বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস: ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ১০:১১
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস: ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। তামাক সেবনের সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে বিরত রাখতে প্রতিবছর এই দিনে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির আন্তর্জাতিক প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘গ্রো ফুড, নট টোব্যাকো’। আর বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপিত হতে যাচ্ছে ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে।



অপরাধ বিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি অন্তরায় তামাক। তামাক ব্যবহারের জন্য দেশে তামাকজনিত অসংক্রামক রোগ এবং এর ফলে অপরিণত বয়সে মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তামাকমুক্ত দিবসে তামাক থেকে দূরে থাকার শপথ নিতে হবে। আর এক্ষেত্রে আমাদের তারুণ্যকে তামাক থেকে দূরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে।



তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুসারে বাংলাদেশে প্রায় পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তামাকের এই বহুল ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।


টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০১৮ অনুসারে, তামাকজনিত নানা রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এদিকে দেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয় ও কর্মক্ষমতা হ্রাসের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও লাখ লাখ মানুষ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসতন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।



তথ্য বিশ্লেষণে আরো জানা যায়, বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র ৩ কোটি ৭৬ লক্ষ ৭ হাজার একর হলেও তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৩তম। শুধু তাই নয়, বিশ্বের মোট তামাকের ১.৩ শতাংশই উৎপাদিত হয় এই দেশে। ফলে দেশের ফসলের জমি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে তামাকচাষের কারণে।



সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক চাষে বেশি উপার্জনের কথা প্রচার করা হলেও তা নিতান্তই বানোয়াট। পারিবারিক শ্রমের পারিতোষিক, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত নিজস্ব গাছের বা কাঠের দাম, পরিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্য ব্যয় ইত্যাদি বাদ দিলে তামাক চাষে লাভের বদলে একরে ক্ষতি হয় ৯১৬.১১ ডলার। টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বন নিধনের পেছনে তামাক চাষ দায়ী।


এদিকে বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এফসিটিসি’র আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করে। ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। ২০২২ সালে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি বিশ্বমানে উন্নীত করতে সংশোধনী প্রস্তাব প্রণয়ন করে। ১৬ জুন, ২০২২ তারিখে সংশোধনী প্রস্তাব জনমত যাচাইয়ের জন্য জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং সংশোধনীর পক্ষে ১৬০০০ জনেরও অধিক ইতিবাচক মতামত প্রদান করেন। মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ১৬৯ জন সাংসদ। ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে চূড়ান্ত সংশোধনীটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রাথমিক যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রীপরিষদে প্রেরণ করা হয়।


স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত ও সংশোধিত খসড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের অন্যতম ৬ টি ধারা হলো- সকল প্রকার উন্মুক্ত স্থান এবং গণপরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করা, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, বিক্রয় কেন্দ্রে তামাক দ্রব্যের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট বা ইমার্জিং হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্ট আমদানি, উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা, তামাক পণ্যের সকল প্রকার খুচরা শলাকা বিক্রয় বন্ধ করা এবং বিড়ি ও সিগারেটের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা।


সর্বশেষ কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ- ২০২১ অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণ ৯৯ লাখ ৬২৪ একর। ২০২১ মৌসুমে বোরো, গম ও আলুর একর প্রতি গড় উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ৬৮১ কেজি, ১ হাজার ৩৩৫ কেজি এবং ৮ হাজার ৫৩৮ কেজি। তামাকের পরিবর্তে এই জমিতে বোরো চাষ করা হলে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন বোরো, ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৬৬ মেট্রিক টন গম এবং ৮ লাখ ৫০ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন করা সম্ভব হতো।



তামাকের ভয়াবহতা তুলে ধরে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পাঠ্যপুস্তকে ধূমপানের ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছে তামাক বিরোধী জাতীয় প্ল্যাটফর্ম। রবিবার (২৮ মে) দুপুরে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ভবনে (পিকেএসএফ) সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। এই সভায় আরও বলা হয়,সিগারেটের ধোঁয়ায় ৭ হাজার ৩৬৫ রকমের রাসায়নিক থাকে। যার মধ্যে ৭০টি রাসায়নিক কারসিনোজেনিক (মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে এমন) রয়েছে।



অপরাধবিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকে ধূমপান ও তামাক গ্রহণে আগ্রহী হয়। এটি পরবর্তীতে অন্যান্য নেশায় আসক্ত করে। ফলে তামাকমুক্ত দিবসে তামাক থেকে দূরে থাকার শপথ নিতে হবে। আর এক্ষেত্রে আমাদের তরুণদের তামাক থেকে দূরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে সরকারকে।


বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বিবার্তাকে বলেন, বৈশ্বিক নানা চিন্তাচেতনা ও বিষয়বস্তুকে ধারণ করে দিবসগুলো পালন করা হয়। যেমন- মা দিবস, বাবা দিবসসহ আর কত ধরণের দিবস রয়েছে। আর ৩১ মে হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এই দিবসটি খুবই তাৎপর্য বহন করে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, যেকোন দিবসের দুইটা দিক থাকে। এর মধ্যে একটা পজিটিভ দিক আরেকটা নেগেটিভ দিক। পজিটিভ দিক হলো নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট দিবসে, দিবস সম্পর্কিত নানা আয়োজন তুলে ধরা হয়। যার মাধ্যমে ঐ বিষয়টির প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আর নেগেটিভ দিক হলো এই দিবসগুলোকে ঘিরে একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। আর তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দিবসের দিনে দিবসকে অপব্যবহার করতেও ছাড়ে না।


তিনি বলেন, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের তরুণদের জন্য। কেননা, এই দিন তরুণসহ সবাইকে তামাক থেকে দূরে থাকার শিক্ষা দেয়। আর এই কথা আমরা সবাই অকপটে স্বীকার করি যে, তামাকের ভয়াবহতা মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। আর এক্ষেত্রে যদি তরুণরা আসক্ত হয়ে যায়, তাহলে সেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন। আর কেউ যদি তামাকে বেশি আসক্ত হয়ে যায়, তাহলে সে অন্য অনেক কিছুতেও আসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে অনেক তরুণের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিমিষেই অমানিশায় পরিণত হয় তামাকের কারণে।


এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, আমাদের তরুণরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তারা যেন তামাকসহ বিভিন্ন মাদক থেকে দূরে থাকে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এক্ষেত্রে মাদককে ঘিরে যেসব সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে সেগুলোকেও ভেঙে দিতে হবে। তাহলে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের যথার্থতা ফুটে উঠবে।



তামাক বিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বিবার্তাকে বলেন, তামাক চাষের ক্ষতি থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য তামাক কোম্পানিগুলো প্রায়শই নিজেদের অত্যন্ত পরিবেশ বান্ধব হিসেবে উপস্থাপন করে। তথাকথিত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচির (সিএসআর) মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ঘটানো ক্ষতি আড়াল করে এবং দায় এড়ানোর চেষ্টা করে।


তিনি বলেন, তামাক জনস্বাস্থ্য , পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য হুমকি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করণের মাধ্যমেই এসব ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের ঘোষণা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।


জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের সদস্য প্রফেসর ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, ধোঁয়াযুক্ত তামাকের ব্যবহারে যিনি সরাসরি খাচ্ছেন, তার চেয়ে তার আশপাশের পরোক্ষভাবে ধোঁয়া গ্রহণকারী মানুষেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। স্তন ক্যানসার এবং শিশুদের নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস এবং হুপিং কাশির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পরোক্ষ ধূমপান।


তিনি বলেন, সিগারেটের ধোঁয়ায় সাত হাজার ৩৬৫ রকমের রাসায়নিক দ্রব্য থাকে, যার মধ্যে ৭০টি রাসায়নিক কারসিনোজেনিক (মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এমন)। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ে শেষ করার পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com