এসো হে বৈশাখ
তিমিরবিনাশী স্বপ্নে বর্ষবরণ
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৮
তিমিরবিনাশী স্বপ্নে বর্ষবরণ
সামিনা বিপাশা
প্রিন্ট অ-অ+

পহেলা বৈশাখ দুয়ারে দাঁড়িয়ে। বিদায়ী বছরের চৈত্রসংক্রান্তির উৎসবের সুরেই বেজে উঠবে বর্যবরণের আনন্দধ্বনি। ১৪ এপ্রিল, শনিবার বৈশাখের প্রথম প্রভাতে নানা আয়োজনে সারা দেশে বরণ করা হবে ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। বরাবরের মতই রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপনের সূচনা হবে রাজধানীতে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হবে বর্ণিল মঙ্গল শোভযাত্রা। সেইসাথে দেশব্যাপী প্রতিবারের মতোই বৈশাখী অনুষ্ঠান, মেলা, খেলাধুলাসহ থাকবে ঐতিহ্যের সব আয়োজন।



বাঙালির বর্ষবরণের দিন পহেলা বৈশাখ। বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ। গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। এই দিনটি মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, হালখাতা ইত্যাদি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রাকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে।



কবি জীবনানন্দ দাশের 'তিমির হননের গান' কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। এই প্রতিপাদ্যকে সমুন্নত রেখে প্রতিবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা অনুষদ আয়োজন করছে মঙ্গল শোভাযাত্রার। যেটিকে ঘিরে ক্যাম্পাসে শুরু হবে পহেলা বৈশাখ ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এছাড়াও সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর রমনা বটমূলে গান, কবিতা ও নানা আয়োজনে নববর্ষকে বরণ করে ছায়ানট— গান-কবিতায় মুখর হয়ে ওঠে পুরো প্রাঙ্গণ। সেই সাথে, সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্যমণ্ডিত এই উৎসব ঘিরে চলে মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেশিয় খেলাধুলাসহ আরো সব লোকশিল্পের আয়োজন




বাঙালি চেতনার মূলে রয়েছে অসাম্প্রদায়িকতা। এই চেতনা উপজীব্য করে হাজার বছর ধরে বাঙালি সমাজের গড়নই এমন যে, এখানে সবাই যার যার মতো করে জীবনকে যাপন করতে পারে এবং নিজস্ব রীতিনীতি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ধর্মানুযায়ী আচার ও ধর্ম পালন করতে পারে। সে কারণেই পহেলা বৈশাখের উৎসবে সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ অংশগ্রহণে এই উৎসব হয়ে উঠেছে সার্বজনীন।




ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে "বঙ্গাব্দ" বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত।



এবার বাংলা নববর্ষ উদযাপনে ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বুধবার (২৭ মার্চ) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১৩ দফা নির্দেশনার কথা জানানো হয়।


মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাগুলো হলো



১. দেশব্যাপী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানসমূহে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও আয়োজকবৃন্দ সমন্বয় করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।
২. রমনার বটমূল, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাতিরঝিল ও রবীন্দ্র সরোবরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সুইপিং, ডগ স্কোয়াডসহ বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়া হবে। এসব অনুষ্ঠানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় ফোর্স ও গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ নজরদারি থাকবে।
৩. বাংলা নববর্ষ উদযাপন নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
৪. বাংলা একাডেমি ও বিসিক থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নববর্ষের মেলায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
৫. রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাতিরঝিল ও রবীন্দ্র সরোবরসহ দেশে যে সকল অনুষ্ঠান হবে তা সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শেষ করতে হবে।
৬. বর্ষবরণ অনুষ্ঠানগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে। নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সমন্বয় করে নিরাপত্তা দেবে।
৭. নববর্ষে কূটনৈতিক এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও স্থাপনার বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হবে।
৮. নববর্ষ উদযাপনকালে ঢাকা মহানগরের অনুষ্ঠানসমূহে ও সারা দেশে অনুষ্ঠেয় অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ও অ্যাম্বুল্যান্সসহ ফায়ার সার্ভিস টিম থাকবে। মেডিকেল টিম থাকবে।
৯. বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ইভটিজিং, ছিনতাই/ পকেটমারসহ যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট ও গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োজিত থাকবে।
১০. বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো নিষিদ্ধ থাকবে।
১১. নববর্ষে দেশের কারাগারগুলোতে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হবে এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হবে।
১২. কোনো ধরনের ফানুস বা আতশবাজি ফুটানো যাবে না।
১৩. বাংলা নববর্ষে মাদকের অপব্যবহার রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ সালের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। গত বছরের মতো এবারও বর্ষবরণের আয়োজন বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে।


এদিন বিকেল ৫টার পর ক্যাম্পাসে ঢোকা যাবে না, শুধু বের হওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভুভুজিলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।


সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, নববর্ষের আগের দিন ১৩ এপ্রিল শনিবার সন্ধ্যা ৭টার পর ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না। নববর্ষের দিন ক্যাম্পাসে যানবাহন চালানো যাবে না এবং মোটরসাইকেল চালানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই দিন টিএসসির সামনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট বন্ধ থাকবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকতে চারুকলা অনুষদের সামনের ছবির হাট গেট, বাংলা একাডেমির সামনের গেট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের পাশের গেট ব্যবহার করা যাবে।
এছাড়া, টিএসসির সামনে বিশ্ববিদ্যালয় হেল্প ডেস্ক, কন্ট্রোল রুম এবং অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প থাকবে। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল মাঠ, টিএসসি, দোয়েল চত্বরের আশপাশ ও কার্জন হল এলাকায় মোবাইল পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হবে।



চারুকলা অনুষদ সূত্রে জানা গেছে, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ভেসে উঠবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। শোভাযাত্রার চারটি শিল্প-কাঠামোর মধ্যে বহু বর্ণে সজ্জিত বিশাল আকৃতির চাকার মাধ্যমে তুলে ধরা হবে দেশের অগ্রযাত্রার চিত্র। এর সঙ্গে থাকবে হাতি, শিশু ও গন্ধগোকুলের অবয়ব। গাছবিহারী গন্ধগোকুল ইঁদুরসহ পোকামাকড় খেয়ে ফল-ফসলের উপকার করে। সে বিবেচনায় বিপন্ন এই প্রাণীর কাঠামো ঠাঁই পেতে যাচ্ছে এবারের শোভাযাত্রায়। শিল্প-কাঠামোগুলোর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় হবে ২৩ ফুট দৈর্ঘ্যের গন্ধগোকুল। পহেলা বৈশাখ সকালে সড়কে বের হওয়া হাতিটির উচ্চতা হবে ১২ ফুট। শিশু পুতুলের এবং চাকার উচ্চতা হবে যথাক্রমে ১৬ ফুট ও ১২ ফুট। এই চার শিল্প-কাঠামোর সঙ্গে শোভাযাত্রার সঙ্গী হবে রাজা-রানি ও পশুপাখির মুখোশ। ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ সকাল ৯টায় চারুকলা থেকে বের হবে এই শোভাযাত্রা।



এছাড়াও, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পহেলা বৈশাখ উদযাপন এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর-মাউশি। গত ২০ মার্চ সরকারের এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ নির্দেশনা জানিয়ে দেওয়া হয়।
নির্দেশনায় বলা হয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবে। ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে প্রচার করতে হবে। সকালে আবশ্যিকভাবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে র‍্যালি করতে হবে।



সাধারণত চারুকলা অনুষদের শেষবর্ষের শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রস্তুতির দায়িত্ব পালন করেন। সে অনুযায়ী এবার ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এই দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের সঙ্গে আছেন নতুন-পুরনো শিক্ষার্থীরাও। এক শিক্ষার্থী বিবার্তাকে বলেন, আমাদের প্রস্তুতিটা বৈশাখের এক মাস আগে থেকে শুরু হয়, টার্গেট থাকে এক মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবে। এবারও আমরা আশা করছি উৎসব আশানুরূপ হবে।


গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অর্গল ভাঙার আহ্বানে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল সেটিই পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপ নেয়। ২০১৬ সালে ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এই কর্মসূচি।


চলতি বছর রমজান ও ঈদের ছুটিতে পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি বিষয়ে চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুমন ওয়াহিদ বিবার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থী কম তাই কাজের চাপ বেশি, তবে উৎসবের রঙ ফিকে হবে না। লোক সমাগম কিছুটা হয় তো কম হবে। কিন্তু ঢাকা এখন এতটাই ঘনবসতিপূর্ণ, একটা অংশ ঈদের ছুটিতে বাড়ি চলে গেলেও মানুষ আছে। কিছু মানুষ ঈদের ছুটিতে কনফিউশনেও পড়ে যায় ফাঁকা ঢাকায় কী করবে, সেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ একটা উৎসবমুখর, আনন্দঘন বিষয় হয়ে উঠবে।


গত ২১ মার্চ চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্বের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন চিত্রশিল্পী হাশেম খান। তিনি বলেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্যই এ ধরনের আয়োজন। তরুণ বয়সে আমরা রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা করিনি। নিষেধ সত্ত্বেও আমরা বন্দুকে আলপনা এঁকেছি, শহীদ মিনারে আলপনা এঁকেছি, চারুকলা ভবনের সামনে আলপনা এঁকেছি। চারুকলার তৎকালীন ছাত্র-শিক্ষকরা এই বাংলাকে জাগিয়ে তোলার জন্য ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যা যা করার দরকার তা সব করেছিলেন। আমরা চাই জনসাধারণ আমাদের সঙ্গে একাত্ম হোক। কারণ এই আয়োজন আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য।’



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বিবার্তাকে বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে কন্টিনিউ করেছি, ছেদ পড়েনি। ঈদের ছুটির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে, সেই কারণে আমাদের লোকবল কম। ছাত্র-শিক্ষকদের একটা বড় অংশ বাড়ি চলে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে যাওয়াতে আমাদের এখানে মানুষের উপস্থিতিও কম। রোজার সময় আমরা সমস্যার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু সবাই রাত দিন কাজ করে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনকে সফল করার চেষ্টা চলছে। সবমিলিয়ে চারটা মোটিফকে বড় করে উপস্থাপন করবো, এটা আসলে আমাদের লোকশিল্পের যে ঐতিহ্য আছে তার সাথে মেলবন্ধন রাখার জন্য, এবং মানুষকে তার নিজ অঞ্চলের ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য আমরা এটা করেছি।


তিনি বিবার্তাকে বলেন, এই বছর আমরা যে প্রতিপাদ্যটা করেছি এটা আসলে মঙ্গল শোভাযাত্রার এই যে দীর্ঘ পথযাত্রা সেটাকে ভালো করে লক্ষ্য করে আমরা দেখলাম যে, আমরা আসলে এখনো পর্যন্ত সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছি। মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে আমরা দুটো জিনিস রাখার চেষ্টা করি। সেটা হচ্ছে আমাদের যে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সেটাকে প্রতিপাদ্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা। এছাড়াও সামগ্রিক অনুসঙ্গেকেও তুলে ধরা। কিন্তু সেইসাথে সৃজনশীল অনুসঙ্গগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার আছে বলে মনে করি। কিন্তু সৃজনশীল শিল্পের চর্চা করতে গেলে যে পরিবেশ দরকার, যে মানসিকতা দরকার— সেটার চেয়েও এই অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইকে আমরা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। তরুণ সমাজকে দেশপ্রেমিক করার জন্য, দেশের প্রতি আরো দায়িত্ববোধসম্পন্ন মানুষ করার জন্য সেই জায়গা থেকেই 'আমরা তো তিমিরবিনাশী' প্রতিপাদ্য।


তিনি আরো বলেন, এবার আমরা জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেছি যে, মানুষকে যেন রিক্সা করে অনেকটা কাছে চলে আসতে দেওয়া হয়। দূরে হলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রোদের মধ্যে আসতে মানুষজন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।


অধ্যাপক নিসার হোসেন আরো বলেন, যেকোনো বিষয়েই নিরাপত্তাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি তারা যেভাবে এখানে অংশগ্রহণ করে সেটা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ছাপিয়ে যায়। এ বছর তারা এটা নিয়ে সচেতন আছেন, এ বছর এটা কমে যাবে কিন্তু নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না, এটাকে খাটো করে দেখা যাবে না। আমাদের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য সবচাইতে বেশি। আমরা চাই না একটা আনন্দ শোভাযাত্রার মধ্যে নিরানন্দের ঘটনা ঘটুক।


বাংলা নববর্ষকে আনন্দ আয়োজনে বরণ করে নেওয়া এবং উৎসবে উদযাপন করা নিজের অস্তিত্বকেই স্বীকার করা। নগর সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ কেবল এক দিনের উৎসব-আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং জাতীয় সংস্কৃতিতে এর প্রভাব এখনো অনস্বীকার্য। বিশ্বের সব জাতিই নিজ সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বর্ষবরণ পালন করে। বাঙালির অন্তরেও ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিতে অন্তরে বাঁজছে...


এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।


তাপসনিশ্বাসবায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,


বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥


যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,


অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥


মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,


অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।


রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,


আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।


মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥


বিবার্তা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com