শিরোনাম
‘মাস্ক শনাক্তকারী ডোর’ সারাদেশে পৌঁছে দিতে চান শিথিল
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০৫
‘মাস্ক শনাক্তকারী ডোর’ সারাদেশে পৌঁছে দিতে চান শিথিল
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

ছোটবেলায় টিভিতে যখন কার্টুন দেখতাম তখন থেকেই রোবট বানানোর খুব ইচ্ছে হতো। অন্য পাঁচটা সাধারণ তরুণের মতো আমারও ইচ্ছে হতো কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ার। বড় হয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনীমূলক কাজ করে দেশ ও দশের উন্নতি করার। মনের ইচ্ছা আর দু’চোখ ভরা স্বপ্ন থাকলেও পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। আর্থিক অসচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও সে স্বপ্ন পূরণে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ঘটনাক্রমে দেশের মহামারি করোনা পরিস্থিতি আমার মেধা প্রকাশ ও বিকাশের সুযোগ করে দেয়। সে সুযোগে আমার উদ্ভাবনও করে ফেলি। এটি দেশের মানুষের জীবন নিরাপত্তা দিতে এখন কাজে লাগছে। দীর্ঘ দিন ধরে মনে পুষে রাখার বাসনা পূরণ হলো। এটি সারাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে মানুষের অনেক উপকার হবে।


এভাবেই আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাগুলো বলছিলেন করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে এক দিগন্তকারী যন্ত্রের উদ্ভাবক রিফাত আহমেদ শিথিল। মনে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো কঠিন কাজ যে করা সম্ভব, সেটি তিনি তার উদ্ভাবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন।


রিফাত আহমেদ শিথিলের জন্ম কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি গ্রামের মধ্যবিত্ত এক পরিবারে। বাবা নজরুল ইসলাম। কম্পিউটারে অনলাইন সার্ভিস করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মা শেলী খাতুন পেশায় গৃহিণী। ছোট ভাই পড়ছে স্কুলে।


শিথিল বসন্তপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং পান্টি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এখন কুষ্টিয়া রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (সিএসই) প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন।


২০২০ সালের জুন মাস। শিথিল তখন পান্টি ডিগ্রি কলেজে পড়েন। সারাদেশে করোনা মহামারির রূপ নিয়েছে। শত শত মানুষ করোনার বিষাক্ত ছোবলে মারা যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার দেশে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে। এরপরও মানুষ পেটের দায়ে ও জীবিকার তাগিদে ঘরে থাকতে পারছিলেন না। জীবনের প্রয়োজনে সবাই বাইরে যাচ্ছিলেন। বিশেষ করে মানুষ মাস্ক না পরে অফিস, আদালত, দোকান-পাট, শাপিংমলে মানুষের আনাগোনা বেশি হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে মানুষকে কীভাবে রক্ষা করা যায় ভাবতে থাকেন শিথিল। একদিন হঠাৎ মাথায় চিন্তা আসে মানুষ তো অবহেলা করে মাস্ক না পরার ফলে বেশি সংক্রমিত হচ্ছে। আর এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। তাহলে সংক্রমণের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায় সেটা নিয়ে কিছু উদ্ভাবন করলে কেমন হয়। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন।



এ বিষয়ে শিথিলের ভাষ্য, আমি তখন পান্টি ডিগ্রি কলেজে পড়ি। সারাদেশে করোনা মহামারির ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। চারদিকে শুধু করোনায় মৃত্যুর খবর শোনা যাচ্ছিল। তখন কলেজ থেকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় আমাকে একটি প্রজেক্ট করতে বলা হয়। তখন আমার নতুন উদ্ভাবনী ভাবনার কথা স্যারদের বলি। আামর চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনার কথা শুনে স্যাররা খুশি হন। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আমার পক্ষে তো সম্ভব না। তখন আমার স্যারদের বলি, আপনারা যদি আমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন তাহলে এই প্রজেক্টটি করতে পারবো। স্যাররা রাজি হন আর আমাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন। তখন আমার পরিকল্পনার কথা পান্টি ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগের দুই বন্ধুর সাথে শেয়ার করি। তারা হলেন সাগর হোসেন ও মুস্তাফিজুর রহমান নয়ন। সব শুনে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেয় তারা। তিন বন্ধু মিলে কাজে নেমে যাই। আর দীর্ঘ দুই মাস দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের পর উদ্ভাবনের কাজ শেষ করি। আমরা উদ্ভাবিত যন্ত্রটির নাম দেই ‘কোভিড-১৯ সেফটি ফেস মাস্ক ডিটেকটিভ ইন ডোর’।


উদ্ভাবিত যন্ত্রটির সুবিধা হলো, ফেস মাস্ক ছাড়া কেউ দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। শুধুমাত্র মুখে মাস্ক থাকলে একটি সবুজ বাতি জ্বলে উঠবে এবং দরজা খুলে যাবে। মুখে মাস্ক না থাকলে মাস্ক পরার অনুরোধ জানানো হবে। মাস্ক থাকলে প্রবেশকারীকে স্বাগতম জানাবে যন্ত্রটি।



প্রজেক্টটি বাস্তবায়নের শুরুতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে শিথিলের। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় তার এলাকায় ঠিকমতো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পাওয়া যায় না। যদিও পাওয়া গেছে সেটার গতি খুবই দুর্বল। উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে প্রতিদিন তাকে ১.৫ কি.মি. পায়ে হেঁটে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা নিতে যেতে হতো। শুধু ইন্টারনেট সুবিধার জন্য তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।


শিথিল বলেন, আমার ইচ্ছা, স্বপ্ন আর মনের জোর ছিল অনেক বেশি। যে করেই হোক আমাকে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতেই হবে। উদ্ভাবনটি তৈরি করার মতো আমার কোনো সামর্থ্য ছিলো না। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। উদ্ভাবনটি নিয়ে কাজ করতে অনেক অর্থ প্রয়োজন। তখন আমার কলেজ আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।


শিথিল শুধু স্বপ্নবাজ ছেলে নয়, বরং স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানে বিশ্বাসী। চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে একমাত্র শখের মোবাইল ফোন বিক্রি করে তার মাস্ক শনাক্তকারী ডোর তৈরিতে খরচ করেছেন। শিথিল বিশ্বাস করেন অধ্যবসায় আর আত্মবিশ্বাসই পারে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণে পৌঁছে দিতে।


দোকানদার বাবা নজরুল ইসলাম, মা শেলীর অনুপ্রেরণায় তার আজকের এই অবস্থান। ছোটবেলা থেকেই তার প্রবল আগ্রহ দেশ ও দশের উন্নতির পেছনে কাজ করা। তার স্বপ্ন সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে।



শিথিল বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই টেকনোলজি জাতীয় কাজ করতে ভালোবাসি। রোবটিক্স নিয়েও কাজ করতে আমার ভালো লাগে। আমি ২০১৯ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় একটি ইন্টারনেট কন্ট্রোল পিআই রোবট তৈরি করি। ওই রোবটটির কাজ ছিল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে রোবটের মাধ্যমে কাজ পরিচালনা করা। যেসব দুর্গম স্থানে মানুষ সহজে যেতে পারে না, সেসব স্থানে এটি সহজে পাঠানো যাবে। সেই স্থানের সব তথ্য গ্রহণ করাও যাবে।


উদ্যোগটির শুরুর সময় কলেজ থেকে আর্থিক বিনিয়োগ করলেও এখন আর কেউ এই বিষয়ে বিনিয়োগ করছে না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন তরুণ এই উদ্ভাবক। তিনি বলেন, উদ্ভাবনটাকে আরো বড় পরিসরে নিয়ে যেতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। এটি সারাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে মানুষের অনেক উপকার হবে। কিন্তু উদ্যোগটি সফল বাস্তবায়ন করার মতো অর্থ আমার নাই। নিজে যতটুকু পারছি তাই নিয়ে অনেক জায়গায় গেছি। কেউ কোনোভাবে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। তবুও আমি হাল ছাড়িনি। স্বপ্নকে একটু একটু করে এগিয়ে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।


বেশ কিছুদিন ধরে দেশে আবারও বেড়ে চলেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। এ সংখ্যা কবে কোথায় গিয়ে থামবে এটা কারোই জানা নেই। আর এ মহামারি থেকে বাঁচতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। নিয়মিত মাস্ক ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু অনেকেই মাস্ক ছাড়াই অফিস, আদালত, ধর্মীয় ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করছেন। একদিকে যেমন স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে, অন্যদিকে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রবণতাও বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ‘কোভিড-১৯ সেফটি ফেস মাস্ক ডিটেকটিভ ইন ডোর’ উদ্ভাবনটি সারাদেশে ব্যবহার করলে মানুষের সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস তরুণ এই উদ্ভাবকের।


কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে ৪২তম বিজ্ঞান মেলায় অংশ নেন শিথিল। মেলায় ‘কোভিড-১৯ সেফটি ফেস মাস্ক ডিটেকটিভ ইন ডোর’নামর এই যন্ত্রটি উপস্থাপনা করেন তিনি। বিচারে প্রথম স্থান অর্জন করে কলেজ। সময়োপযোগী আবিষ্কারের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে ভূয়সী প্রশংসাও কুড়িয়েছেন তিনি।



উদ্ভাবিত এ যন্ত্র সময়োপযোগী ও কার্যকারী হলেও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে সামনের দিকে এগোতে পারছেন না তরুণ এই উদ্ভাবক। সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোগটি বাস্তবায়ন হলে করোনা মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন তিনি।


স্বপ্ন নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে শিথিল বলেন, টাকার অভাবে আমার সফলতাগুলো ঝরে পড়ছে। সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নতুন কিছু উপহার দিতে চাই দেশবাসীকে। স্বপ্ন দেখি উদ্ভাবনটি সারাদেশের মানুষের জীবন রক্ষার কাজে লাগানোর। বেসরকারিভাবে দেশে যারা সামর্থ্যবান তাদের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আহ্বান জানাচ্ছি। সবার আন্তরিক সহযোগিতা পেলে উদ্যোগটি সারাদেশে ব্যবহার করা হবে। আর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একদিন উদ্যোগটি আলোর মুখ দেখবে সে প্রত্যাশা করি।


বিবার্তা/গমেজ/কেআর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com