শিরোনাম
তৃতীয় লিঙ্গের কাছে শিক্ষনীয়
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২১, ১৯:০০
তৃতীয় লিঙ্গের কাছে শিক্ষনীয়
প্রফেসর ড. মো. নাসিরউদ্দীন মিতুল
প্রিন্ট অ-অ+

বাইরে হালকা বৃষ্টি। এসিটা কাজ করছে না। জানালা খুলে গাড়ি চালাচ্ছি। লোকেশন-সাইন্স ল্যাব। ঠিক ফুট ওভার ব্রিজের নীচে। গন্তব্য আজিমপুর নিজের বাসা। সময় রাত ৯টা ১৫ মিনিট হবে হয়তো। সহসা ৬ ফুট লম্বা দেহাতী এক নারী জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে নতজানু হয়ে একবারে মুখের কাছে এসে বললো, ‘দে, কয়টা টাকা ভিক্ষে দে’। আমি পকেটে রাখা মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতেই খ্যাট করে দরজা বন্ধের শব্দ পেলাম। তাকিয়ে দেখি কয়েকজন আমার গাড়িতে উঠে বসেছে। দু’জন পিছনের সিটে আর একজন সামনে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঝাপটা মেরে আমায় জড়িয়ে ধরে তিনজনই ধস্তাধস্তি শুরু করে দিলো। ফিসফিসিয়ে মেয়েলী কন্ঠে হুমকির সুরে বলে যাচ্ছে ‘তাড়াতাড়ি মানিব্যাগটা দিয়ে দাওগো সোনা। এই দেখো পুঁটলি। সব মরিচের গুঁড়া আছে এতে। একটা কথা বললে চোখে লাগিয়ে দিব কিন্তু। তখন কি হবে জানো? তুমি আর চোখে দেখবে না। চোখ দু’টো নষ্ট হয়ে যাবে’।


তীব্র ঘামের বিশ্রী গন্ধে ওষ্ঠাগত প্রাণ। বুঝতে বাকি নেই যে আমি সঙ্গবদ্ধ হিজড়া ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েছি। আমার সামনে আরেকটি সাদা প্রাইভেট কার। পিছনে কেউ নেই। হালকা বৃষ্টির কারণে ট্রাফিক পুলিশও আশেপাশে দেখছি না। চিৎকারের সাহস হারিয়ে ফেলেছি। এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম-‘একদম গা ছুঁবে না। ঠিকাছে, দিচ্ছি। মানিব্যাগে টাকা বেশী নেই। হাজার দু’য়েক হবে হয়তো। দরকারী কাগজপত্র রেখে শুধু টাকা ক’টা নিয়ে মুহূর্তেই ওরা চম্পট!


সিগন্যাল ছাড়লো। গাড়ি নিয়ে ততক্ষনে আমি টিটিসি’র উল্টো পাশের স্পিডব্রেকার পর্যন্ত চলে এসেছি। হঠাৎ মনে হলো আমার মোবাইল? এখানেইতো ছিল। ড্রাইভিং সিটের বাম পাশেইতো রেখেছিলাম। কই তাহলে? ইস, এই কয়েকদিন আগে লন্ডন থেকে নিজে শখ করে কিনে এনেছিলাম। নকিয়া ফোল্ডিং সেট। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। দৌড়ে পিছনের ওভারব্রিজ পেরিয়ে বিসিএসআইআর পর্যন্ত চলে আসি। দেখা হয় ট্রাফিক পুলিশের সাথে। বলমাম ঘটনা। কোনো বিকার নেই তাতে। চোখের সামনে অনেকেই নাকি ৪/৫ জন হিজড়াকে এ্যালিফেন্ট রোডের দিকে দৌড়ে যেতে দেখেছে।


এতক্ষণে মনে পড়লো-আরে আমিতো রাস্তায় গাড়ি চালু অবস্থায় রেখে এখানে চলে এসেছি। সর্বনাশ! কেউ যদি গাড়ি নিয়ে চম্পট দেয়? ফিরে এসে দেখি আমার গাড়ির পিছনে বিশাল লাইন। হর্ণের শব্দে অস্থির পথচারী। নেমে এসে কেউ কেউ দেখছেন ড্রাইভারবিহীন চালু গাড়ি রাস্তায় পড়ে আছে। অবাক হন সবাই! এসেই সকলের নিকট দুঃখ প্রকাশ করে গাড়ি সাইড করে কিছুক্ষণ দম নিই।


মোবাইলের জন্য মনটা খারাপ হয়। প্রচন্ড জিদ হয় হিজড়াদের এমন অদ্ভুত কাণ্ডে। ২০০৯ সালের ঘটনা এটি। দীর্ঘদিন এ জিদ আমি পুষে রাখি। ওদের কাউকে পথে দেখলেই মনে হতো নেমে গিয়ে মারধর করি, নচেৎ পুলিশে দিই।


এখন আর আমার তা মনে হয় না! করোনাকালীন ওদের সাহসী ভূমিকা আমার সেই জিদের বরফ গলিয়ে এখন শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় পর্যবসিত করেছে। অবাক হই ওদের এমন মানবিকতা দেখে। অবস্থা এখনতো আর নিউ নর্মালে নেই। এখন সবটাই এ্যাবনর্মাল। বাবা আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, আর আদরের সন্তান তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিজের নামে নিতে ‘পাওয়ার অব এ্যাটর্নী’র দলিল নিয়ে হাসপাতালে প্রহর ঘুনছে। মরে গেলে দাফনের নাম নেই। অথচ সম্পত্তি ভাগাভাগির নিষ্ঠুর খেলায় মত্ত। অসহায় বৃদ্ধা মাকে রাস্তায় ফেলে পলায়নকারী সন্তান দুহাতে আলিশান বাজার করে নিজের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কি ঘটা করেই না রসনা বিলাস করছে! সেহরী আর ইফতারিতে কব্জা ডুবিয়ে খেয়ে আবার আয়েশি ঢেঁকুর তুলছে। মায়ের কথা ভাবার সময় কই তার? কি করে বলি এটা নিউ নর্মাল? এটা অবশ্যই একটা নিউ এ্যাবনর্মাল সিটুয়েশন বিরাজ করছে সর্বত্র।


অথচ এমন পরিস্থিতিতে তোমরা হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়ে করোনার রোগী আসা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে তার স্ট্রেচার কিংবা হুইল চেয়ার ধরে পরম মমতায় গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছো। লকডাউনে যাদের বাড়িতে খাবার নেই তাদের খাবার সরবরাহ করছো। যারা বাড়ির বাইরে বের হতে পারছে না তাদের কাছে প্যাকেট পৌঁছে দিচ্ছো। এমনকি অসুস্থ রোগীদের বাড়ি থেকে এনে হাসপাতালে পৌছে দেয়ার মতো কাজগুলো করছো তোমরা। স্যালুট তোমায়। ভয়কে জয় করেছো। ঢাকা মেডিক্যালের সামনে অধীর আগ্রহ নিয়ে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে জানতে চেয়েছিলাম, ‘কেন ঝুঁকি নিয়ে এসব করছো’। ঝর্নার উত্তর, ‘সমাজ কখনো আমাদের মানুষ মনে করেনি। নিজেকে মানুষ প্রমানের এইতো সুযোগ। তাছাড়া সকলকেই একদিন মরতে হবে। একটু ভালো কাজ করে যদি মরতে পারি, তাহলে সবাই আমাদের কথা মনে রাখবে।’


আমার রাগ গলে বরফ হয়। চোখে পানি আসে। মনে মনে ভাবি সেদিন যখন মোবাইলটা ছিনতাই করে উর্ধশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছিলে, পিছু ধাওয়া করে পেলে হয়তো নিজের হাতে পেটাতাম, নাহলে গণ-পিটুনীর জন্য জনগণের হাতে ছেড়ে দিতাম কিংবা পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতাম।


আজ তুমি পেরেছো। সব ঘৃণাকে পরম শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় রূপান্তরিত করতে পেরেছো। তুমিই সত্যিকারের মানুষ। তুমিই ফ্রন্টলাইনার। কে বলে তুমি তৃতীয় লিঙ্গ? তোমাকে হিজড়া বললে ওরা কারা? যারা আইসিইউতে বাবাকে রেখে ‘পাওয়ার অব এ্যাটর্নী’র জন্য কামড়াকামড়ি করছে। যারা মাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে কব্জা ডুবিয়ে সন্তানদের নিয়ে গলাসমান ভক্ষন করছে। সামান্য অর্থ খরচের ভয়ে যারা বিনা চিকিৎসায় করোনা আক্রান্ত অসহায় মা-বাবাকে তিল তিল করে পরপারে পাঠিয়ে দেয়ার বিবেকহীন কর্মটি করছে, তারা তাহলে কি? কে বলে মানুষ তারে? হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ প্রকৃতপক্ষে তথাকথিত এসব ভদ্রলোকেরা নয় কি?


একাকী বসে ভাবি। আমার মোবাইল গেছে যাক। আমার আরও কিছু যাক। আফসোস নেই। আমিতো আর মানুষ হতে পারিনি। এমন করোনায়ও কিছুই শিখতে পারিনি। তুমি যা শিখিয়ে গেলে তার ভাবনাটুকু একান্তই আমার থাক। এখন আর তোমায় দেখলে মোবাইল চুরির কথা মনে পড়ে না। তোমার দৌড়ে পালানোর কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে তোমার এগিয়ে আসার সাহসী গল্পের কথা। চোখে ভাসে রোগী দেখলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক, পিপিই পড়ে কি মমতায় এগিয়ে আসো তুমি, সে কথা। কল্পনায় নিই এমন আপদকালীন সময়ে নিজের বিবেকের টানে কত ঝুঁকি নিয়ে তোমার এ ছুটে চলা। সমাজ স্বীকৃতি দিবে কিনা জানি না। তবে এটুকু জানি-অন্তত সুস্থ হয়ে ফিরে আসা মানুষগুলোর কাছে তুমি র’বে নিরবে। আপন সন্তানের কাছে নিগৃহীত হলেও তুমি তাদের কাছে টেনে নিয়েছো।


ছোটবেলায় ক্লাসে স্যার শিখিয়েছিলেন, ‘Handsome is he, who handsome does’. যার বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় ‘ সুদর্শন তো সে-ই, যার কাজটা সুদর্শন’। কৌতূহল জাগে। আমি-আমরা সুদর্শনতো? ঘুমের ঘোরে সন্দেহ বাড়ে। আমি মানুষ আছিতো? তাও আবার পুরুষ মানুষ আছি কিনা? পুরুষত্ব আছেতো আমার? যদি থাকে তাহলে আমি এখানে কেন? কেন নই মানুষের পাশে? পৃথিবী জুড়ে যেখানে মুত্যুর মিছিল। ঘরে ঘরে যেখানে অভাবের হাতছানি। মানুষের কান্নায় যেখানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত। সেখানে আমি নন্দুলালের মতো এখানে কেন? ঘরে বসেও কি পারি না মানুষের দুঃখ লাগবে এগিয়ে আসতে? মানুষের এমন দশাও কি মানুষ অবলোকন করেছে শতাব্দী জুড়ে? নিজের ওপর ঘৃণা হয়। সন্দেহ প্রগাঢ় হয়। আত্মবিশ্বাসে আঘাত লাগে। এই আমি সত্যি পুরুষতো! হাত চলে যায় স্পর্শকাতর স্থানে। নাহ! সবইতো ঠিকাছে। কোথাও কোনও অসুবিধা নেই। এইতো আমি পুরুষ! তবে অসৎ, নিষ্ঠুর আর অকর্মা পুরুষরুপী অন্তঃসারশুন্য এক অপদার্থ আমি। যে কিনা আইসিইউতে বাবাকে শুইয়ে রেখে সম্পদের ভাগ বাটোয়ারায় মত্ত! যে কিনা মমতাময়ী মাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে ভাবনাহীন রাত কাটাই! হায়রে মানবতা! আমাদের এখনও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অবহেলিত তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের কাছ থেকে শিক্ষার নেয়ার আছে অনেক কিছু। দীক্ষা নেয়ার আছে মানবতার।


লেখক : ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।


বিবার্তা/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com