটি পত্রের বয়ান উল্লেখ করা অপরিহার্য। পত্রটিতে মিলানের কনসাল জেনারেল মিজ রোজিনা আহমেদ ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল লিখেন:


প্রিয় মহাপরিচালক,
বাংলাদেশ কন্স্যুলেট জেনারেল, মিলান এর আওতাধীন ত্রেভিসো প্রদেশের পিয়েভে দি সলিগো শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী নাগরিকের বসবাস। শহরটির মোট বিদেশি জনসংখ্যার ২৭.৬% ই বাংলাদেশী। শহরটির স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বরাবরই বাংলাদেশ কন্স্যুলেটের সৌহাদ্যপূর্ণ ও সহযোগিতার সম্পর্ক। গত বছর ১৬ই অক্টোবর [২০১৬] শহরটির নগর প্রশাসন আয়োজিত “Shared commitment for Economic and Social Development of our communities” শীর্ষক একটি সেমিনারে আমি অংশগ্রহণ করি। সেমিনারটিতে ত্রেভিসো প্রদেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ শহরের মেয়র, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কনসাল জেনারেল, ত্রেভিসো শহরের প্রিফেক্ট এবং এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প বাণিজ্য সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছিল।


০২। সেমিনারটিতে বাংলাদেশের সফল অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতায় বর্তমান বছরের ৬ই ফেব্রুয়ারি পিয়েভে দি সলিগোর নগর কাউন্সিলর জনাব রবের্তো মেনেগন আমার সাথে সাক্ষাত করতে কন্স্যুলেটে আসেন। এই সাক্ষাতের বিস্তারিত অত্র মিশনের ০২ মার্চ ২০১৭ তারিখের ১৯.০২.৩৯০২.১০১.১৬.০৩১.১৭ পত্রের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছিল। সাক্ষাতে জনাব মেনেগন আমাকে জানান, পিয়েভে দি সলিগোর সিটি কাউন্সিল শহরটিতে বসবাসরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পারিক সম্প্রীতি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বাড়িয়ে তুলতে বিভিন্ন স্কুল, এসোসিয়েশন এবং সর্বোপরি শহরটির যুব সমাজের অংশগ্রহণে শহরের ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধ একটি সিনেমাহল ত্রিয়েট্রো কারেনিতে আগামী ১২- ১৫ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত ৪ দিনব্যাপী একটি সঙ্গীত, সিনেমা ও সাহিত্যকলা সপ্তাহ আয়োজন করতে যাচ্ছে। এই সাহিত্য উৎসবের উপজীব্য হবে পিয়েভে দি সলিগোর সন্তান এবং ইতালীর প্রখ্যাত সদ্যপ্রয়াত কবি আন্দ্রেয়া যানযত্তো। এর সূত্র ধরে জনাব মেনেগন সাহিত্য সপ্তাহটিতে অংশগ্রহণের জন্য একজন বাংলাদেশী কবি/সাহিত্যিককে আমন্ত্রণ জানান ।


০৩। জনাব মেনেগনের সাথে সাক্ষাতের পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ ত্রেভিসো শহরের মেয়র ও নগর কাউন্সিলরের স্বাক্ষরিত একটি আমন্ত্রণপত্র কন্স্যুলেটের কাছে পৌঁছেছে (সংযুক্ত)। পত্রটিতে ইতালীয় সমসাময়িক সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একজন সাহিত্যিককে তার লেখনি পরিবেশনের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রেরণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নগর কাউন্সিল বাংলাদেশ থেকে আগত সাহিত্যিকের স্থানীয় আতিথেয়তার সমস্ত দায়িত্ব ও ব্যয় বহন করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে নগর প্রশাসন সাহিত্যিকের ভ্রমণ ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক ব্যয়ভার বহনের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে।


০৪। বর্ণিতাবস্থায়, ত্রেভিসো প্রদেশে বসবাসরত সকল বাংলাদেশীদের উৎসাহিত করতে এবং সাহিত্য উৎসবটিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় কবি/সাহিত্যিককে ভ্রমণ ব্যয় বহনসহ প্রেরণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অগ্রায়নের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশে অবস্থিত ইতালীয় দূতাবাস ভিসা প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকে বিধায় সম্ভব দ্রুততম সময়ে বর্ণিত বিষয়ে সদয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। শুভেচ্ছাসহ (রোজিনা আহমেদ)


চিঠিটির অনুলিপি তিনি রোমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ঢাকায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠান। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশে সরকারের তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের আগ্রহে মিলানে অনুষ্ঠেয় সংগীত, চলচিত্র ও সাহিত্যকলা সপ্তাহে (A Week to Music, Cinema and Literary Arts) যোগ দেয়ার জন্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই সাংস্কৃতিক সপ্তাহে আরো আমন্ত্রিত হয়ে আসেন মরক্কো, মেসিডোনিয়া ও নোবেলজয়ী কবি-রাষ্ট্রপতি লিওপোল্ড সেঙ্ঘরের দেশ সেনেগালের কবিরা। ফলে ইতালি ও বাংলাদেশ মিলিয়ে আমরা পাঁচ দেশের কবি-সংগীতশিল্পী ও সিনেমা নির্মাতারা এতে অংশ নিই।


২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর ভোরে ঢাকা থেকে যাত্রা করে ইস্তাম্বুল হয়ে ইতালির সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের হেরফের মিলিয়ে ১১ই অক্টোবরেই সন্ধ্যা ৭টার দিকে মিলানের ম্যালপেঁসা বিমানবন্দর পৌঁছাই। মিলানের বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের সোশ্যাল সেক্রেটারী ব্রিটিশ নারী মিজ মাইফ্যানি উডস্-জ্যাক কয়েকটি ইমেইলে সুন্দর ও পরিস্কার ইংরেজিতে ইতালির বিভিন্ন পর্যটন এলাকা, দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা সম্পর্কে আমাকে অনেক তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছিলেন- তাঁদের অফিস থেকে কাজী নাসিবুল ইসলাম বিমানবন্দর থেকে আমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবেন। গন্তব্যের দুরত্ব আমার অজানা ছিল। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার পথে নিজের দেশের মানুষ কাজী নাসিবের সঙ্গে ইতালির নানা প্রসঙ্গে কথা বলে আমার কর্মসূচি ও সম্ভাব্য দেখার জায়গাগুলোর বিষয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা নিই। এ ছাড়া ইতালির রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষিপণ্য- বিশেষ করে শত শত আঙুরের বাগান পার হতে হতে নানান জাতের আঙুর সম্পর্কে জানালেন এই প্রৌঢ় ভদ্রলোক। প্রসঙ্গত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ওয়াইন ইনডাস্ট্রির দেশ ইতালির বৈদেশিক আয়ের এক বড় উৎস ওয়াইনের কথা জানা থাকলেও রেড ওয়াইন তৈরির আঙুর যে ভিন্ন জাতের ও আকারে ছোট হয় কিছু বাগান দেখিয়ে তাও বুঝিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। প্রায় মধ্যরাতে পিয়েভে দি সলিগো শহরের হোটেল ডেল পারসোতে আমাকে নামিয়ে চলে গেলেন কাজী নাসিব। কুয়াশার পাতলা চাদর ছড়ানো ভোরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি মাত্র তিনতলা পাঁচ-তারকা হোটেলে চারিদিকে আঙুরের বাগান, সবুজ গাছপালা, স্বচ্ছ জলের সরোবর ও একটু দূরে পাশাপাশি কিছু খেলার মাঠ। পরে জেনেছি- এইসব হোটেল ফুটবল ক্লাবগুলো ভাড়া নিয়ে আশপাশের মাঠে তাদের অনুশীলন করে থাকে।


সম্প্রতি প্রয়াত কবি আন্দ্রেয়া যানযত্তোর জন্ম শহর পিয়েভে দি সলিগো। যানযত্তো জীবদ্দশায় সমসাময়িক ইতালির জনপ্রিয়, সর্বজনগ্রাহ্য ও প্রধান কবি ছিলেন। বর্তমানের কবিরাও তাঁর ভক্ত ও অনুরাগী। এই মহৎ কবির কাব্যপ্রতিভা, প্রভাব ও স্মৃতি স্মরণ করতেই মিলান থেকে একটু দূরে হলেও তাঁর জন্ম শহর পিয়েভে দি সলিগোতে এই সংগীত, সিনেমা ও সাহিত্যকলা সপ্তাহের আয়োজন। প্রাচীন সভ্যতার নিযুত লীলাক্ষেত্র ইতালির একজন কবির প্রতি নাগরিক সমাজের এমন সমীহ ও ভালোবাসায় মুগ্ধ হতে হয়। যেমন ১৯২০ সালে পরিবেশ নিয়ে সারা বিশ্বের কবিদের রচিত কবিতা-সংকলন প্রকাশ-প্রকল্প (OIKOS: POETS FOR THE FUTURE)-এর সমন্বয়ক ইতালীয় কবি-অনুবাদক স্তেফানো স্ত্রাস্সাবোসকো পিয়েভে দি সলিগোতে কবিতা পড়তে আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম শুনে আন্দ্রেয়া যানযত্তোকে নিজের ‘কাব্যগুরু’ পরিচয় দিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন এবং স্তেফানো অদ্যাবধি আন্দ্রেয়া যানযত্তোর গুণকীর্তন করে চলেছেন।


সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে আমাদের তৈরি হয়ে থাকার কথা। হোটেলের প্রাতরাশের টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকজন খাচ্ছি। সময়ের হিসেব করলে আমরা প্রায় সবাই যে সংগীত, সিনেমা ও সাহিত্যকলা সপ্তাহের অতিথি সে কথা পরস্পরের চাউনিতে কারোরই বুঝতে বাকি রইলো না। শুধু সংশয় ভেঙে কথা বলা বাকি। প্রায় ছয় ফুট লম্বা সেনেগালের কবি ইব্রাহিম এক হাতে কফি নিয়ে সবার আগে উচ্চস্বরে কথা বলতে বলতে হ্যান্ডশেক করে পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটালেন। তারপর মরক্কোর মিজ শিহাম ও ইদ্রিস আমিদ আর মেসিডোনিয়ার নম্র-লাজুক এক ‘কবিনী’- যার নাম আমি এতদিনে ভুলে গেছি। প্রচণ্ড শীতের তীব্রতা পেরিয়ে প্রকৃতি সবুজ ও সতেজ হয়ে উঠছে। তবু রোদ ঝলমলে সকালে ঠাণ্ডার কমতি নেই। আমাদের ভরা মৌসুমের চেয়ে শীতের প্রকোপ সামান্য বেশী। বলে নেয়া ভালো যে, আমন্ত্রিত চার দেশের আমরা সবাই মূলত কবি।


বাইরে দুটো গাড়ি অপেক্ষমাণ। শহরের ভাইস-মেয়র ও আয়োজনের সমন্বয়ক মি. জানেত্তি রবের্তা আর বাঙালি তরুণ শাকিবুল আলম ভূঁইয়া হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে বসে আমাদের প্রোগ্রাম বুঝিয়ে দিলেন। শাকিবুল পিয়েভে দি সলিগোর লাগোয়া কোনেইয়ানো শহরের নির্বাচিত কাউন্সিলর। বাংলাদেশের এক টগবগে তরুণ ইতালির একটি শহরে নির্বাচন করে কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হয়েছে। ওর চোখে-মুখে নিঃস্বার্থ মানবসেবার স্বপ্ন ও কর্মনিষ্ঠার স্ফুরণ। গর্বে আমার বুক ভরে যায়। তাঁরা দুজনই সকল কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। সম্পূর্ণ অন্য রকম প্রোগ্রাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, নরওয়ে, চীন ও ভারতের কবিতা-সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছি। সর্বত্রই কবিতাপাঠ, সেমিনার-ওয়ার্কশপ, প্রশ্ন-উত্তর আর আড্ডার আমেজে চলে সাহিত্যের আয়োজন। আমাদের জাতীয় কবিতা উৎসবেও তাই। এবারে ইতালির আয়োজন সম্পূর্ণ অভিনব! প্রথম তিন দিন অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১২, ১৩ ও ১৪ই অক্টোবর পিয়েভে দি সলিগো শহরের তারচো, সেরনাইয়া, ফোলিনা, মিয়ানে, মরিয়াগো, কল স্যান মার্টিনো, আউয়া, ক্যাসাগ্রানদে ও পিয়েভ এলাকার স্কুলগুলোতে আমাদের কবিতা পড়ার আয়োজন করা হয়েছে। একটি করে স্কুলে দুই দেশের কবি কবিতা পড়বেন। প্রোগ্রামে বৈচিত্র আনার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন দেশের কবিদের স্কুল অদল-বদল করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১৪ই অক্টোবর শেষ বিকেলে বালাবি ভেলিয়ের কলেজ কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুরোধে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে উপচেপড়া কবিতাপাঠের আসরটি ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য।


তিন দিনে ১২টি কবিতাপাঠে যোগ দিতে হলো। সকাল আটটা থেকে দুপুর একটার মধ্যে আমাদের কবিতাপাঠ শেষ হয়। অতঃপর দুপুরের খাবার খেয়ে হেটেলে ফিরে বিশ্রাম নেয়া। তারপর ইউরোপ-আমেরিকায় যেমনটি হয় তেমনি সন্ধ্যার আগেই রাতের খাবার খেতে ছুটতে হয়। প্রতিবার খাবারের সময় শহরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী রেস্তোঁরায় আমাদের খেতে নিয়ে যাওয়া হয়। দু’একটির কথা উল্লেখ করি। প্রথম দিন দুপুরে এক-দেড়শ বছরের প্রাচীন একটি লম্বা দালানের মাটির নিচের হলঘরে আমরা খেলাম। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার আগে বুঝার উপায় নেই যে, বেজমেন্টে এমন সাজানো-গোছানো আধুনিক একটি খাবার ঘর রয়েছে। পরের দিন রাতের খাবারের সময় নিয়ে যাওয়া হলো পুরনো এক টিনশেড রেস্তোঁরায়। চারিদিকে ফেলে রাখা হয়েছে পুরনো টায়ার; দেয়ালে ঝুলছে সাইকেলের চেইন, গাড়ির চাকার রিং, কড়িকাঠে ঝুলানো রয়েছে কিছু ছুরি-কাঁচি ও পুরনো তরবারি ইত্যাদি। কারো কাছে মনে হবে শিল্প-সুষমার সমাহার; আবার কারো মনে হতে পারে ভুতুড়ে কোন পরিত্যক্ত গ্যারেজে খেতে বসেছি। বিশ্বের এক নম্বর ওয়াইন ইনডাস্ট্রির দেশ ইতালির নরম-শক্ত পানীয়ের অঢেল পরিবেশন। ধনী দেশের খাবার টেবিলে যেমন থাকে। টেবিলে মেসিডোনিয়ান ‘কবিনী’ ও ইতালিয়ান রবের্তা ছাড়া শাকিবুলসহ আমরা পাঁচজনই মুসলমান। সবাই খেতে খেতেই কেমন যেন একটু এলেমেলো হয়ে যায়। আর বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের এক অচেনা সন্তান আমাকে সেকেলে কিংবা বোকা ভেবে সবাই অবাক হয়। মজার মানুষ সেনেগালের কবি ইব্রাহীম আমার উদ্দেশ্যে বারবার পবিত্র কোরআনের ‘সুরা এখলাস’ থেকে উচ্চারণ করে: আল্লাহু আহাদ, আল্লাহু সামাদ...। মরক্কোর শিহাম আর ইদ্রিস সব সময় আমার দুইপাশে বসে। কারণ, দুজনেই আরবিতে কবিতা লিখে; ইদ্রিস ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারলেও শিহাম ইংরেজি বুঝে না। তবে ভালো ইতালিয়ান জানে। শিহাম আর আমার মধ্যে দোভাষীর কাজ করে ইদ্রিস আমিদ। বাকি কথাবার্তা চলে ইশারা-ইঙ্গিতে।


সকল কবির হৃদয়ই ভালোবাসা আর মায়ায় ভরপুর। তারা মানুষের মনটাকে, কোমল হৃদয়টাকে খুঁজে পেলে পরস্পর কাছাকাছি হয়ে যায়- হোক না সে নিতান্ত ক্ষণিকের তরে। সব মানুষের অন্তরে একজন কবি বাস করেন। বয়সে আমার অনেক ছোট শিহাম প্রথম দিন তারচো’র তিনটি হাইস্কুলে আমার সঙ্গে কবিতা পড়েছে। পরের দিনও সে আমার জন্যে নির্ধারিত গাড়িতে উঠে বসে। কিন্তু সেদিন আমার সাথে কবিতা পড়ার জন্যে দেয়া হয় মরক্কোর ইদ্রিস আমিদ আর মেসিডোনিয়ার ‘কবিনী’কে। শিহামকে দেয়া হয় ইব্রাহিমের সাথে। সে রবের্তার কাছে গিয়ে তাকে আমার সাথে দেয়ার জন্যে আবদার করে। রবের্তা ওকে বুঝিয়ে পরের দিন ১৪ই অক্টোবর আমার সাথে প্রোগ্রাম সেট করার প্রতিশ্রুতি দিলে সে মেনে নিয়ে ইব্রাহিমের গাড়িতে গিয়ে ওঠে।


বলা আবশ্যক যে, যাবার আগেই আমাদের এক গুচ্ছ করে কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাঠাতে হয়েছিল। কবিতাগুলো ইতালিয়ান ভাষায় চলনসই অনুবাদ করে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমি বাংলায় আমার ‘ধর্ম’, ‘কাক’, ‘বনসাই’, ‘এড়াতে পারি না’, ‘শীতের সবজিরা সব শিশুকন্যা’- এইসব ছোট ছোট কবিতা পড়লে বাচ্চারা খুব মজা পায়। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কবিতা বিষয়ে এই শিশু শ্রোতা-দর্শকদের অপার আগ্রহ। উপরন্তু শাকিবুল ও জানেত্তি রবার্তে ইতালীয় ভাষায় যেখানে যেমন প্রয়োজন সেইভাবে কবিতার অর্থ, গল্প ও মর্মার্থ বুঝিয়ে দেয়। তারপর অর্জুনের তীরের মতোন একের পর এক প্রশ্নের বাণ আসতে থাকে বাচ্চাদের দিক থেকে। প্রশ্ন করার প্রতিযোগিতায় কিলবিল করতে থাকে বাচ্চারা। কার আগে কে প্রশ্ন করবে। প্রত্যেক কবির জন্যে, কবিতার জন্যে আলাদা আলাদা প্রশ্ন। যেমন: কেন কবিতাটি লিখেছ? কবিতা কি কাজে লাগে? তুমি কবি হয়েছ কেন? তোমার দেশের বাচ্চারা কি কবিতা পড়ে? ইত্যাদি সব প্রশ্ন। তারপর অটোগ্রাফের জন্যে ঘিরে ধরে চঞ্চল ছেলে-মেয়েরা। শেষের দিন বিকেলের কবিতাপাঠের সময় অটোগ্রাফ শিকারী কয়েকজনের নাম লিখে দিতে বলি। তারা হলো মেয়ে শিশু অ্যাদিসা ফেরিতি আর ছেলে শিশু মনোলোগোসো, ইম্মানুয়েল ওয়াউসু ও লিওনার্দো স্প্যাগনল। আমার এই লেখাটি কোন জনমে তাদের চোখে পড়বে না। তবু স্মৃতিটুকু থাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও উত্তর ইউরোপে কবিতা পড়ার সময় শ্রোতারা এমন প্রশ্ন করেছেন। তাই বলে স্কুলের শিক্ষার্থীরা কবিতা নিয়ে এমন ব্যাকুল হবে তা এক মুহূর্তের জন্যেও মাথায় আসেনি। হঠাৎ মনে পড়ে, ‘কিং‘স কলেজ লন্ডন’ থেকে ইংরেজ কবি জন কিটসের বেঞ্চে-বসা ভাস্কর্যের পাশে বসে আমার কন্যা নন্দিতা ছবি তুলে পাঠিয়েছে; ছবিতে কবি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে কিটসের অমিয় কথন: Sure a poet is a sage; A humanist, physician to all men.


২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় এই সাংস্কৃতিক উৎসবের মূল অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় শহরের ঐতিহ্যমণ্ডিত ও ঐতিহাসিক সিনেমা হল ত্রিয়েত্রো কারেনি’তে। এমন উপচেপড়া ঋদ্ধ-বোদ্ধা দর্শক-শ্রোতায় পরিপূর্ণ পুরনো ধাঁচের সিনেমা হল ত্রিয়েত্রো কারেনি যেন সেদিন যৌবন ফিরে পেয়েছিল। জাঁকজমকপূর্ণ এই অনুষ্ঠানে ছিল পিয়েভে দি সলিগো’র কবি-গায়ক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, যন্ত্রশিল্পী বা সব বয়সের সংস্কৃতি অনুরাগী নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য সংগীতানুষ্ঠান, সিনেমা প্রদর্শনী এবং বাংলাদেশ, মেসিডোনিয়া ও সেনেগালের আমন্ত্রিত কবিদের কবিতাপাঠ আর সাংস্কৃতিক সপ্তাহের সুন্দর অভিজ্ঞতা বর্ণনা। মেসিডোনিয়া ও সেনেগাল দূতাবাসের কর্মকর্তা আর অভিবাসী নাগরিকরা সপরিবারে সেজেগুঁজে এসেছিলেন। বাংলাদেশের শাকিব, ওর বাবা আর আমি ছাড়া তেমন কাউকে দেখিনি। অথচ এই শহরে বসবাসকারী অন্য দেশের মোট জনসংখ্যার ২৭.৬ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত।


অনুষ্ঠানের শুরুতে সমাজতন্ত্রের পতনে নানা বৈষম্যের শিকার রুমানিয়ার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন ও তাঁদের কষ্টের হৃদয়বিদারক কাহিনী নিয়ে নির্মিত একটি ছবি দেখানো হলো। তারপর ইতালির লোকজ ঐতিহ্যের কিছু যন্ত্রসহযোগে গাইলেন কাচা-পাকা শশ্রুমণ্ডিত একজন লোকসংগীত শিল্পী। অতঃপর তার-সপ্তকে সংগীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের মাতালেন একজন নারী শিল্পী। সুরের মূর্ছনায় মিলনায়তন দুলে উঠলো। আমার রক্তেও সুরের সুধার আবেশ বয়ে গেল। অতঃপর কবিদের পালা এলো। বলা যায়, আমি ব্যতীত উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের সকলেই কম-বেশি ইতালির ভাষা জানেন। আমাদের প্রত্যেকের পাশে বসিয়ে দেয়া হলো একজন করে ইংরেজি জানা দক্ষ ইতালিয়ান নারী দোভাষী যাঁরা আমাদের কবিতা ও কথা তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে পরিবেশন করলেন। আমি আমার ‘ধর্ম’ কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে সংগীত, সিনেমা ও সাহিত্যকলা সপ্তাহের প্রশংসা করলাম; এ ছাড়া আমাকে এমন একটি সুন্দর সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়ার জন্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার- বিশেষ করে সরকারের তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আমাদের দেশের খ্যাতিমান অভিনেতা-আবৃত্তিশিল্পী আসাদুজ্জামান নূর, মিলানে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মিজ রোজীনা আহমেদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মিজ সুরাইয়া আখতার জাহানসহ উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানালাম।


১৫ অক্টোবর সকালে ছিল সমাপনী কনভেনশন এবং আমন্ত্রিত কবিদের যার যার দেশজ খাদ্য পরিবেশনের মাধ্যমে দুপুরের বিদায়ী আহার। মূলত পিয়েভে দি সলিগোর সিটি কাউন্সিল শহরটিতে বসবাসরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পারিক সম্প্রীতি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বাড়িয়ে তুলতে বিভিন্ন স্কুল, এসোসিয়েশন এবং সর্বোপরি শহরটির যুব সমাজের অংশগ্রহণে ২০১৭ সালের ১২-১৫ অক্টোবর পর্যন্ত এই সঙ্গীত, সিনেমা ও সাহিত্যকলা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। উৎসবের মূল থিম বা বিষয় ছিল ইতালীয় ভাষায় Terra Mia বা আমার স্বদেশ। আর সাহিত্য উৎসবের উপজীব্য ছিল পিয়েভে দি সলিগোর সন্তান ও সম্প্রতিকালে প্রয়াত ইতালীর প্রখ্যাত কবি আন্দ্রেয়া যানযত্তো। সেই অনুযায়ী মেয়র স্তেফানো সোলদ্যান, নগর কাউন্সিল রবার্তো মেনেগন, মেসিডোনিয়া ও সেনেগালের রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ ও মরক্কোর কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের কর্মকর্তারা শহরটির অধিবাসীদের মধ্যে পারস্পারিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি ও দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বক্তব্য দিলেন। সবাই আন্দ্রেয়া যানযত্তোর কথা স্মরণ করলেন। সকলেই করতালির মাধ্যমে তাঁদের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলেন।


রাস্তার ওপারে এক বিশাল ফাঁকা মাঠের খানিকটা জুড়ে বিরাট রঙিন প্যান্ডেলের মধ্যে আমন্ত্রিত দেশগুলোর দেশজ খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে দুপুরের বিদায়ী আহারের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ, মরক্কো, মেসিডোনিয়া ও সেনেগালের প্রধান খাবার প্রস্তুত করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবার খাবার সবার জন্যে উম্মুক্ত। রাতে হোটেলে শুয়ে শুয়ে ভেবেছিলাম- এরা কি মাছ-ভাত খাওয়াবে কিনা? কিন্তু দেখা গেল বাংলাদেশের খাবার হিসেবে কাচ্চি বিরিয়ানী রাখা হয়েছে। তবে একটি নতুন খাবারের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। নাম কুসকুস। সেনেগালের প্রধান খাদ্য। দেখলাম ইব্রাহিম, শিহাম ও ইদ্রিস ওদের দেশের বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খুব খুশি মনে খাচ্ছে। ওরা জানালো কুসকুস অনেক আরব দেশের প্রিয় ও প্রধান খাবার। শিহাম ইশারায় একটু তুলে এনে আমাকে স্বাদ নিতে বললো। আমি ওর কাছে গিয়ে দেখলাম- কাউনের ভাতের সঙ্গে মিষ্টি কুমড়ো আর বেগুনের বড় বড় টুকরো দিয়ে রান্না করা গোশতের তরকারি মানেই ‘কুসকুস’। আমি টেবিল থেকে খানিকটা কুসকুস আমার থালায় তুলে নিলাম। খেতে খুবই সুস্বাদু। ছোটবেলায় আমাদের চর অঞ্চলের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কাউন ও চিনার ভাত কত খেয়েছি। কাউনের চালের পায়েস বা ক্ষীর ছাড়া আমাদের ঈদের দিনের মিষ্টান্নের কথা ভাবাই যেত না। যাই হোক, দেশজ খাদ্যের মধ্যাহ্নভোজের আনন্দের মধ্যে দিয়ে ভাঙলো সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মিলনমেলা। এবার বিদায় নেবার পালা। মুহূর্তে পরিবেশ বেদনাবিধুর হলো। ইব্রাহিম ও ইদ্রিস আলিঙ্গনে অনেকক্ষণ আমাকে বুকে চেপে রাখলো; শিহামের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমাদের চোখে তখন বিদায়ের অশ্রকণা!


দুই.


এই মাঠ থেকেই রওনা হয়ে মিলানের বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের কন্সাল মি. রফিকুল করিম সন্ধ্যার একটু আগে আমাকে ভেনিসের একটি ছোট হোটেলে উঠিয়ে দেন। হোটেল ‘টিটো’র মালিক বাংলাদেশী যুবক ঢালী আল মামুন। মামুন মনখোলা ও হাতখোলা তরুণ। আমাকে টিভিতে দেখেছে এবং কাছে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। বাংলাদেশের বহু মানুষ মামুনের এই হোটেলে অবস্থান করে ভেনিস দেখে যায়। জলের, খালের, সেতুর ও আমোদের শহর ‘অ্যাড্রিয়াটিক সাগররানী ‘(Queen of the Adriatic)’ এই ভেনিস। ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়ার মতোন রোমান ও বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের অপূর্ব সুন্দর সমাহারে নির্মিত আলো ঝলমল ভেনিসের রূপ দেখে যে কেউ মুগ্ধ ও মোহিত হবেনই। ভেনিসের রাত নেই দিন নেই। সারা পৃথিবী থেকে আসা সাদা-কালো-বাদামি ও তামাটে মানুষের উপচেপড়া স্রোত একই গতিতে যাওয়া-আসা করছে। ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত রাতের ভেনিস দেখালো মামুন।


পরের দিন ১৬ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত আবার চললো আমাদের ভেনিস ভ্রমণ। পর্যটক লঞ্চে চড়ে ভাসমান পুরনো প্রাসাদ, দালান-কোঠা, গির্জা, নতুন নতুন হোটেল-রেস্তোঁরা, চোখ ঝলসানো দোকানপাট ও দূর সমুদ্রে ক্রুজের বহুতল জাহাজ ইত্যাদি দেখা হলো। এসব এখন ইন্টারনেটে আমার বর্ণনার চেয়ে ভালো দেখে নেয়া যায়। তবু ‘পালাস্সো ডুকালে (Palazzo Ducale)’ বা ডুকালে প্রাসাদ আর ভেনিস রাজ্যের প্রাচীন রোমান ক্যাথলিক চার্চ ‘সেইন্ট মার্ক ব্যাসিলিকা’ নিয়ে দুটি কথা না বললেই নয়। এই ডুকালে প্রাসাদটি এক সময় ডোজ অব ভেনিস (উড়মব ড়ভ ঠবহরপব) বা ভেনিসের সুপ্রিম অথরিটির বাসভবন ছিল। গোথিক নান্দনিক শৈলীতে এই প্রাসাদ নির্মিত হয় ১৩৪০ সালে। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে সম্প্রসারণ, অদল-বদল আর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে ১৯২৩ সালে প্রাসাদটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। জাদুঘরে রক্ষিত সব প্রাচীন ভাস্কর্য, চিত্রকলা, তরবারি, বর্শা আর ছোরার মতোন নির্দয়ভাবে মানুষ খুন করার ভয়াবহ অস্ত্রশস্ত্রাণ, শিরস্ত্রাণ ও রাজা-রানীর পোশাক, মুকুট, বিচারকদের কাঠের আসন ইত্যাদি দেখলে ভেনিসের তৎকালীন সমাজের চিত্র অনুমান করা যায়। সবচেয়ে দুঃসহ হলো ডুকালে প্রাসাদের কারাগার। ছাদ নিচু। বন্দিরা দাঁড়াতে পারত না সোজা হয়ে। এই প্রায়ান্ধকার কারাগারের ভেতরে উঁকি দিয়ে আমার সারা শরীর হিম হয়ে আসে। দাঁড়িয়ে থেকেও মনে হয় আমি হামাগুড়ি দিয়ে আছি। মনে মনে একটু সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টায় আমার শিরদাঁড়া টনটন করে ওঠে। সত্যি বলতে কি- ছোটবেলায় যাত্রাগানে দেখা রাজা-বাদশা, সেনাপতি, রানী, রাজকন্যাদের দেখে আমার ভেতরে রাজা হওয়ার খায়েশ হতো। কিন্তু বড় হয়ে পুরনোকালের এই সব জাদুঘর দেখে, ইতিহাস পড়ে আর যুদ্ধের সিনেমা দেখে রাজপ্রাসাদে এবং যুদ্ধের ময়দানে অবলীলাক্রমে মানুষ হত্যায় ও বন্দিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণে এই আমি দিনে দিনে রাজদ্রোহী হয়ে উঠেছি। সামান্য কথা কয়টা লিখলাম এই কারণে যে, ভেনিসের অধিকাংশ পর্যটক ডুকালে প্রাসাদ জাদুঘরের খবর জানেন না। শুধু প্রাসাদ-অট্টালিকার বাইরে ঘোরাঘুরি করে, গন্ডোলায় চড়ে, ছোট ছোট দ্বীপে ছবি তুলে, খেয়ে-দেয়ে কিছু কেনাকাটা করে ভেনিস ভ্রমণ শেষ করে। তার প্রমাণ মামুন। সে অবাক বিস্ময়ে মাথায় হাত দিয়ে সেইন্ট মার্ক‘স ব্যাসিলিকা চত্বরে বসে পড়ে। ২০-২৫ বার অনেকজনকে ভেনিস ঘুরিয়ে দেখিয়েছে মামুন কিন্তু কখনো এই জাদুঘর দেখেনি।


‘সেইন্ট মার্ক’স ব্যাসিলিকা’র দিকে তাঁকালেই মুগ্ধ হতে হয়। পূর্বকালের বাইজেন্টাইন বা বর্তমান ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়ার স্থাপত্য ও নক্সা প্রভাবিত এই গির্জার নির্মাণকর্ম সমাপ্ত হয় ১০৯২ সালে। ডুকালে প্রাসাদ সংলগ্ন গির্জাটি ডোজদের ভজনালয় ছিল। ১৮০৭ সাল থেকে ‘সেইন্ট মার্ক’স ব্যাসিলিকা’ ভেনিসের ক্যাথিড্রাল। প্রাচীন গির্জাটির সিংহদরোজার উপরে ছাদের উপরিভাগে দেবদূত পরিবেষ্টিত বাইবেল হস্তে দণ্ডায়মান নগরের রক্ষাকর্তা ও যিশুখ্রিষ্টের দূত; তার নিচে তারকাখঁচিত দেয়ালের ত্রিকোণাকৃতি স্থানে সন্ত ও ভেনিসের শৌর্য-বীর্যের প্রতীক ডানাওয়ালা সিংহ; পেছনে পবিত্র ক্রুশচিহ্ন সম্বলিত গম্বুজ। ব্যাসিলিকাটির ভেতরে বহু দর্শনীয় জিনিষ রয়েছে। উজ্জ্বল সোনালী কারুকাজখঁচিত দেয়ালে খাঁটি সোনায় মোড়ানো ক্রুশবিদ্ধ যিশু; রঙিন-উজ্জ্বল ছাদের দিকে তাকালে প্রাচীন চিত্রকর্মে পবিত্র সন্ত আর দেবদূতদের অপূর্ব সমাহার; স্বর্ণ ও এনামেল নির্মিত ১০ম শতাব্দির বাইজেন্টাইনের সেইন্ট মাইকেলের প্রতিচিত্র; গির্জার ভেতরে সুরক্ষিত একটি ছোট সংগ্রহশালায় আলাদা টিকিট কেটে দেখতে হয় প্রাচীন স্বর্ণমূদ্রা, মূল্যবান রত্নরাজিসহ আরো কিছু সুন্দর ঐতিহাসিক নিদর্শন। সবই সুন্দর, মনোহর। সবই মহিমাময়। শুধু অর্জনের ইতিহাস নির্মম, করুণ!


তিন.
সন্ধ্যার একটু আগে মামুন আর ওর স্ত্রী আমেনা আক্তার বাপ্পি আমাকে ভেনিস থেকে রোমগামী ট্রেনে উঠিয়ে দিল। দ্রুতগামী ট্রেনে প্রায় চার ঘণ্টার দুরত্ব। আগেই ঠিক করা ছিল কবি নির্মলেন্দু গুণের স্নেহধন্য মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেন বাবুল আমাকে ইতালির কিছু দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবে। রোম রেলস্টেশনে নেমেই ছাতা হাতে বাবুলকে পেয়ে গেলাম। প্রথম দেখা। মনে হলো যেন আমার অনেক দিনের চেনা। আমি বাংলাদেশ সরকার প্রেরিত অতিথি কবি। তাই দূতাবাস থেকে একজন প্রতিনিধি ভদ্রলোক আমাকে নিতে এসেছেন। তার ট্যাক্সিতে করে আমরা পুরনো রোমের কেন্দ্রস্থলে পিয়াস্সা ভিত্তোরিয়া এলাকায় ভিয়া ডেল্লা মেরুলানা রোডের একটি গেস্ট হাউজে গিয়ে উঠলাম। খুব পুরনো বাড়ি। কাঠের জীর্ণ মূল দরোজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে কলাপসিবল গেটের ছোট্ট লিফটে করে ছয় তলায় উঠতে হয়। আমার সময় কম। বাবুলের সঙ্গে বসে পরের দুই দিনের একটা ভ্রমণ পরিকল্পনা করে ফেললাম। তারপর গুণদা ও আমার স্ত্রী রীমার সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। বাবুলকে পেয়েছি শুনে গুণদা খুশি হলেন। কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে সকালে আসার কথা বলে বাবুল চলে গেল।


পরের দিন সকালে এসে বাবুল ইতালিতে আমার আকুল আকর্ষণের জায়গা ভ্যাটিক্যান সিটিতে নিয়ে গেল। বাইরে থেকে ভ্যাটিক্যান সিটি মানে উচুঁ দেয়াল ঘেরা প্রাচীন শৈলীতে নির্মিত দীর্ঘাকার একটি বাড়ি, বাড়ির লাগোয়া খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সারা বিশ্বের প্রধান রোমান ক্যাথলিক গির্জা ‘সেইন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা’, পোপের প্রাসাদ আর গির্জার সামনের সেইন্ট পিটার’স স্কোয়ার মিলিয়ে মোট ১২১ একর জমির ওপর একটি আলাদা ছোট্ট শহর। ১৯২৯ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ইতালির রাজা তৃতীয় ভিক্তর ইম্মানুয়েল ও একাদশ পোপ পিয়াসের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী সে বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি থেকে ভ্যাটিক্যান সিটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। আসলে ভ্যাটিক্যান সিটি ইতালির রাজধানী রোম শহরের ভেতরে অবস্থিত পৃথিবীর অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি স্বাধীন-সার্বভৌম নগর রাষ্ট্র। মহামতি পোপ এই রাষ্ট্রের প্রধান। ২০১৯ সালের জনশুমারি অনুযায়ী এই রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৮২৫ জন। রাষ্ট্রটির রয়েছে ১০০ সদস্যের নিজস্ব সেনাবাহিনী, সিলমোহর, পোস্ট অফিস ইত্যাদি। বিশ ইউরোর টিকিট কেটে ভ্যাটিক্যান সিটি ভ্রমণ করতে হয়। ঢোকার গেটের বাইরে অনেকগুলো টিকিট কাউন্টার। অনেক বাঙালি এখানে টিকিট বিক্রির সঙ্গে যুক্ত। বাবুল ইতালি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার সুবাদে এক যুগলীগ কর্মী আগ বাড়িয়ে টিকিট এনে আমাকে লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তখন সকাল ১০টার সামান্য বেশি। একেকজন গাইড সম্ভবত বিশজনের একটি করে দর্শনার্থীর দল নিয়ে ভ্যাটিক্যন ভ্রমণে নিয়ে যান। গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় গাইড উচ্চস্বরে ভাঙা ইংরেজি উচ্চারণে বলতে লাগলেন: প্রিয় ভদ্রমহোদয়া ও ভদ্রমহোদয়গণ আমরা এখন অন্য একটি রাষ্ট্রে প্রবেশ করছি।


নানান দেশের মানুষের সহযাত্রী হয়ে ভ্যাটিক্যান সিটিতে ঢুকলাম। বলতে গেলে এর বিরাট অংশ জুড়ে ভ্যাটিক্যান জাদুঘর। ষোড়শ শতকে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। এই জাদুঘরে শতাব্দির পর শতাব্দি জুড়ে সংগৃহীত শিল্পকর্ম ও অন্যান্য বস্তু-সামগ্রীর সংখ্যা ৭০ হাজার। তার মধ্যে প্রদর্শনে রয়েছে ২০ হাজার। এখানে রয়েছে বিশ্বখ্যাত রোমান ভাস্কর ও রেনেসাঁ যুগের চিত্রকরদের শ্রেষ্ঠ আর সেরা শিল্পকর্ম। ভাস্কর্য-গ্যালারিতে যেমন রয়েছে মাতা মেরির কোলে প্রয়াত যিশু, গ্রিক বীর হারকিউলিস, রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট অগাস্তাস সিজার, রোমান সম্রাট কনস্তানতিন দি গ্রেট-এর মাতা সেইন্ট হেলেনসহ পৌরাণিক কাহিনীর অসংখ্য দেব-দেবীর ভাস্কর্য, তেমনি রয়েছে সিংহ, বাঘ, ভালুক, সাপ, বেজি ইত্যাদি বন্যপ্রাণী এবং ঘোড়া, গাধা, মেষসহ বহু গৃহপালিত জীবজন্তুর পাথরের শিল্পকর্ম। চিত্রকর্মের মধ্যে লিওয়ার্দো দা ভিঞ্চির সেইন্ট জেরোমি ইন দা ওয়াইল্ডারনেস, রাফায়েলের মেডোনা অব ফোলিগনো; দি ক্রাউনিং অব দা ভার্জিন, প্রেজেন্টেশন ইন দি টেম্পল ও তাঁর সর্বশেষ অঙ্কিত চিত্রকর্ম ট্রানসফিগারেশন; এবং জিওভান্নি বেল্লিনি, তিশিয়ান, কারাভাজ্জিয়ো, জিয়োত্তো দি বোঁদে-এর সেরা ছবিগুলো এখানে রয়েছে। বলা বাহুল্য, এখানে বেশির ভাগ চিত্রকর্মের রেপ্লিকা প্রদর্শিত হচ্ছে। আবার সময়ে সময়ে প্রদর্শনীতে ছবির বদলও হয়।


ভ্যাটিক্যান সিটি জাদুঘরের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ গ্যালারি সিস্টিন চ্যাপেল। এই হলঘরটিতে ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে একবার দেখে বেদনামথিত হয়ে দ্বিতীয়বার চোখ ফেলা খুব কষ্টকর। দেয়ালে কালচে রঙের ক্যানভাসে শুভ্র বস্ত্রখণ্ড দিয়ে যিশুর হাঁটুর উপর থেকে কোমর পর্যন্ত আবৃত। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখমণ্ডল; বুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে লাল রক্তের ধারা। এই পবিত্র কক্ষে সবাইকে নিশ্চুপ থেকে সবকিছু দেখতে ও উপলব্ধি করতে হয়। সিস্টিন চ্যাপেলের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো এর ভেতরের দেয়াল ও ছাদ ইতালীয় রেনেসাঁর পথিকৃত ভাস্কর-চিত্রকর-কবি মিকেলেঞ্জেলোর সব জগৎবিখ্যাত চিত্রকর্ম দিয়ে সুসজ্জিত। এখানে শোভা পাচ্ছে তার দি লাস্ট জাজমেন্ট, দি ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম, অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ, গার্ডেন অব ইডেন-এর মত বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম। ছবির আদম-হাওয়া থেকে শেষ বিচারের সময়ের সব নগ্ন মানবমূর্তি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস মিকেলেঞ্জেলো চিত্রকর্মগুলোর পক্ষে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। আমাদের গাইড ভদ্রমহিলা বলছিলেন: মিকেলেঞ্জেলোর যুক্তি ছিল এই নগ্নতা পবিত্রতার প্রতীক; কারণ মানুষ পৃথিবীতে আসে ও যায় নগ্ন হয়েই। ফলে জয় হয় শিল্পের ও শিল্পীর; জয় হয় রেঁনেসার ও মানব মুক্তির।


যিশুখ্রিস্টের প্রতি আমার প্রণতি জানিয়ে ব্যাসিলিকা থেকে বের হয়ে রোদ ঝলমল সেইন্ট পিটার’স স্কোয়ারে হেঁটে এপার-ওপার করে দেহ-মনে স্মৃতি মেখে নিই। ব্যাসিলিকায় পোপদের হাত নেড়ে আশীর্বাদ করার জানালাটা বারবার দেখি। কত নৃপতি-সেনাপতি, কত শক্তিধর-শক্তিহীন, কত অত্যাচারী-নির্যাতিত, কত পাপী-তাপী, কত ধনাঢ্য-ভিখিরি, কত অবোধ শিশু-নারী আর কত শুদ্ধতা প্রয়াসী মানুষের স্মৃতি বিজড়িত এই সেইন্ট পিটার’স স্কোয়ার। এখানে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ের ঘোরলাগা চোখে শেষবারের মতন চারিদিক দেখে নিই। বিকেল তিনটের পরে স্কোয়ারের সামনের সড়ক থেকে বাবুল আমাকে তুলে নেয়। আমার তো কম সময়ে অনেক কিছু দেখার আগ্রহ। আমরা কাছেই একটি সুউচ্চ বৃত্তাকার দুর্গ দেখতে যাই। নাম ক্যাসতেল্লো সান্তা অ্যাঞ্জেলো- ইংরেজি নাম ‘ক্যাসেল অব হলি অ্যাঞ্জেল’। ১৩৪ থেকে ১৩৯ সালের মধ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল ইতালির দীর্ঘ নদী তিবের-এর দক্ষিণ তীরে রোমান সম্রাট হ্যাদ্রিয়ান ও তাঁর পরিবারের সমাধিসৌধ হিসেবে। ‘ক্যাসেল অব হলি অ্যাঞ্জেল’ সেই সময়ের রোম শহরের সর্বোচ্চ অট্টালিকা ছিল। ২১৭ সাল পর্যন্ত পরবর্তী রোমান সম্রাটদের এখানে সমাহিত করা হয়। তবে চৌদ্দ শতাব্দির শুরুতে পোপদের বসবাসের জন্যে এটিকে সুরক্ষিত দুর্গে রূপান্তরিত করা হয়। স্থাপন করা হয় কারাগার ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্যে একটি আভ্যন্তরীণ ছোট্ট চত্বর। পাদ্রিরা এই কারাগারে বন্দি করে রেখেছিলেন ইতালির প্রখ্যাত গণিতবিদ-মহাবিশ্ববিজ্ঞানী-কবি গিয়োরদানো ব্রুনোসহ অনেক কবি-দার্শনিক ও বিজ্ঞানীকে। বহু-বিশ্বতত্ত্ব উদ্ভাবনের অপরাধে এই কারাগারেই ছয় বছর বন্দি করে রাখার পর ১৬০০ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ব্রুনোকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। মহাকাশ বিজ্ঞানের আজকের অগ্রগতির পেছনে মানুষের অকাতর আত্মত্যাগ ও অসামান্য অবদানের কথা মনে করে আমাদের মস্তক অবনত হয় বৈকি।


‘ক্যাসেল অব হলি অ্যাঞ্জেল’ দেখে সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি লোকমান হোসেনের রেস্তোঁরায় দুপুরের খাবার খেলাম। তিনি খাবারের দাম তো রাখলেনই না আরও কিছু সঙ্গে দেবার চেষ্টা করলেন। সন্ধ্যায় শরিয়তপুরের টিটো খানের অভিজাত রেস্তোঁরায় আমাদের দাওয়াত দিয়েছেন ইতালি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আবদুব রব মিন্টু। মিন্টু বাবুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার কথা শুনে রেস্তোঁরার স্বত্বাধিকারী টিটো খান এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং খাদ্য ও পানীয়তে টেবিল ভরিয়ে তুললেন। টিটো খান জানালেন- তার দুবাইতে আরও দুটি বড় রেস্তোঁরা আছে। আমাকে অগ্রিম নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন। টিটো খান ধনাঢ্য হলেও অহংকারী নন। আমি স্বল্পাহারী মানুষ। টিটো খানের অনুরোধে আরেক দফা সালাদ খেয়ে বিদায় নিলাম।


চার.
পরদিন (২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর) সকালে আমার গন্তব্য ছিল নেপলস প্রদেশের ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আর তার জলন্ত লাভায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বিখ্যাত পম্পেই নগরী। ইউরোপ-আমেরিকার মত ইতালিতেও আমাদের দেশের অনেক লোক নিজের গাড়িতে করে পর্যটকদের নিয়ে সিসিলি, ভেনিস, ফ্লোরেন্স, মিলান ঘুরিয়ে দেখান। বাবুল আমার জন্যে আরিফকে ঠিক করে দিয়েছে। আরিফের গাড়িতে করে সকাল আটটায় নেপলসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সুন্দর সড়কের দুইপাশে দিগস্ত বিস্তৃত ফসলের সমারোহ ও আঙুরের বাগান। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সবুজ চা বাগান। ইতালি সারা ইউরোপে খাদ্য, শাক-সবজি, মাছ-মাংস ও ফল-মূলের প্রধান রফতানিকারক দেশ। পথে যানজট থাকায় আমরা সকাল ১০টার কিছু পরে ভিসুভিয়াস পর্বতে পৌঁছলাম। গাছপালা-ঝোঁপঝাড়ে ভরা চাক্রাকার পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে ভিসুভিয়াসের চূড়ায় উঠতে হয়। ইতিমধ্যে অসংখ্য বাস-গাড়ি নিয়ে পর্যটকরা এসে পৌঁছে গেছেন। একটা জায়গার পর পর্যটকদের গাড়ি যাওয়া বারণ। এখানে বড় করে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয়া যেত। কিন্তু ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। টিকিট কেটে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ছোট ছোট বাসে চড়ে জ্বালামুখের গোড়ায় আসা-যাওয়া করতে হয়। তারপর কিছু দূর পায়ে হেঁটে জ্বালামুখে দেখতে উঠতে হয়। উন্নয়নশীল দেশের মতোই নীল পলিথিন বা ছোট্ট ঘরে কাঠের চৌকি পেতে চা-বিস্কুট-কলা- কোমল পানীয় আর চায়ের দোকান সাজিয়ে বসেছেন স্থানীয় লোকজন। জ্বালামুখের গোড়ায় আবার টিকিট কিনতে হয়। তারপর নিচের প্রান্ত লোহা দিয়ে বাধাই করা কাঠের লাঠি ধরিয়ে দিতে কিছু লোক কয়েক কাড়ি লাঠি নিয়ে বসে আছেন। বিনীত ভঙ্গিতে লাঠিটি ধরিয়ে দেন- যেন খুব সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। আর নামার পথে ভিন্ন চেহারা তাদের। অতি ত্রস্তে কেঁড়ে-ছিঁড়ে লাঠির ভাড়া বাবদ কমপক্ষে পাঁচ ইউরো আদায় করে নেয়।


যাই হোক, লাঠি ভর দিয়ে দিয়ে জ্বালামুখের পথে এগিয়ে চললাম। পোড়ামাটির কালো ছাইভরা অমসৃণ ঊর্ধমুখী পথে হাঁটতে মানুষের কষ্ট হয়। সামান্য পথ যেন ফুরোয় না। ভিসুভিয়াসের কথা ছোটবেলায় কবিতায় পড়েছি। এই ইতালিতেই যে ভিসুভিয়াসের অবস্থান সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। রোমে পৌঁছার দিন রাতে বাবুল ভিসুভিয়াসের কথা বলতেই পণ করেছিলাম- আর কিছু না হোক ভিসুভিয়াস দেখে যাব। অবশেষে ঘেমে-নেয়ে ভিসুভিয়াসের জ্বালামুখে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়ালাম। জ্বালামুখ বলতে ভিসুভিয়াস পর্বতের চূড়ায় বিশাল গোলাকার এক গভীর গর্ত। এক প্রান্তে এখনো ধীরে ধীরে সামান্য ধোঁয়া উড়ছে। ধোঁয়াসহ জ্বালামুখের এক কিনারে দাঁড়ানো আমার কয়েকটি ছবি তুলে দিয়েছিলেন প্রায় সর্বাঙ্গে ট্যাটু আঁকা দুই পর্যটক তরুণী। কখন যে অগ্নি উদ্গিরণ শুরু হয় কেউ বলতে পারে না। ভয়ও করে। মানুষজন এসে কিছুক্ষণ করে দেখে বিদায় নিচ্ছে। নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, আমি ভিসুভিয়াসের জ্বালামুখের উপরে দাঁড়িয়ে আছি। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে ডানে নিচে নেপলস উপসাগর আর পেছনে ৯ কিলোমিটার দূরে ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াসের জ্বলন্ত লাভার আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বখ্যাত পম্পেই প্রমোদ নগরী। খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরিতে বহুবার অগ্নুৎপাত ঘটেছে। এই সব অগ্নুৎপাতের স্থায়িত্ব ছিল পাঁচ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত। ভিসুভিয়াসের ইতিহাসে ৭৯ খ্রিস্টাব্দের অগ্নুৎপাত এতই বড়, ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্বক ছিল যে তা শুধু পম্পেই নগরীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে নি- এই অগ্নুৎপাতের ছাইয়ে তখন পুরো দক্ষিণ ইউরোপ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।


পাঁচ.


বিকেল চারটার মধ্যে রোমে ফেরার কথা। রোম শহরে বড়দিনসহ নানান নাগরিক উৎসব- অনুষ্ঠানস্থল পিয়াস্সা ডেল পপলোর পাশে ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি মিউজিয়াম’-এর সামনে বাবুল অপেক্ষা করবে। আমি সময়ের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে আরিফের সঙ্গে পরামর্শ করে বাইরে থেকে পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ দেখে, কয়েকটি ছবি তুলে ও কিছু খেয়ে রোমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমরা ঠিক সময়েই বাবুলকে মিউজিয়ামের পাশে পেয়ে গেলাম। আরিফকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত টিকিট কিনে বাবুল আর আমি মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম। এখানে ঢোকার মুখে জাদুঘরে কর্মরত এক তরুণ জানালেন- এটি লিওনার্দোর শিল্পকর্মের একটি ছোট রেপ্লিকা মিউজিয়াম। তাতে কি? ভুবনবিখ্যাত মোনলিসা, রেনেসাঁ চিত্রকর্মের অন্যতম সেরা মুর‌্যাল লাস্ট সাপার, অস্ত্রশস্ত্র তৈরির মেশিন, হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপী; তাঁর ছবি আঁকার খাতা দেখে তৈরি ইতালিয়ান কারুশিল্পিদের নির্মিত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি দেখে; মানুষের মেধার তীক্ষ্ণতম ধার দেখে বিস্ময়ে হতবাক ও মুগ্ধচিত্ত ফিরে আসতে চায় না। হায়, ‘সময় বহিয়া যায়’। তবু ঠোঁটে রহস্যময় হাসি নিয়ে মোনালিসা তাঁকিয়ে থাকে। মোনলিসার পাশে দাঁড় করিয়ে বাবুল আমার একটা ছবি তুলে দিল। জনান্তিকে বলে রাখি- প্রকৌশলী-স্থপতি-বিজ্ঞানী-উদ্ভাবক শরীরবিদ্যাবিশারদ-শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল, জ্ঞানী ও গুণী মানুষ বলে মনে করি।


লিওনার্দো দা ভিঞ্চি মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে কলোসিয়ামে পৌঁছে দেখি টিকিট কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হলো না। তবু কলোসিয়াম সম্পর্কে দু’কথা বলি। ফ্লেভিয়ান রাজবংশের রোমান সম্রাট ভেসপিয়ানের শাসনামলে আরম্ভ হয়ে তাঁর দুই পুত্র সম্রাট তাইতাস ও সম্রাট দমিতিয়ানের হাত দিয়ে ৬৯ থেকে ৯৬ সালের মধ্যে কলোসিয়ামের নির্মাণ সমাপ্ত হয়। আজ পরিত্যাক্ত হলেও মূলত প্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীর বৃৃহত্তম এম্ফিথিয়েটার বা মুক্ত গ্যালারি এই কলোসিয়াম। গ্রিসের এম্ফিথিয়েটারের ধ্বংসাবশেষ দেখেছি। তা আকারে কলোসিয়ামের তুলনায় অনেক ছোট। এই কলোসিয়ামে কমবেশি ৬৫ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে গ্র্যাডিয়েটর বা প্রাচীন রোমের সশস্ত্র মল্লযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘৃণ্য অপরাধী-বন্দি আর হিংস্র বন্য জানোয়ারের সঙ্গে নৃসংশ প্রতিযোগিতায় খুনোখুনির নির্দয় আনন্দ উপভোগ করতেন। ইতালির অন্যতম প্রধান প্রতীক কলোসিয়ামের চারিদিকে ঘুরে-ফিরে এর আশ্চর্য স্থাপত্যশৈলী ও শক্তিশালী কাঠামো পর্যবেক্ষণ করতে করতে বাবুলের বাসায় রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ পালনে অগ্রসর হই।


ছয়.
বাবুলের স্ত্রী মাহফুজা আক্তার হরেক রকমের বাঙালি খাবার তৈরি করেছে। আমি এক সপ্তাহ পর মাছে-ভাতে বাঙালির জীবন রক্ষাকারী খাদ্য গ্রহণের সুযোগ পেলাম। বাবুলের মেধাবী পুত্রদ্বয় তুহিন ও সুফিয়ান আমার সঙ্গে খেলো। আমার এক ছোট বোনের নাম মাহফুজা। বাবুলের স্ত্রী মাহফুজা সেই থেকে আমার জন্মসহোদরার মতোন হয়ে গেছে। ভেনিসের মামুন-বাপ্পি আর রোমে বাবুলদের ভালোবাসার ঋণ কোনদিন শোধ করা যাবে না। আমার কন্যা নন্দিতাও ওদের আতিথেয়তায় গ্রিস ও ইতালি বেড়িয়ে এসেছে। ছেলেদের ভালো শিক্ষাদানের জন্যে মাহফুজা ও বাবুল এখন লন্ডনে। ওখানেও ওরা ‘কিং’স কলেজ লন্ডন’-এ পিএইচ. ডি গবেষণারত আমার কন্যাকে আগলে রাখছে। বলা বাহল্য, খাওয়া-দাওয়া শেষে বাবুল আমাকে গেস্ট হাউজে পৌঁছে দিয়ে গেল। পরদিন সকালে আমাদের দূতাবাসের সেই প্রতিনিধি ভদ্রলোক আমাকে রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি-ফিউমিসিনো বিমানবন্দরে পৌঁছে দিলেন।


লেখক; উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/নাঈম

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com