শিরোনাম
স্বাস্থ্যের দুর্গন্ধে দিগম্বর চোর ডাকাতরা নাচে
প্রকাশ : ০২ জুন ২০২১, ০৮:২৫
স্বাস্থ্যের দুর্গন্ধে দিগম্বর চোর ডাকাতরা নাচে
পীর হাবিবুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। একদিকে করোনার যুদ্ধ আরেকদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাত্রা নির্বিঘ্ন রাখতে সফলতা কুড়ান। দেশের শিল্পপতিরা বিশাল বিনিয়োগে অর্থনীতির অগ্রগতিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে গিয়ে করের চাপ, ব্যাংকের চড়া সুদের ঋণ বহন করেন। ঘুম হয় না। মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা লড়াই করেন। প্রবাসী শ্রমিকের রক্ত পানি করা রেমিট্যান্সে দেশে রিজার্ভ বাড়ে ডলারের। অর্থনীতি মজবুত হয়। কৃষকের পরিশ্রম, মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব তদারকিতে কৃষিতে বিপ্লবই হয় না অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখে। শিল্পপতিরা যেমন বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন তেমনি শ্রমিক তার ঘর্মাক্ত শরীরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। দেশের কলকারখানা চালু রয়েছে। করোনার মহাপ্রলয়েও মানুষ লড়াই করছে একদিকে জীবন রক্ষার আরেকদিকে জীবিকার জন্য। জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে করোনা মোকাবিলায় দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, গণমাধ্যমই ভূমিকা রাখছে না ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা বীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। প্রশাসনসহ পেশাজীবীরাও দক্ষতা দেখিয়েছেন। এমন অদৃশ্য অশুভ শক্তির আঘাত যেমন পৃথিবীতে অতীতে আসেনি তেমনি এমন লড়াইও মানব জাতিকে করতে হয়নি অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে। করোনা কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এমন কোনো পেশাজীবী নেই যারা জীবন দেননি। করোনার মৃত্যুশোক এখনো কাটেনি, করোনার ভয়-আতঙ্ক, যুদ্ধ এখনো থামেনি। কবে এ যুদ্ধ শেষ হবে, কবে করোনার মহাপ্রলয় থামবে কেউ জানে না। কেবল জানে জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে লড়তে হবে, সে লড়াই অবিরাম চলবে। সেভাবেই বিষণœ পৃথিবীর বুকে আমাদের আনন্দহীন প্রাণহীন জীবনে লড়াই চলছে।


কিন্তু এর মাঝেও আমাদের নির্লজ্জ বেহায়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির ভয়াবহতা থামেনি। এতটা ঘেন্না, এতটা করুণা দেশের মানুষের এ মন্ত্রণালয়ের প্রতি, এত অভিশাপ, তাদের অপরাধের জন্য যে তবু তারা শোধরাবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নামের দেশের সর্বাধিক আলোচিত দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়ে যেন মানুষ কাজ করে না। একদল দুর্নীতিবাজের হাতে স্বাস্থ্য খাত তুলে দেওয়া হয়েছে হরিলুট করে জনগণের অর্থ ডাকাতি করে দিনদুপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ যেন জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের মহোৎসব চলছে। এত লাজ-শরমহীন বেহায়া মানুষ হতে পারে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যেন মানুষ নয় চোর-ডাকাতের আখড়া। এ চোর-ডাকাতরা দিগম্বর হয়ে দুর্নীতিতে নেমেছে। এখানে যেন জবাবদিহি নেই, তদন্ত নেই, দুর্নীতি চুরি-চামারি বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই। কেবল লুটের বীভৎস চিত্র। এত দুর্গন্ধ আর কোনো মন্ত্রণালয় থেকে ছড়ায়নি। এত বদনাম আর কোনো মন্ত্রণালয় থেকে এভাবে বের হয়নি।


দৈনিক দেশ রূপান্তর রূপপুর বালিশ কেলেঙ্কারির মহাদুর্নীতির রিপোর্ট করার পর গোটা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু কোথাও কোনো বড় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কোথাও কোনো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট আটক হয়নি। দুদক গরিব ধরে, না হয় ডেকে নিয়ে তদন্তের নামে তাদের সমাজে দাপুটের সঙ্গে বিচরণ করার সুযোগ দেয়। স্বাস্থ্য খাতে মোতাজ্জেরুল হক মিঠু এক যুগের এক মাফিয়া ডন। দুর্নীতির বরপুত্র। অনেক কোম্পানির নামে তার লুটপাটের মহাযজ্ঞ। সে দেশের বাইরে। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। বহু লেখালেখি করেছি আমরা। বহু রিপোর্ট হয়েছে গণমাধ্যমে। কিছুই হয় না। মাঝেমধ্যে মনে হয় বোধহীন সমাজ ও রাজনীতিকে আমাদের লেখা নাড়া দিতে পারে না। একটা অশান্ত ও অস্থির নষ্ট সমাজের দিকে দিকে এত অনিয়ম, এত দুর্নীতি, এত প্রতারণা, এত বিশ্বাসঘাতকতা, লোভ-লালসা, চরিত্রহীনতাকে থামাবেন কীভাবে? প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান করোনার প্রলয় থামিয়ে দিলেও দুর্নীতিবাজদের আরও বেপরোয়া করেছে এ সময়। এ দুর্নীতিবাজদের দিকে আঙুল তুলে ঘেন্না দিলে তারা গায়ে মাখে না। এদের থুতু দিলে টিস্যুতে মুছে নেয়। এদের দুর্নীতির নগ্ন চেহারাও উল্লাস বর্বরতার যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলা সাহিত্য এত সুমধুর ভাষা দিয়েছে, এ ভাষা এসব ভয়ংকর দানব লুটেরাকে নিয়ে লিখতে গেলে ব্যবহার করা যায় না। এদের গালি দেওয়ার মতো জঘন্য ভাষাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠিকাদার ধরে লাভ কী, দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই তো নিজেদের অর্থসম্পদ রাক্ষসের মতো বাড়াতে এমন ব্যবস্থা করে দেন। তাদের দুর্নীতির টাকায় দেশ-বিদেশে অঢেল অর্থসম্পদ চাই। তাদের নির্লজ্জ ভোগের জীবন চাই। স্বাস্থ্য খাত আজ তাই ডাকাতদের কবলে।


দেশ রূপান্তরের রিপোর্টার আরিফুজ্জামান তুহীন দারুণ এক রিপোর্ট করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, ভাইরাস ও ছত্রাকের আক্রমণ শনাক্তে রোগীর মস্তিষ্কের রস সংগ্রহে ব্যবহৃত হয় বিশেষ ধরনের সুই। বাজারে এর মূল্য ২৫০ টাকা হলেও ২৫ হাজার টাকায় কিনেছেন স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিষ্ঠান শেরেবাংলানগর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া টিস্যু ফরসেপস যেখানে বাজারমূল্য ৪০০ টাকা সেখানে কেনা হয়েছে ২০ হাজার টাকায়। ৬০ টাকার ইউরিনারি ব্যাগ কিনেছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। ৮০ টাকার ক্যানুলা কিনেছে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। বাঁকানো কাঁচি বাজারে ৪০০ টাকায় মিললেও কিনেছে ১০ হাজার ৫০০ টাকায়। ২২ টাকার ব্লাড ট্রান্সফিউশন কিনেছে ৯৫ টাকায়। কি ভয়াবহ তুঘলকি দুর্নীতি এক দিনে হয়নি। সারা দেশেই স্বাস্থ্য খাতের যেখানে কেনাকাটা সেখানেই দায়িত্বশীল চোর-ডাকাতরা এভাবে বেপরোয়া হয়ে কিনছে। এদের অসৎ সাহস এক দিনে হয়নি। দিনে দিনে বেপরোয়া হতে হতে এখন গায়ের কাপড় খুলে ফেলেছে। কোনো ডরভয় নেই। জনগণের স্বাস্থ্য খাতের অর্থ লুটপাট যেন তার অধিকার। দেশে সংসদ আছে। স্থায়ী কমিটি আছে। সেখানে তলব করা হয় কি না জানা নেই। সংসদীয় তদন্ত কমিটিও করা যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু করা হয় না। সংসদ সদস্যরা এ নিয়ে বক্তব্য দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। যেন দুর্নীতি চলছে, দুর্নীতি চলবে। নির্লজ্জ বেহায়ারা দুর্নীতি করে দাপটের সঙ্গে। পদ-পদবি নিয়ে সমাজে বিচরণ করবে দম্ভ নিয়ে এমন একটা অবস্থা চলছে। এ অবস্থা, এ অন্যায় মানা যায় না। এ অপরাধ দুর্নীতি সহ্য করা যায় না। দেশের আদর্শিক ছাত্র রাজনীতির মৃত্যু না হলে প্রতিবাদ ও ঘেরাও দেখত বাংলাদেশ। কিন্তু এ দুর্নীতিবাজরা অবৈধ অসৎ পথে অর্থসম্পদের মালিকরা জানে না একদিন তাদের রুদ্ররোষে পড়তেই হবে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না।


সেই সাবরিনা ডাক্তারও মনোরঞ্জনদানে এগিয়ে করোনার ভুয়া টেস্টের কারণে এখনো জেলে। কিন্তু তাকে যারা এ সুযোগ দিয়েছিল তারা কি আইনের আওতায় এসেছে? নমুনা সংগ্রহ করে ড্রেনে ফেলে তারা মনগড়া রিপোর্ট দিত। ভুয়া টেস্টের আর এক ডন রিজেন্টের সাহেদও জেলে। কিন্তু যারা অপরাধের অন্যায়ের সুযোগ দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখানে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই আর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তায় কর্মকর্তায় বেয়াইওয়ালা সিরিজ চলছে। জেএমআইর রাজ্জাক নকল মাস্ক সরবরাহ করে মহাদুর্নীতির খবর হলেও এখনো স্বাস্থ্যের বাণিজ্যে বহাল। কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আমি কারও পদত্যাগ চাই না। বলেছি তওবা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ তো চাইবই না। এমন মন্ত্রী এ দেশে বিরল। তিনি সরকারের মন্ত্রিসভার বেস্ট কালেকশন। আওয়ামী লীগ রাজনীতির গতিপথ চিনতেও একটি বড় উদাহরণ। একদিন মাদাম তুসোয় তার মূর্তি থাকবে মনে হয়। কিন্তু দেশের গোটা স্বাস্থ্য খাতে যে দুর্নীতির ভয়াবহ নগ্ন উল্লাস চলছে তা থামাতে হবে। এটা চলতে দেয়া যায় না। এ দুর্নীতিবাজদের মোটা দাগেই ধরতে হবে। এভাবে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ গরিবের অর্থ লুট করে নিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। এই বেহায়া, চোর, ডাকাত, লোভীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতেই হবে। এর আগেও এরা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৭ লাখ টাকার পর্দার কেলেঙ্কারি করেছে।


দেশের এত উন্নয়ন এত অগ্রগতি সব ধূসর বর্ণহীন হয়ে যায় দুর্নীতির কারণে। নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে কেনাকাটা কোথায় নেই দুর্নীতি? আমাদের শেয়ারবাজারের ডাকাতির ইতিহাস আমরা ভুলিনি। কত লাখ মানুষ রিক্ত-নিঃস্ব হয়েছে, এখনো তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আমাদের ব্যাংক ডাকাতদের কথা ভুলতে পারি না। কীভাবে ঋণ নিয়ে শোধ করেনি। ব্যাংকের টাকা লুট করে বহাল আছে। বিদেশে অর্থসম্পদ গড়েছে। ব্যাংক ডাকাতরা অর্থনীতির অভিশাপ। আমাদের দুর্নীতিবাজরা দেশের শত্রু যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। সময় আমাদের হাতছাড়া হচ্ছে ব্যাংক ডাকাতদের ধরার। সময় আমাদের হাতছাড়া হচ্ছে ঘুষখোর দুর্নীতিবাজদের ধরার। কেবল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই নয়, মধ্যস্বত্বভোগী দালাল থেকে বেসরকারি খাতের অনেকেও আজ নানাভাবে অঢেল অর্থসম্পদের মালিক। এটা সমাজে বৈষম্য অস্থিরতা অশান্তি ছড়াচ্ছে। লোভ-লালসার আগ্রাসনে সমাজকে আদর্শহীন করেছে। সততা-নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধকে নির্বাসিত করেছে। এ ডাকাতদের আজ ধরতে হবে। সমাজকেও দুর্নীতিবাজদের সমীহ করলে চলবে না। এদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। ঘৃণা করতে হবে। জানিয়ে দিতে হবে এরাই ডাকাত, এরাই চোর, এরাই সমাজের শত্রু। দেশ ও জনগণের দুশমন।


যেভাবেই হোক সরকারকে এ ডাকাত-চোরদের দায় নেওয়া যাবে না। এদের রক্ষা বা আড়াল করা যাবে না। এদের শাস্তির আওতায় আনতেই হবে। দেশের গোটা স্বাস্থ্য খাতকে তদন্তের আওতায় আনা গেলে ডাকাতদের মুখোশ খসে পড়বে। একে একে বের হয়ে আসবে যত চোর, দুর্নীতিবাজ, অর্থ লুটপাটকারী বেহায়া ছ্যাঁচড়াদের চরিত্র। কেবল স্বাস্থ্য খাত নয়, একে একে সব খাতকে তদন্তের আওতায় আনলে, কার্যকর পদক্ষেপ নিলেই সুশাসন নিশ্চিত হবে। দুর্নীতির মতো সমাজের অপরাধপ্রবণ ক্যান্সারের সঙ্গে আপস চলতে পারে না। দুর্নীতিবাজরা তাদের দম্ভ আর সাহসের সব সীমা লঙ্ঘন করে আজ বেপরোয়া। এদের বিষের মাথা ভেঙে দিতেই হবে। নয় গোটা দেশকে টাইটানিকের মতো ওরা দুর্নীতির অতল গভীরে ডুবিয়ে দেবে। তার আগেই চোর-ডাকাতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে লাগামটা টেনে ধরে দেখাতে হবে দুর্নীতি করে রেহাই পাওয়া যায় না। যাবে না।


লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com