আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায় আটকে আছে আরাফাতের ‘আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে’ অংশগ্রহণ
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১৪:১৬
আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায় আটকে আছে আরাফাতের ‘আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে’ অংশগ্রহণ
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ভীষণ মন খারাপ নিয়ে এক তরুণের জন্য লিখছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। যার জন্য লিখছি সেই তরুণ বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশি হিসেবে উড়িয়েছেন লাল-সবুজ পতাকা। নয়বার বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন তিনি। দৌড়েছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। এমন একজন তরুণ যিনি বিশ্বের মঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা উঁচু করেছেন বারবার, আমলাতন্ত্রের লাল ফিতা তাকে আটকে রাখতে চাইছে।


আয়রনম্যান হওয়াটা কতোটা কঠিন যারা জানেন না তাদের বলি, আয়রনম্যান হলো এক দিনে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর কঠিনতম ট্রায়াথলন। এই খেলার ক্রীড়াবিদদের বলা হয় ট্রায়াথলেট। আয়রনম্যান হতে হলে একজন মানুষকে ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ৩.৮ কিমি সাঁতার, তারপর ১৮০ কিমি সাইক্লিং, তারপর ৪২.২ কিমি দৌড় শেষ করতে হয়। শুরুটা হয় সাঁতারের মধ্য দিয়ে। সাঁতার শেষ করে ডাঙায় উঠার সাথে সাথেই প্রত্যেক প্রতিযোগীকে সাইকেল চালাতে হয় ১৮০ কিলোমিটার। সর্বশেষ ধাপে দৌড়াতে হয় একটি ফুল ম্যারাথন (৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার) দৌড়।


সাঁতার, সাইক্লিং এবং ম্যারাথনের এ সম্পূর্ণ পথটি পাড়ি দিতে মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত সময় নিয়েছিলেন ১২ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ২৮ সেকেন্ড। এর মাধ্যমে তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশের ‘প্রথম আয়রনম্যানের’ স্বীকৃতি। আজকে সেই আরাফাতের কথা লিখছি।


বাংলাদেশের জন্য গৌরবের বিষয় যে আরাফাত ২০১৭ সালে আয়রনম্যান মালয়েশিয়াতে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ২০১৯ সালে আয়রনম্যান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পয়নশিপ, জার্মানি এবং ২য় বারের মত আয়রনম্যান মালয়েশিয়া শেষ করেন। তিনবার আয়রনম্যান শেষ করে ২০২১ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।


এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট জর্জে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন আরাফাত। যেখানে ১.৯৩ কিলোমিটার সাঁতার, ৯০ কিলোমিটার সাইক্লিং ও ২১.১ কিলোমিটার দৌড়ান। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করতে আরাফাত সময় নেন মাত্র ৫ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম।


পরপর আট বছরে নয়বার বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়া আরাফাত সামনের দিনে পাড়ি দিতে চান ইংলিশ চ্যানেল। এ ছাড়া খেলাধুলার মাধ্যমে সুস্থ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন আরাফাত। লেখাপড়া ও খেলাধুলা দুটোই যে একসাথে করা যায় তার বড় প্রমাণ আরাফাত।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আরাফাতের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে; এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে চাকরির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে ৩৫তম বিসিএসের নন-ক্যাডারে সমাজসেবা অধিদপ্তরে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।


আরাফাতকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পিকেএসএফের ক্রীড়া দূতের সম্মাননায় ভূষিত করেছেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রায় অর্ধশত পুরস্কার জেতেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ‘আয়রনম্যান’ খেতাব অর্জন করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মামনা দিয়েছে। এই দেশের হাজারো তরুণের প্রেরণা আরাফাত। আয়রনম্যানের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বে ৩০-৩৪ বছর বয়সী ট্রায়াথলেটদের মধ্যে আরাফাতের অবস্থান ১৩৬তম। বাংলাদেশে তার অবস্থান ১ নম্বরে।


মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাতই প্রথম বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদ, যিনি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্বীকৃতি পেয়েছেন। গত বছর আয়রনম্যানের চারটি প্রতিযোগিতায় আরাফাতের অর্জন ১০,৯১১ পয়েন্ট। আগামী ২৬ আগস্ট থেকে ৭ অক্টোবর ফিনল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে আয়রনম্যান বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপ হতে যাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন আরাফাত। কিন্তু আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে বন্দি তিনি। কারণ নিজের কর্মস্থল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এনওসি (অনাপত্তিপত্র) পাচ্ছেন না তিনি।


অথচ ছয়দিন আগে সব ঘটনা জেনে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সরকারি আদেশ জারি করেন। সরকারি চিঠির মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরনহ সবাইকে জানোনো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র তো মন্ত্রীদের চেয়েও শক্তিশালী। কাজেই সরকারি নির্দেশনা জারির পরেও তাকে এনওসি দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।


নিজের হতাশা ব্যক্ত করে গতকাল রাতে আরাফাত ফেসবুকে লিখেছেন, ছোট একজন মানুষ আমি। অফিসের ডেস্কের বাহিরে কোন স্বপ্ন দেখা উচিত না। সরাসরি নির্দেশনা পেয়েছি চাকরি করে স্পোর্টস করা যাবে না। কোন আন্তর্জাতিক স্পোর্টসে যাওয়া যাবে না। অফিস এবং স্পোর্টস একসাথে চলবে না! অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি ২টি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে কোয়ালিফাই করে! কতোগুলো স্বপ্ন! মাত্র তো শুরু হয়েছিলো যাত্রাটা। এই অল্প সময়ে থমকে যাবে!! বাংলাদেশ ক্ষমা করো! আমি পারলাম না!


স্ট্যাটাসটা পড়ে গভীর রাতে কাল রাতে আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। আরাফাতের সঙ্গে কথাও বলেছি। ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। এ কোন বাংলাদেশ? বিশ্বের বুকে যারা বাংলাদেশের পতাকা উঁচু করে তুলে ধরে তাদের কেন আমরা থামাতে চাই? সাংবাদিক হিসেবে দেশি-বিদেশে নানান অভিজ্ঞতায় জানি এই ধরনের তরুণদেরকে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করে।‌ আর আমরা তাদের আটকাতে চাই।


শুনে ভীষণ মন খারাপ হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাকে বলা হয়েছে, চাকুরি বা খেলাধুলা যে কোন একটা বেছে নিতে হবে। শুনে ভীষণ অবাক হলো। দুনিয়ার যে কোন প্রতিষ্ঠান তার সেইসব কর্মীদের আলাদা করে মূল্যায়ণ করেন যারা খেলাধুলা, সংস্কৃতি বা অন্য যে কোন ভাবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। অথচ বাংলাদেশ আরাফাতের পাশে দাঁড়াতে পারতো।


খোঁজ নিয়েছি, আরাফাত নিজের চাকরিটা যথেষ্ঠ মনোযোগ দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে করেন। কেউ যেন বলতে না পারেন যে তিনি কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন সে কারণে অন্যদের চেয়ে বেশি কাজ করার চেষ্টা করেন। ভোর ৪ টায় ঘুম থেকে ওঠৈ প্র্যাকটিস করেন। এরপর যথাসময়ে অফিসে যান।


আরাফাতকে যারা চেনেন না তাদের বলি, আরাফাতের সবচেয়ে বড় শক্তি মনোবল। একটা উদাহরণ দেই। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরাফাত দৌড়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পাড়ি দেবেন বলে বের হন। দৌড়ে টেকনাফ-তেঁতুলিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে পড়েন অভাবনীয় এক বাধার সম্মুখে। বঙ্গবন্ধু সেতু যানবাহনে ছাড়া পার হওয়ার নিয়ম নেই। তাহলে কি স্বপ্ন পূরণ হবে না আরাফাতের? না, আরাফাত হেরে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি ঝাঁপ দেন যমুনা নদীতে। সাঁতরে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার যমুনা পার হয়ে ওপারে ওঠেন। তারপর আবারও দৌড়। বিশ দিনে তিনি সহস্রাধিক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছান বাংলাবান্ধা।


Arafat - The Bangladeshi Triathleteকে নিয়ে নির্মাতা রেদওয়ান রনি আয়রনম্যান নামে একটা তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। আয়রনম্যান তথ্যচিত্রটি কোটি মানুষ দেখেছে। যারা দেখেননি দেখতে পারেন। ওই ভিডিওর নিচে হাজার হাজার মানুষ লিখেছেন, পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানো আরাফাত আমাদের প্রেরণার প্রতীক।


একজন লিখেছেন, ‘দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। অসাধারণ অনুভূতি। দেশের পতাকা নিয়ে শেষ মুহূর্তে যখন পৌঁছাল, একজন বীর প্রতীক তাকে অভিবাদন দিলেন, ভেতর থেকে এত গর্ব অনুভব করলাম।’


আরেকটা ঘটনা বলি। আরাফাতের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন। তিনি থাকেন নোয়াখালীতে। ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ছিলেন। একাত্তরে পোস্টিং ছিল রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে। ২৭ মার্চ থেকে তেঁতুলিয়া এলাকাকে মুক্ত করে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ২০১৭ সালে তেঁতুলিয়ার পথে ছেলে আরাফাত যখন রংপুর পৌঁছান, বাবা মোশাররফ হোসেন ছেলেকে বলেন, বধ্যভূমি দেখে এসো, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসো।
আমি এই অংশটা পড়ে কেঁদেছি। লিখতে লিখতে কাঁদছি। আরাফাত বাবার নির্দেশনা মেনে চলেন। কপালে লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ ঘুরেন। জিরো পয়েন্টে তাঁকে বরণ করে নিতে এসেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বীর প্রতীক, আরাফাতের আব্বার সঙ্গে যিনি যুদ্ধ করেছিলেন। যাকে পাকিস্তানিরা পরে মৃত্যুদণ্ড দেন। কিন্তু গুলি খাওয়ার পরেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি।


আমার ভীষণ মন খারাপ। আমি চাই এই লেখাটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাক। আমি বিশ্বাস করি পুরো ঘটনা শুনলে তিনি এ ব্যাপারে যথাযথ নির্দেশনা দেবেন যাতে আরাফাত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে যোগ দিতে পারে। বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে পারে বাংলাদেশের পতাকা। এই নির্দেশনার অপেক্ষায় আরাফাত, অপেক্ষায় এই দেশের তারুণ্য, অপেক্ষায় গোটা বাংলাদেশ!


(ফেসবুক ওয়াল থেকে)


লেখক: শরীফুল হাসান,
কলামিস্ট ও সহযোগী পরিচালক, ব্র্যাক।


বিবার্তা/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com