মানবিক, বিনয়ী ও শিক্ষার্থীবান্ধব ডালেম চন্দ্র বর্মণ
প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৪, ২২:৪৩
মানবিক, বিনয়ী ও শিক্ষার্থীবান্ধব ডালেম চন্দ্র বর্মণ
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞান গরিমা মাপার কোনো স্কেল আমার জানা নেই। কিন্তু একজন শিক্ষক কতটা মানবিক, কতটা বিনয়ী আর কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারেন সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়। একটা বাচ্চাও এই গুণগুলো বুঝতে পারে। এইসব গুণের বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চেনা জানা যে কয়জন শিক্ষককে আমি শীর্ষে রাখবো তার মধ্যে অধ্যাপক ডালেম চন্দ্র বর্মণ অন্যতম। অসাধারণ এই মানুষটা আজ সকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।


আমি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা এবং টেলিভিশন ও ফিল্ম স্টাডিজ-এই চার বিভাগের শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। আসলে ডি ইউনিট থেকে বিভাগ বদলে আমাকে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে ভর্তি হতে বলেছিলেন অধ্যাপক ডালেম চন্দ্র বর্মণ। অথচ প্রথম বর্ষ থেকে আমি শুরু করলাম সাংবাদিকতা।


পরে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে প্রথমবারের মতো নরওয়ে সরকারের চালু হওয়া নোরাড রিজিওনাল মাস্টার্সের ভর্তি পরীক্ষায় দেশি-বিদেশি সবার মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হলাম। সাংবাদিকতায় মাস্টার্স শেষ করলাম। কিন্তু শিক্ষক হবার ইচ্ছেটা আমার কখনো হয়নি। ডালেম স্যারের কোর্সে আমি সবসময় সর্বোচ্চ নম্বর পেতাম। স্যার আমার এনালাইসিস করে লেখা খুব পছন্দ করতেন। আমি কেন শিক্ষক হবো না এ নিয়ে স্যার একবার দুবার আফসোস করলেও পরে সাংবাদিকতার প্রতি আমার প্যাশন দেখে আর কিছু বলেননি। তবে প্রায়ই বলতেন তুমি ক্লাসে খুব কম এসেও বা না এসেও এতো ভালো লিখো কী করে?


এই প্রশ্ন আমি আমার প্রায় সব শিক্ষকদের কাছে শুনেছি। কী সাংবাদিকতা বিভাগ কী শান্তি ও সংঘর্ষ লিখিত পরীক্ষায় প্রায় সব কোর্সে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেতাম। আসলে সাংবাদিকতা বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে আমি ইংরেজিতে দারুণ করে লিখতে পারতাম। আমার আফসোস হতো এত চমৎকার বিষয়গুলো আমাদের শিক্ষকরা এত বোরিং করে কেন পড়ান। ফলে আমার ক্লাস করতে ভালো লাগত না। আবার সাংবাদিকতার কারণে ক্লাসও করতে পারতাম না। আবার শিক্ষক হবার ভাবনাটা ছিল না বলে শিক্ষকদের কখনো খুব একটা তেল মারতে পারিনি বিশেষ করে অযোগ্য শিক্ষকদের। এর ফলাফল পেতাম ভাইভায়।


লিখিত পরীক্ষায় যে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেতাম ভাইভায় আমাকে সবচেয়ে কম দেয়া হতো। সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সে লিখিত পরীক্ষায় আমি প্রথম হওয়ার পরেও ভাইভায় আমাকে ভীষণ কম নম্বর দেয়া হয়েছিল। আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন আমি শিক্ষকদের বিরোধিতা করি? পরে জেনেছি, শুধু আমি নই, ওই শিক্ষক বহু শিক্ষার্থীর জীবন এভাবে বিপর্যস্ত করেছেন। শুধুমাত্র ভাইভায় এই কম নম্বরের কারণে আমি কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে পারিনি। অবশ্য আমি কখনো ফার্স্ট হতে চেয়েছি বলেও মনে পড়ে না।


যাই হোক লেখাপড়ার আলাপ বাদ দেই। আগেই বলেছি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জ্ঞান গরিমা মাপার কোনো স্কেল আমার জানা নেই। কিন্তু মানবিক আচরণ, বিনয় শিক্ষার্থীবান্ধব এসব গুণ খুব সহজে আমরা মাপতে পারতাম। সেই কারণেই আরেফিন সিদ্দিক এবং ডালেম চন্দ্র বর্মনের মতো শিক্ষকদের আমার ভীষণ ভালো লাগত। এই দুজনেরই ক্লাস আমি করেছি। দুজনকে আমি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। আমি সারাক্ষণ দেখতাম তারা শিক্ষার্থীদের কথা শুনছেন। শিক্ষক হিসেবে দুজনই ক্লাসে চমৎকার ছিলেন। তার চেয়েও বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব মানুষ হিসেবে। দিন নাই রাত নাই বাসা নাই অফিস নাই আমি সারাক্ষণ ওদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি।


ডালেম স্যারকে আমি খুব বেশি গাড়িতে চড়তে দেখিনি। স্যার কখনো কখনো হেঁটে আবার কখনো কখনো রিকশায় চড়ে বাসায় যেতেন।‌ জহরুল হক হলের পাশের আবাসিক কোয়ার্টারে স্যারের বাসা ছিল। স্যার কলা ভবন থেকে মূল চত্বর হয়ে হেঁটে হেঁটে যেতেন মাঝেমধ্যে হঠাৎ দেখালেও আমিও স্যারের সাথে কখনো কখনো হেঁটেছি। আমি দেখতাম তার ভাবনায় সব সময় শিক্ষার্থীরা। কথা বলতে গেলে আপন মনে হয় মনে হয়। মনে হতো শান্তির দূত!


২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদ স্যারের উপর আক্রমণের পর স্যারকে উদ্ধার করে আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। এই ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমি যেহেতু স্যারকে প্রথম উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম এবং সেই ছবি খুব বড় করে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কাজেই আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। আমাকে বলা হয়েছিল ঘটনার পরপরই আমি আব্বাস বা ছাত্রলীগ নেতাদের কাউকে দেখেছি কিনা। আমি খুব সহজ করে যা দেখেছিলাম তাই বলেছিলাম। এই মামলার অন্যতম সাক্ষী আমি। এই ঘটনা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুজন শিক্ষকের কাছে আমি গিয়েছিলাম তাদের একজন আরেফিন সিদ্দিক আরেকজন ডালেম স্যার। স্যার আমাকে ভীষণ সাহস দিয়েছিলেন। আসলে স্যার তাঁর সব শিক্ষার্থীদের সাহস দিতেন। পরামর্শ দিতেন যেভাবে তিনি তার ছেলেকেও হয়তো দেন। শুধু নিজের বিভাগের নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের ছেলে-মেয়েদের তিনি নিজের সন্তানের মত আদর করতেন। সবার কথা শুনতেন। পরামর্শ দিতেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যাওয়ার পর বেসরকারি আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। আদিবাসীদের দাবি আদায়েদের অনেক সংবাদ সম্মেলন এবং অনুষ্ঠানের স্যারকে দেখেছি।


বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং কাপেং ফাউন্ডেশনের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্টসহ বিভিন্ন প্রকাশনার সম্পাদনা ও গবেষণার সাথে একনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর অনেক গবেষণা প্রবন্ধ দেশ–বিদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনসহ অনেক দারুন বিষয় তিনি পড়তেন। আমার তাকে ভীষণ অহিংস মানুষ মনে হতো।‌ আগেই বলেছি মনে হতো শান্তির দূত।


আজ বুধবার সকালে আমাদের এই শান্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি কয়েক বছর ধরে পারকিনসনস রোগে ভুগছিলেন।


স্যারের মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোকবার্তায় বলা হয়েছে ডালেম চন্দ্র বর্মণ ছিলেন একজন সজ্জন, নম্র ও বিনয়ী মানুষ। শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন শিক্ষার প্রসার ও গবেষণায় এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান শিক্ষক স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আসলেই তাই।


আমি বলবো মানুষের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং সবমিলিয়ে একজন অসাধারণ ভালো মানুষ হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আপনার মতো মানবিক সৎ বিনয়ী সজ্জন এবং সত্যিকারের জ্ঞানী শিক্ষকদের জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।‌ পরকালে ভালো থাকুন স্যার।


লেখক : শরিফুল হাসান, কলামিস্ট।


(ফেসবুক ওয়াল থেকে)


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com