শিরোনাম
তিন তরুণের ‘যন্ত্রের জন্য হাসপাতাল’
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:২৯
তিন তরুণের ‘যন্ত্রের জন্য হাসপাতাল’
তিন উদ্যোক্তা- আবু সাঈদ আল সাগর, উম্মে কুলসুম পপি ও মো. আল-আমিন ইসলাম
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

চায়ের দোকানে অন্য আর দশটা দিনের মতোই বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত ছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিষয়ে অনার্স প্রথম বর্ষের আবু সাঈদ আল সাগর। সমসাময়িক বিষয় নিয়েই চলছিল তাদের আড্ডা। হঠাৎ একটু থমকে যান সাগর। চা পরিবেশন করার ছেলেটাকে খুব চেনা চেনা লাগছিল। আড্ডা ফেলে একটু খোঁজ নিয়েই জানতে পারলেন ছেলেটি তার স্কুলজীবনের সহপাঠী।


এক সময়কার মেধাবী বন্ধুটির সাথে চায়ের দোকানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি সাগর। নবম শ্রেণিতে থাকতে হঠাৎ বাবা মারা গেলেন, সেই থেকে সংগ্রামের শুরু বন্ধু ওমরের। পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কখনো বাদাম বিক্রি, কখনো বাসের হেলপারের কাজ; এভাবেই এগুচ্ছে তার জীবন।


অথচ একটা সময়ে ওমরের জীবনের স্বপ্নগুলোও ছিল রঙিন। স্বপ্ন দেখতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে সম্মানজনক একটা চাকরি করার। কিন্তু ভাগ্যদেবী তার সহায় না হওয়ায় সেই স্বপ্নটাও থমকে গেছে একেবারে! এখন শুধুই ছুটে চলা পেটের দায়ে।


সেদিনের সেই ঘটনাটা সাগর তো বটেই নাড়া দিয়েছে তার বন্ধু আল-আমিন, পপিসহ অনেককেই। তাদের ভাবিয়ে তুলেছে, কিছুই কি করার নেই ভাগ্যের যাতাকলে পিষ্ট হওয়া এমন মেধাবী তরুণদের জন্য। খানিকটা ভালো জীবন তো তাদেরও প্রাপ্য। যেই ভাবা সেই কাজ। এ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের কারিগরি কাজে দক্ষ করে হোক প্রতিষ্ঠা ওয়ানস্টপ সার্ভিসিং কোম্পানি, যেখানে তারাই সার্ভিসিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করবে।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের হাত থেকে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করছেন সাগর


শুরুটা রংপুর থেকেই। নিজ শহরে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি সার্ভিসিংয়ের জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ানের যথেষ্ট অভাব ছিল, ছিল না ভালো কোনো সার্ভিসিং সেন্টারও। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের সার্ভিসিং কাজের একজন নিত্য অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে এবং দেশবাসীকে সার্ভিসিং কাজে নানামুখী ভোগান্তি আর প্রতারণা থেকে বাঁচাতে ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয় ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট’। উদ্যোক্তা আবু সাঈদ আল সাগর, মো. আল-আমিন ইসলাম ও উম্মে কুলসুম পপি।


মানুষের চিকিৎসার জন্য রয়েছে হাসপাতাল বা ক্লিনিক, পশুদের চিকিৎসার জন্য পশু হাসপাতাল। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের জন্য এ রকম কোনো গোছালো সেবা নেই। বিডি অ্যাসিস্ট্যান্টই হলো সেই যন্ত্রপাতির হাসপাতাল বা সার্ভিসিং হসপিটাল।


মাত্র দুজনকে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট। বর্তমানে এর প্রশিক্ষিত এবং চুক্তিভিত্তিক টেকনিশিয়ান মিলে মোট সার্ভিস প্রোভাইডার ২০০ জন। আবু সাঈদ আল সাগর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।


যে কোনো উদ্যোগকে বাস্তবরূপ দিতে শুরুতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তাদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাদেরও কঠিন সময় ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০১৫ সালে তারা পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু মূলধনের অভাবে এগোতে পারেননি। ব্যর্থ হয়ে বসেও থাকেননি এ অদম্য উদ্যোক্তারা। এ সময় তারা দেশে অনেকগুলো বিজনেস আইডিয়া কন্টেস্টে অংশগ্রহণ করেন। কয়েকটিতে তারা সফলতাও অর্জন করেন। যেমন- বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম আয়োজিত `ইউথফেস্ট ২০১৬’-তে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সিঙ্গাপুর ভ্রমণের সুযোগ পান।


এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ও ইনোভেশন ক্যাটাগরিতে পাওয়া ‘বিওয়াইএলসি অ্যালামনাই অ্যাওয়ার্ড ২০১৯’ গ্রহণ করছেন সাগর


২০১৬ সালে ব্র্যাকের আরবান ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের জন্য একটি বড় টার্নিং পয়েন্ট। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ৫ লাখ টাকা সিড ফান্ডসহ ৬ মাসের ইনকিউবেশন সাপোর্ট পান। পরবর্তীতে তারাই ইনভেস্টমেন্টের জন্য বিভিন্ন ইনভেস্টর প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা করে দেন। এর ফলে ব্র্যাক থেকেই তারা পরবর্তীতে ভালো অঙ্কের একটি ইনভেস্টমেন্ট পান। বিডি অ্যাসিস্ট্যান্টকে বাস্তবে রূপ দিতে এই আরবান ইনোভেশন চ্যালেঞ্জের অবদানই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। তাদের সবার মুখে হাসি ফুটে। উদ্যোগ আলোর মুখ দেখে। শুরু হয় কার্যক্রম। ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে।


মানুষকে বাসাবাড়ি কিংবা অফিসের যে কোনো সার্ভিস যেমন- ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের সার্ভিসিং, ইলেকট্রিক্যাল সার্ভিসিংসহ যে কোনো ধরনের মিস্ত্রী কিংবা টেকনিশিয়ানকেন্দ্রিক সেবা দিয়ে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করলো বিডি অ্যাসিসটেন্ট।


অর্জন নিয়ে সাগরের ভাষ্য, মানুষ থেকে শুরু করে পশুপাখির হাসপাতাল আছে। বর্তমানে যন্ত্রের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আমরা যন্ত্রের হাসপাতাল করেছি, যেখানে অসুস্থ যন্ত্র বাসায় বসে চিকিৎসা নিতে পারছে। আর লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়া জনগোষ্ঠীকে মানুষের চিকিৎসক না বানাতে পারলেও যন্ত্রপাতির চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত করিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি- এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি।


এ ছাড়াও বিডি অ্যাসিস্ট্যান্টের ঝুলিতে রয়েছে আরো বেশ কিছু অর্জন। সাহসী উদ্যোক্তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট জয় করেছে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড সম্মাননা’। সাভারের শেখ হাসিনা জাতীয় যুব ইনস্টিটিউটে সিআরআই আয়োজিত ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮’ অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। মোট ৩০ জন তরুণ অর্জন করেন এ সম্মাননা। তাদের একজন হতে পেরে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট টিম গর্বিত।


‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপের পক্ষ থেকে ‘নবীন উদ্যোক্তা সম্মাননা ২০১৮’ গ্রহণ করছেন সাগর


এর আগে ২০১৬ সালে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট পেয়েছে বাংলাদেশ ব্রান্ড ফোরাম আয়োজিত ‘ইয়ুথফেস্ট অ্যাওয়ার্ড’ এবং ব্র্যাক আয়োজিত ‘আরবান ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড ২০১৬’। পরবর্তীতে ব্র্যাক বিডি অ্যাসিস্ট্যান্টে কার্যক্রমে আর্থিক বিনিয়োগও করেছে।


২০১৯ সালে ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ গ্রুপের পক্ষ থেকে নবীন উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন সেরা ‘নবীন উদ্যোক্তা সম্মাননা ২০১৮’, বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার আয়োজিত এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ও ইনোভেশন ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন ‘বিওয়াইএলসি অ্যালামনাই অ্যাওয়ার্ড ২০১৯’।


পাঁচ বছরের মধ্যে উত্তরবঙ্গের সব জেলাসহ দেশের ৩০টি জেলায় ‘যন্ত্রের জন্য হাসপাতাল’ এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে চান এই সাহসী উদ্যোক্তারা।


২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের সার্ভিসিং কাজের জন্য একটি বিশ্বস্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্টকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে চান তারা। সেই সাথে অন্তত ২% মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীকে এ কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com