শিরোনাম
রি লং পোয়ে
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:২৪
রি লং পোয়ে
প্রদীপ আচার্য
প্রিন্ট অ-অ+

পাবর্ত্য অঞ্চলের এই পাহাড়ি  জনপদে মূলত এগারোটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে চলমান সুদীর্ঘ বিশ বছরের যুদ্ধে এখানকার আদিবাসীদের জীবনে তেমন কিছুই মেলেনি, উপরন্তু ঝরে গেছে অগণিত প্রাণ আর এ অঞ্চলের অনেক আদিবাসীই সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার ও ভারতে। রাতুলদের গ্রামটিতেও একসময় ছিল অনেক পরিবারের বাস। পাহাড়ে নানান সংঘাত, বঞ্চনা, নিজ ভূমির ওপর স্বত্ব হারানোর সীমাহীন মনোবেদনায় আজ এ গ্রামেও পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র একশ আশিতে। সভ্যতার অগ্রগতির বিপরীতে ক্রমশ তাদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে দূর থেকে দূরান্তের গহীন বনে।


প্রকৃতিতে ফাগুনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ফাগুনের আগমনের সাথে সাথে আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলিতে নতুন বছরের উৎসবের আমেজ শুরু হয়েছে। এ সময়ে পাহাড়ে নানান ফুলের সমাহার বর্ষবরণের প্রস্তুতিকে জোরালো করে তোলে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি একেক জনগোষ্ঠীতে একেক নামে পরিচিত। কেউ বলে সাংগ্রাই, কেউ বিজু, কেউ বৈসাবি কেউ বা আরো হরেক নামে ডাকে। আজ চৌদ্দই এপ্রিল। রাতুলদের  জনগোষ্ঠীতে নববর্ষ আয়োজনের প্রধান আকর্ষণ জলোৎসব। এই জলোৎসবেরও রয়েছে হরেক নাম। রাতুলরা বলে 'রি লয় পোয়ে'। পুরোনোকে ধুয়ে মুছে সাফ করতে নতুন বছরের শুরুতে মঙ্গলের আবাহনে তারা একে অন্যকে জল ছুড়ে ভিজিয়ে দেয় 'রি লয় পোয়ে' নামের উৎসবে। তাদের বিশ্বাস, মঙ্গলময় এই জলে পবিত্র হয় নতুন বছর।


রোয়াংছড়ি বাজার মাঠের উত্তর দিকটায় 'রি লং পোয়ে'র জন্য রাখা হয়েছে একটি নৌকা। আগে থেকেই নৌকাটি ভর্তি করা হয়েছে জলে। আরো বেশ কিছু বড় পাত্রে রাখা হয়েছে জল। নৌকার জল শেষ হলে আবার নতুন জল ঢালা হবে সেগুলো থেকে। বাজারটাকে ঘিরে পাহাড়ী এই জনগোষ্ঠীর বসতি গড়ে উঠেছে। পাহাড়ি পথ কেটে তৈরি হয়েছে রাস্তা এবং বাজারটা। বাজারের দক্ষিণ দিকে বসেছে মেলা। মেলায় শিশুদের প্রধান আর্কষণ নাগরদোলা। বৈশাখের দুপুরে খর রোদ। ফলে নাগরদোলার আশেপাশে এখনও শিশুদের আনাগোনা তেমন নেই। সূর্যটা গড়িয়ে পশ্চিমে পড়তেই শুরু হয়ে যাবে জলোৎসব। সময়টাকে মাথায় রেখে তরুণ-তরুণীরা দল বেঁধে আশেপাশের সব পাহাড় থেকে সমবেত হতে থাকে বাজারের খোলা  মাঠে। ছেলেদের প্রত্যেকের গায়ে একই রঙের গাঢ় হলুদ গেঞ্জি, সাথে নিচে পরেছে লুঙ্গি। আর তরুণীরা পরেছে ঐতিহ্যবাহী থামি, মাথার খোঁপায় শোভা পাচ্ছে  বাহারী রঙের বুনো ফুল। তাদের কারো কারো হাতে পাহাড়ি নানান বাদ্যযন্ত্র। বাদ্যযন্ত্রের শব্দ আর তাদের গাওয়া সংগীতের সুর প্রতিধ্বণিত হয়ে পুরো পাহাড়ে নেমেছে  এক আনন্দ মূর্ছনা। একে একে মাঠের ভেতরে ঢুকতে থাকা তরুণ-তরুণীরা নৌকার কাছে আসতেই তাদের মধ্যে বিস্ময় জাগে। নৌকায় ঢালা জল মুহূর্তে কোথায় উড়ে যাচ্ছে, জলের অন্যান্য পাত্রও খালি হয়ে যাচ্ছে পলকেই! এ কীভাবে সম্ভব...!


প্রত্যেকের মুখে মুখে মুহূর্তেই বাতাসের বেগে ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়ল পুরো পাহাড়ে। বাড়ির ভেতর থেকে কেউ কেউ বলে উঠল, আমি আনছি জল, আমিও আনছি, আমরা সকলে আনছি...
কিন্তু সবিস্ময়ে তারা দেখল,  প্রতিটি বাড়িতে রাখা সবটুকু জল উধাও হয়ে গেল একই সময়ে! এ কী আশ্চর্য ঘটনা!


হায় হায় রব উঠল পাহাড়ে। শুরু হলো একে অন্যের প্রতি  অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। আদিবাসী নয়, এমন মানুষদের কাছে পাহাড় বিক্রি, মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরী মেয়ের অন্তসত্ত্বা হওয়া, বাঙালী ছেলের সাথে গ্রামের মেয়ের পালিয়ে যাওয়া... আরো আরো কথার তিরে তারা বিদ্ধ করে চলল একে অন্যকে। গ্রামের সবচেয়ে প্রবীন মানুষটি, যিনি উনিশ শ ছাপ্পান্ন সালে কাপ্তাই লেক নির্মাণের সময়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে পাহাড়ের এই অংশে আশ্রয় নিয়েছিলেন পরিবারের সাথে, আজকের এই বিপর্যয় সেদিনের চেয়েও প্রবল হয়ে  বুকে লাগল তার। এ বয়সেও কি এমন দুর্দিন দেখার ছিল!


-কপাল চাপড়ে বললেন তিনি। সবাইকে চুপ করতে বলল রাংলাই। সে গ্রামের সর্দার। তার বাবাও সর্দার ছিলেন। পৈত্রিকসূত্রে সে এই  দায়িত্ব পেয়েছে। মাঝারী বয়স, উঁচু আর সুঠাম দেহ। রাংলাই বলে উঠল, নিজেদের মধ্যে দোষারোপ করার সময় এটা নয়, চল সবাই প্রধান উপাসনালয়ের দিকে।
উপাসনালয়ে প্রবেশ করলে তারা দেখতে পেল প্রধান যাজক শত বছরেরও অধিক পুরোনো অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে আছেন। দল বেঁধে গ্রামের মানুষদের আসার কারণ তিনি ইতঃমধ্যে জেনেছেন, অপেক্ষা করছেন তাদের আগমনের। গ্রামের মানুষগুলোর মুখের কথা শুনতে শুনতে, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি আস্তে আস্তে ডান হাতের তর্জনী তুলে সবাইকে মৌন থাকার ইঙ্গিত দিলেন। একটুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে বললেন, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, বিশ্বাস রাখতে হবে পরম করুণাময়ের ওপর। সংকট যখন তিনি সৃষ্টি করেছেন তখন সমাধানের পথও নিশ্চয়ই তিনিই বলে দেবেন। মানুষ যখন দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভ করে তখন তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। বেদনাদায়ক এ অস্থিরতা তার মধ্যে জন্ম দেয় হিংস্রতার। সে তখন নিজে ধারণ করে বন্যতা। প্রাকৃতিক বন্যতার মধ্যে দেবত্ব থাকে। কিন্তু মানুষের মধ্যে যে বন্যতা, সেখানে দেবত্ব থাকে না, থাকে হিংস্রতা, থাকে পশুত্ব। প্রকৃতিকে জয় করার যে নেশায় আমরা বুঁদ হয়েছি তার খেসারত তো দিতেই হবে আমাদের। তোমরা সকলে এখন এসো।


প্রয়োজনে আমি তোমাদের ডেকে নেব।
-কথাগুলো একটানা বলে  ইশারায়  কেবল গ্রামের সর্দার রাংলাইকে অপেক্ষা করতে বলেন তিনি। গ্রামবাসীরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাদের ভাবনায় কিছু একটা চলতে থাকে। কী সে ভাবনা, কেউই বলে না কাউকে। তবে তারা না পায় স্বস্তি, না তাদের মন থেকে দূর হয় সংশয়।  


রাতুল বড়দের দিকে হতাশ তাকিয়ে থাকে। তাকে অবশ্যই নাগরদোলায় চড়তে হবে। একবার নাগরদোলা চড়তে পঞ্চাশ টাকা খরচ হয়। পাওয়া টাকা গুনে গুনে যখন সে দেখেছে পঞ্চাশের ঘর ছুঁয়েছে, তখন স্বস্তি মিলেছিল তার। বিকেলের দিকে নাগরদোলা চড়তে গেলে মা বকবে না, জেনেই তার অপেক্ষা ছিল বিকেলের। কিন্তু পাহাড়ি এই জনপদে  মুহূর্তে নেমে আসা বিষাদরাগিনী তাকে হতবিহ্বল করে দেয়। সে হতাশ চোখে তাকায়।  দেখে সকলের চোখের পাতায় নেমে আসা ভয়ানক নীরবতা। মেলার কোলাহল থেমে যায়। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার আগে এমন বিষাদময় নীরবতা আগে কখনো দেখেনি রাতুল। তার আর নাগরদোলা চড়া হয় না। মনকে সে সান্ত্বনা দেয়, অনেক বড় এখন সে। সাংগু নদীর বালিতে বসে হাঁটু জলের আয়নায় সে মুখ আর আকাশ দেখে, সেগুলো যেন নাগরদোলার মতো ঘোরে। তেরো বছরের জীবনে এতটা মন খারাপ তার  হয়নি আগে। পেছন থেকে মায়ের ডাক রাতুলের কানে আসে, রাতুল, ঘরে আয় বাবা, সন্ধ্যা যে গড়িয়ে গেল। ঘরে আয়।


নদী তীরে দাঁড়িয়ে মা ডেকে যায় তাকে। তার ভ্রম ভাঙে, নদীতে জল কই, কেবল বালু আর বালু।
বালু থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার খেয়াল করে বালুময় জল। সত্যিকারের জল। জলের ভেতর একটি মুখ। বিম্ময় জাগে রাতুলের। এ কি আবার ভ্রম, নাকি সত্যি! তার ভাবনায় সেই মুখ কথা বলে ওঠে।
রাতুল, মন খারাপ?
হু। খুব! তুমি কে? -মুহূর্তেই প্রশ্ন করে রাতুল।
আমি জলমাতা, এ পাহাড়কে ঘিরে যে জল, আমি সে জলের মা। হেসে উত্তর দেয় জলমাতা।
হি হি হি, জলের আবার মা হয় না কি? রাতুলের কৌতূহলী প্রশ্ন।
হয় রে, হয়। তাই তো তোর কাছে এলাম। -হেসে উত্তর দেয় জলমাতা। আবার জল বইবে পাহাড়ে। আবার হবে জলোৎসব।
রাতুল উত্তেজিত হয়ে বলে, কীভাবে?


জলমাতা বলে, শোন তবে, লুংলেই পাড়ার সর্বদক্ষিণে একটি বড় বাঁশবাগান আছে। সে বাশঁবাগানটি তোকে খুঁজে বের করতে হবে। বাঁশবাগানের সবচে কচি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে একটি মানুষের আকৃতি বানাতে হবে। তাকে কোনো নারীর পোষাকে আবৃত করলেই সেটি একটি কন্যাশিশু-পুতুলে পরিণত হবে। বাঁশের কচি কঞ্চি থেকে জন্মানো সে পুতুলের নাম হবে এ্যচিং। নামকরণের সাথে সাথে সে পুতুলে প্রাণের সঞ্চার হবে। এ্যচিং ইচ্ছে করলে মানুষের রূপও নিতে পারবে। এ্যচিং তোর বন্ধু হবে, তোকে পথ দেখাবে জলের জন্য কোথায় যেতে হবে, কার কাছে। আর মন দিয়ে শোন, তোর কাজ শেষ হলে এ্যচিংকে অবশ্যই আবার সে বাঁশ বাগানে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং যেভাবে তাকে প্রাণ দেয়া হবে সে কাজটা ঠিক তার উল্টো করে করলে বাঁশের কচি কঞ্চিতে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার হবে এবং এ্যচিং বিলীন হবে। আরেকটা কথা, মানুষরূপী হিংস্র কেউ যেন এ্যচিংকে না ছোঁয়। তাহলে এ্যচিংয়ের শরীরে তৈরি হবে আগুন। আগুনের সে উত্তাপে সেখানেই বিলীন হবে এ‍্যচিং।   


কথাগুলো বলেই অদৃশ্য হয় জলমাতা। আলোর ঝলকানি শেষে মুহূর্তেই গোধূলী শেষের  অন্ধকার টের পায় রাতুল। সে দৌড়াতে থাকে। কয়েক কদম গিয়ে হঠাৎ দাঁড়ায়, দিকহীন গন্তব্য তার। ভাবে, কোথায় যাচ্ছে সে? লুংলেই পাড়ার দিকে, না কি বাড়ির দিকে? মায়ের একটা কাপড় লাগবে যে। সে দৌড়ায় বাড়ির দিকে আর ভাবে, বাড়ির বাইরে মায়ের পরনের ভেজা থামিটা শুকানোর জন্য ঝোলানো ছিল দুপুরের দিকে। সেখান থেকে এক টুকরো কাপড় চুপিসারে নিয়ে তাকে যেতে হবে লুংলেই পাড়ার সর্বদক্ষিণে।
পাহাড়ে রাতের অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে। বাড়িতে বাড়িতে উৎসবের জন্য তৈরি হরেক পিঠা পড়ে থাকে অনাদরে। রাতুলের বাবা-মা এ বাড়ি ও বাড়িতে উঁকি-ঝুকি দেয়, রাতুলকে কোথাও দেখা যায় না। শুরু হয় পাড়ার লোকেরা মিলে তাকে খোঁজা। পাহাড়ের ঝোপে-ঝাড়ে চলে রাতুলের সন্ধান। রাতুল রাতুল ডাক রাতুলের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। খবরটা যায় পাড়ার সর্দারের কাছে। তিনি রাতুলের বাবা অংথুইয়ের পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দেন। অংথুই চিন্তায় অস্থির তখন।


ততক্ষণে  এ্যচিংয়ের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায় রাতুলের। পুতুলরূপী এ্যচিং কখনো রাতুলের কোলে, কখনো পিঠে চড়ে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। গন্তব্য তারাছা খালের ঝর্ণামুখের ঝিরঝিরি বাগানের পুরোনো বটগাছ।  প্রভাতের আলো ফোটার আগেই তাদের সন্ধান করতে হবে মুসিকারের। মুসিকার পবিত্র এক সুরের নাম। সে সুরের নামেই বনের এক পাখি মুসিকার। মুসিকারকে নিয়ে যেতে হবে রাতুলের গ্রামে। প্রভাতের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই মুসিকারের কণ্ঠের মূর্ছনা গ্রামের যতদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে, বিলীন হওয়া জল আবার ফিরে আসবে সেই পর্যন্ত।


ঝিরঝিরি বাগানের পুরোনো বটগাছের দিকে যত এগোয় তারা, রাত তত বাড়ে। রাতের এমন অভিজ্ঞতা রাতুলের আর কখনো হয়নি আগে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে জনমানবহীন এমন পাহাড়ে গা ছমছম করা নীরবতা। নানান শব্দ, কোনোটা বাতাসের ঝাপটানিতে পাতার মর্মর, আবার কোনোটা বাঁশের সাথে বাঁশের আঘাতের শব্দ, আবার কোথাও  কোনো পাখি ডেকে ওঠে হঠাৎ। রাতুলের ভয় হয় ভীষণ। পরক্ষণেই সাহস পায় মনে। সে অত ভাববে কেন! তার সাথে তো জলমাতার আশীর্বাদ আছে! সে এ্যচিংকে জড়িয়ে ধরে।


এ‍্যচিং বোঝে। সে রাতুলের সাথে কথা জুড়ে দেয়।
আচ্ছা, তুমি আমাকে তোমাদের গ্রামে নিয়ে যাবে তো?
হু, অবশ্যই নিয়ে যাব। -জোরালো উত্তর রাতুলের।
সে-তো নিয়ে যাবেই। কিন্তু আমাকে আবার ঠিকঠাক মতো বাঁশবাগানে রেখে আসতে হবে। তোমার মনে আছে তো?
খুব মনে আছে। - আবারও উত্তর দেয় রাতুল।
মা অনেক রকম পিঠে বানিয়েছে, তুমি খেয়ে-দেয়ে, জলোৎসব দেখে তবেই ফিরে যাবে। -রাতুলকে কথায় পায়।
দূর বোকা! আমার কি অত সময় আছে? আর আমি তো মানুষ নই, একটা পুতুল। আমি তো খেতে পারি না। -এ্যচিং বলে।
কেন কেন! জলমাতা বলেছে তুমি চাইলে মানুষের রূপও নিতে পারবে।
না না। ভয় করে! জলমাতা কী বলেছে, ভুলে গেছ? মানুষরূপী হিংস্র কেউ আমাকে ছুঁয়ে দিলে আমি কিন্তু বিলীন হয়ে যাব, তাতে তোমাদের ক্ষতি আরো বাড়তে পারে।
সে দেখা যাবে! -রাতুলের উত্তর।
আচ্ছা, তোমাকে তো বটগাছের সেই পথের সন্ধান কীভাবে করবে সেটা বলে দিলাম, আমাকে ছাড়া সেই গাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে তো? 
 -এ্যচিংয়ের কণ্ঠে  কৌতূহল।


পারব না কেন! খুব পারব! এ কথা কেন বলছ? -রাতুলের প্রশ্ন।


দেখছি তুমি কতটা সাহসী। হাসতে হাসতে এ্যচিং বলে।


আচ্ছা এ্যচিং , তোমার নামের অর্থ কী?


স্বপ্ন! বুঝলে, আমার নামের অর্থ হলো স্বপ্ন।


বাহ! খুব সুন্দর অর্থ। স্বপ্ন।


হাঁটতে আর কথা বলতে বলতে তারা বড় এক ঝিরির কাছে এসে দাঁড়ায়। জল গড়ানোর মৃদু শব্দ রাতুলের কানে বাজে। দুপুরের পর থেকে এই প্রথম তার এতটা ভালো লাগে। এ্যচিংকে বলে, এখানে খানিকটা বিশ্রাম করে আবার সে হাঁটবে গন্তব্যের দিকে। রাতুলের ইচ্ছে জেনে এ্যচিংয়ের মনে শঙ্কা জাগে। সে ভাবে, রাতুল তার গ্রামবাসীকে এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত করতে পারবে তো! 
তবুও সে রাতুলের ইচ্ছেতে সায় দেয়।


হাঁটু জলে নেমে রাতুল ঝিরির ঠান্ডা জল মুখে দেয়। তার মনে হয়, যেন মা তাকে আদর করে ঘুম পাড়াচ্ছে। তার কণ্ঠে অনেক তৃষ্ণা আর চোখে ঘুম। সে ঝিরি থেকে উঠে এ্যচিংকে কোলে নিয়ে একটি গাছের নিচে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এ্যচিং কথা বলে রাতের অন্ধকারের বুনো প্রকৃতির সাথে। চারপাশের জমাট অন্ধকার নীরবতা ভেঙে খানিকটা সরব হয়ে ওঠে। 


শেষ রাতের অন্ধকার তার অনেক কিছুই স্পষ্ট করতে চায়। জানাতে চায় এই বুনো জনপদের আলো আর অন্ধকারের সংগ্রাম, তাদের দুঃখ-বেদনার ইতিকথা। জানাতে চায় তার কোমল হৃদয়ে সভ্যতা নামক পাষাণের হিংস্র আঁচড়। তার সহজাত সবুজ বুকে সভ্যতার জবরদস্তিমূলক প্রগতি। তার ভুবনে সে সহজ সুন্দর। অনাহূত আগন্তুক সেখানে রোপণ করেছে মেকি সভ্যতা। তার সহজাতকে গলা টিপে হত্যা করতে মরিয়া মানুষরূপী বৃহৎ  এক বন্য দল।


রাত পেরোতে থাকে দ্রুত। রাতুলকে সময় মতো পৌঁছতে হবে বটগাছের কাছে। এ্যচিং ডাকতে থাকে ঘুমন্ত রাতুলকে। তার মৃদু কণ্ঠস্বর ঘুমন্ত রাতুলের কানে পৌঁছায় না। কী করবে, ভাবতে ভাবতে অগত‍্যা সে মানুষ রূপ নেয়। রাতুলের গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে সে টের পায় এই নীরবতা ভেঙে দিতে অন্য এক অচেনা শব্দ তাদের কাছাকাছি। মুহূর্তেই সে আড়াল করে নিজেকে। আড়াল থেকে খেয়াল করে, টর্চ হাতে দুজন মানুষ রাতুলের খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। রাতুলের মুখে টর্চ মেরে তারা নিজেদের মধ্যে কী সব বলে। এ্যচিং জানে, রাতুলের কথা ছাড়া অন্য কারো কথা বুঝতে পারবে না সে। সে পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। লোকদুটো তাৎক্ষণিকভাবে রাতুলের ছোট্ট দেহটা তাদের একজনের কাঁধে নেয়। এ্যচিংয়ের বুঝতে বাকি থাকে না যে, তারা রাতুলকে খুঁজতেই এ পর্যন্ত এসেছে। এবার তারা টর্চের আলোয় আরো কিছু খোঁজার চেষ্টা করে।


এ্যচিং আর এক মুহূর্তও দেরি না করে তাদের পথ আটকায়। অন্ধকারে তারা এ্যচিংকে দেখে বিস্মিত হয়। অচেনা, অদেখা আলোর বন্যা শরীরে নিয়ে এক অপার্থিব কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে রাংলাং সর্দারের পাঠানো মানুষগুলোর সামনে। এ‍্যচিংয়ের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো। লোকদুটো এসেছিল রাতুলকে খুঁজতে। মুহূর্তে তাদের মাথা থেকে  রাতুলের চিন্তা হারিয়ে যায়। এত সুন্দর কিশোরী তো তারা কখনও দেখেনি! এক কুৎসিত আদিমতার ঘোর লাগে তাদের শরীরে, মনে। মুহূর্তে কামনার ঢেউ তাদের মনে আছড়ে পড়ে। রাতুলকে কাঁধ থেকে নামিয়ে তারা জাপটে ধরতে চায় এ্যচিংকে। এ্যচিংকে স্পর্শ করতেই বিকট এক বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে। শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রাতুলের। কাছাকাছি গাছের ডালে ঘুমিয়ে থাকা পাখিরা উড়ে যায় দূরে। এ্যচিংকে জাপটে ধরতে যেতেই লোকদুটো দুদিকে ছিটকে পড়ে। ভয় পেয়ে যায় তারা। রাতুল দেখে স্থির একটি শরীর মুুহূর্তেই আগুনে জ্বলে বিলীন হয়ে যায়। এই কি তবে মানুষরূপে এ্যচিং! তার মুখটা একবারের জন্যও দেখতে পেল না রাতুল! দৃশ্যটা সহ‍্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে সে। লোকদুটো ভয়ে পালিয়ে যায় দূরে। 


আস্তে আস্তে পূর্বাকাশে ভোরের আলো উঁকি দিতেই সজাগ হয় রাতুল। তার স্পষ্ট মনে পড়ে সব। মনে পড়ে জলমাতার সাবধান বানী। যে জায়গায় এ্যচিং পুড়ে বিলিন হয়েছে সে জায়গায় গিয়ে মাটিতে কিছু একটা খুঁজতে থাকে রাতুল। না। এ্যচিং তার জন্য কিছুই রেখে যায়নি। সে মনে করার চেষ্টা করে এ্যচিংয়ের বলা শেষ কথাগুলো। না না। আর দেরি করা যাবে না। খুব দ্রুত তাকে পৌঁছতে হবে পুরোনো সেই বটগাছের নিচে। মুসিকার পাখির সন্ধান করে সে পাখিকে নিয়ে যেতেই হবে গ্রামে। 
-সংকল্প আওড়াতে আওড়াতে দৌড়াতে শুরু করে রাতুল। সেই মুহূর্তে সে এ্যচিংয়ের কথা ভাবতে চায় না।


ভোরের প্রথম আলো পুরোনো বটগাছটার মাথায় ছড়িয়ে পড়ে ধীরে। কিচির মিচির সুর তুলে কুমুদ্বতী, ছন্দোবতী, রক্তিকা, প্রীতি, আরো অনেকে উড়ে এসে বসে বটগাছের একেকটি ডালে। রোহিনী খেয়াল করে তাদের কারও চোখে-মুখেই আজ উচ্ছলতা নেই। সে ক’দিন স্কুলে আসেনি। সবার মলিন মুখ কেন, জিজ্ঞেস করতেই প্রীতি বলে, গতকাল এখানে একদল লোক এসেছিল। কী সব মাপজোক করছিল আর বলছিল, জঙ্গল কেটে সাফ করা হবে। কাটা হবে গাছ। এদিকে নাকি বড় পাকা রাস্তা হবে। করুণা বলে, আমাদের কথা কেউ ভাবতে চায় না, ভাবে না। 


এমন সময় উড়ে এসে গাছের ডালে বসে মুসিকার। বয়সের ভারে ক্লান্ত। আগের মতো পাখায় জোর নেই। উড়তে কষ্ট হয়। তবু শেষক্ষণ পর্যন্ত অসংখ্য বাধা ডিঙিয়ে সে শিষ্যদের কাছে ছড়িয়ে দেয় সংগীতের একেকটি পাঠ। এই তো ক’দিন আগে কেউ জঙ্গলের ভেতর এসে তাদের স্কুলটি ভেঙে দিয়েছিল। মুসিকার গিয়ে সর্দারের কাছে নালিশ জানালেও লাভ হয়নি কিছুই। জীবনের অভিজ্ঞতা মুসিকারকে শঙ্কা লুকিয়ে কৌশলী হতে শিখিয়েছে। কিন্তু আজ শিষ্যদের চোখে-মুখে যে শঙ্কা দেখছে তাকে কীভাবে দূর করবে সে! প্রভাতের আলো ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকে, চারপাশের গুনগুনানি কমে গুমোট নীরবতা ভর করে বটগাছের চারপাশে। অবশেষে মুসিকার শুরু করে সংগীতের পাঠ। আজ সে শেখাবে পঞ্চম সুর।


মুসিকার শিষ্যদের বলে, এটি শুদ্ধ অর্থে পবিত্র স্বর। এ স্বরকে তার নিদিষ্ট স্থান থেকে কখনো বিচ্যুত বা বিকৃত করা যায় না। শিষ্যদের চোখ মুসিকারের মুখের দিকে। সূর্যের জ্যোতি বটবৃক্ষের পাতা ভেদ করে মুসিকারের মুখে এসে পড়ে। কী এক নির্মলতা ভর করে সেখানে। হঠাৎ কোত্থেকে একটি তির এসে তীব্রভাবে গেঁথে যায় মুসিকারের বুকে। গাছের উঁচু ডাল থেকে মুসিকার মুহূর্তে শূন্যে ভাসে, নিচে নামতে থাকে হাওয়ার পালে ভর করে। ঠিক সে মুহূর্তেই রাতুল দৌড় থামিয়ে এসে দাঁড়ায় বটগাছের নিচে। রাতুলের হাতের তালুতে এসে পড়ে মুসিকারের শরীর। তারপর মাটিতে। বুক থেকে ঝরা রক্ত শক্ত মাটিকে কোমল করে তোলে। রাতুল কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। দেখে তার হাতের তালুতে ক্ষত-বিক্ষত শরীরের পাখি, রক্ত। রাতুল অন্য পাখিদের জিজ্ঞেস করে মুসিকার কই, মুসিকার? 


প্রাণটুকু বেরিয়ে যাওয়ার আগে মুসিকার শিষ্যদের বলে, তোমাদের যে সুর দিয়ে গেলাম তা জাগিয়ে রেখ জীবনময়, মনে রেখ বনের এ সুর সহজাত, সাজানো অনেক কিছুই সুন্দর মনে হয়, কিন্তু আসলে তা ক্ষণস্থায়ী। যা কিছু সহজাত, তার মধ্যেই প্রাণের স্পন্দন! 
দূর থেকে ট্র্যাক্টরের শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসে। মুসিকারের নিথর দেহ ঘিরে থাকা শিষ্যরা খেয়াল করে, তার বুকে গেঁথে যাওয়া তিরে একটি পশম লেগে আছে, শেয়ালের। 
রাতুল হাউমাউ কাঁদে। সে দেখে একটি বড় কালো থাবা ক্রমশ এসে মুসিকারের প্রাণহীন শরীরটাকে গিলে ফেলতে চায়। প্রচণ্ড শক্তিতে রাতুল সে থাবায় কামড় বসায়।  


বাবা ব‍্যথায় কাতরে উঠে বলেন, কী রে! কামড় দিচ্ছিস যে! 
বাবার কথায়  ঘুম ভাঙে রাতুলের। চোখ মেলে তাকায় সে। কোথায় আছে সে! এই তো বাবার মুখ, আর নিজের ঘর। এতক্ষণ তাহলে সে স্বপঘোরে বিভোর ছিল! 
পাহাড় থেকে ফুল তোলার সময় যে গড়িয়ে যায়! দেরি করে গেলে আর ফুল পাবি না! -বাবার কথাগুলো কানে আসতেই উঠে বসে রাতুল। স্বপ্নের ঘোর কাটতে শুরু করে।


আজ নববর্ষের প্রথম দিন। সব বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হবে। আগামীকাল জলোৎসব, সাথে নাগরদোলা। ভাবতে ভাবতেই সে ঝটপট একটি গেঞ্জি পরে নেয় আর কিছু একটা খুঁজতে থাকে। এই তো মায়ের সেই থামিটা! ঠিকই তো আছে। ঘোর কাটতে কাটতে তার বিশ্বাস দৃঢ় হয়, গ্রামবাসী আসলে  হারায়নি কিছুই...


বিবার্তা/এসবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com