শিরোনাম
এমএম বিল্ডার্সের জালিয়াতি: শত শত কোটি টাকার জমি দখলের পায়তারা
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২০, ১৬:০৫
এমএম বিল্ডার্সের জালিয়াতি: শত শত কোটি টাকার জমি দখলের পায়তারা
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

জাল দলিল, নকল খতিয়ান ও ভুয়া দাতা সাজিয়ে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে শত শত কোটি টাকা মূল্যের জমি দখলের পায়তারা করছে এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।


এমন অভিযোগ করেছেন বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার শেখবাড়ী সুগদ্ধী গ্রামের বাসিন্দা মৃত এ কে মোহাম্মদ আলীর ছেলে এ এম কে হাসান। তিনি বর্তমানে রাজধানীর বনানী থানাধীন মহাখালী টিবি গেইটের জি.পি.ছ-৩২ নম্বর বাড়িতে বসবাস করেন।


জানা গেছে, ১৯৫৬ সালে এএমকে হাসানের বাবা মোহাম্মদ আলী মহাখালী মৌজার ৯২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। বর্তমানে তারা সাত ভাইবোন সেখানে বাস করছেন। ১৯৭৪ সালে মহাখালী মৌজার ২২৪২ নম্বর খতিয়ানভুক্ত ওই জমিতে তার বাবা একটি করাত কল (সমিল) করে ভাড়া দেন। প্রায় ১২ কাঠা জায়গার ওপর এ কলটি স্থাপন করা হয়। কিন্তু জমিটি রাস্তার পাশে সুবিধাজনক জায়গায় হওয়ায় এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন মঈন তাদের কয়েকশত কোটি টাকা মূল্যের ওই জায়গা লিখে দিতে বলেন।


মামলা সূত্রে জানা যায়, এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মঈন বাহিনী নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে জাল দলিল, নামজারি ও ভুয়া গ্রহীতা সাজিয়ে ওই জমির মালিকানা দাবি করেন। এমনকি একাধিকবার সন্ত্রাসী নিয়ে ওই বাড়িতে এমএম বিল্ডার্সের সাইনবোর্ড স্থাপনেরও চেষ্টা করেন মঈন। এলাকাবাসীর সহায়তায় তখন তা প্রতিরোধ করেন জমির মালিক। এ ঘটনায় এ এম কে হাসান বাদী হয়ে গুলশান থানা ও আদালতে একটি মামলা করেছেন। আদালত এ ব্যাপারে গুলশান থানাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।


অনুসন্ধানে জানা যায়, গুলশান থানার নিকেতন সি ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ১২৭ নম্বর বাসার বাসিন্দা ও এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহিউদ্দিন মঈন এবং তার ভাই কবির হোসেন ও বংশাল রোডের ১২ নম্বার বাসার বাসিন্দা মোল্লা আবুল খায়ের মিলে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গুলশান সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার সুগন্ধী গ্রামের বাসিন্দা শেখ মসিউদ্দৌল্লা, শেখ মফিজউদ্দৌলা, শেখ সিরাউদ্দৌলা, শেখ আসাফুদ্দৌলা, শেখ সাইফুদ্দৌলা, রওনক আফজা ও সরদার রবিউল হাসানের স্ত্রী নুরুন মজিরাকে ভুয়া দাতা সাজিয়ে মহাখালী মৌজার ২২৪২ নং খতিয়ানের ২৫২৫ অযুতাংশ জমির ভুয়া জাল দলিল তৈরী করেন।


পরবর্তীতে তা গুলশান সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রেশন করেন। জাল ওই দলিলটির নং-৭২৩১, তারিখ-০৩/০৯/২০০৮। ওই জাল দলিল সম্পাদনার পর তারা জালিয়াতির মাধ্যমে সিটি জরিপের খতিয়ান প্রস্তুত করে। সেই খতিয়ান প্রস্তুত করতেও গুলশান সাব রেজিস্ট্রার অফিসকে ব্যবহার করা হয়। সিটি জরিপের খতিয়ান নং- ২২৪২, যা গুলশান থানার মহাখালী মৌজার জে এল নং ১৯।



প্রকৃতপক্ষে ওই খতিয়ানের মালিক ছিলেন- বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার শেখবাড়ী সুগদ্ধী গ্রামের বাসিন্দা মৃত এ কে মোহাম্মদ আলীর ছেলে এ এম কে হাসানসহ তার পরিবারের লোকজন। কিন্তু তাদের নাম পরিবর্তন করে শেখ মসিউদ্দৌল্লা, শেখ মফিজউদ্দৌলা, শেখ সিরাউদ্দৌলা, শেখ আসাফুদ্দৌলা, শেখ সাইফুদ্দৌলা, রওনক আফজা ও রবিউল হাসানের স্ত্রী নুরুন মজিরা ও তাদের মাতা ফামিদা বেগমের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এমনকি জমির পরিমান ২৩০৮ অযুতাংশ বিলুপ্ত করে ২৬০৮ অযুতাংশ লিপিবদ্ধ করা হয়।


এছাড়া খতিয়ান অংশের কলামটিও ইচ্ছা মতো পরিবর্তন করা হয়। পরবর্তীতে জাল জালিয়াতি, মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা সিটি জরিপের হাল খতিয়ানটি নিজেদের নামে রেকর্ড করে প্রতারিত হয়েছে বলেও বিবৃতি দেয় তারা। এমনকি সৃজিত দলিলের বাদীর পৈত্রিক বাসস্থানের ঠিকানাকেই দলিল দাতাগণের বর্তমান ঠিকানা হিসেবে দেখানো হয়।


শুধু তাই নয়, জমির দলিল জাল থাকা সত্ত্বেও এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহিউদ্দিন মঈনসহ বাকিরা সিটি জরিপের খতিয়ান নং ২২৪২ এ সৃজিত জাল খতিয়ান এবং ০৩/০৯/২০০৮ ইং তারিখে ৭২৩১ নং সাব কবলা দলিলকে খাঁটি বলে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, তেজগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার ভূমি অফিস, আদালতসহ অন্যান্য অফিসে কপি দাখিল করেছেন। এমনকি মো. মহিউদ্দিন মঈন, কবির হোসেন ও মোল্লা আবুল খায়ের মিলে জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত সাব কবলা দলিল নং-৭২৩১ ও ঢাকা সিটি জরিপ খতিয়ান নং-২২৪২ এর কপিসমূহ তেজগাঁও সার্কেলে সহকারী ভূমি অফিসে উপস্থাপন করেন। এ সময় এ এম কে হাসান ও অন্যান্য শরিকদের নাম কর্তন করে নামজারী ও জমাভাগ কেইস নং ১৫৩৯২/০৮-০৯ মূলে এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহিউদ্দিন মঈনের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়।


এক পর্যায়ে তেজগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসে মহিউদ্দিন মঈনসহ বাকিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন এ এম কে হাসান। কেইস নং- ১৫৯/১১। পরবর্তীতে ঢাকা সিটি জরিপের জাল পর্চা দাখিল করার কারণে ২০১২ সালের ২৭ জুন তেজগাঁও সার্কেলের সহকারী ভূমি অফিস মো. মহিউদ্দিন মঈনের নামজারী ও জমাভাগ কেইস নং ১৫৩৯২/০৮-০৯ মূলে সৃজিত জোত এবং উল্লেখিত জালিয়াতি মূলক ৭২৩১ নং দলিল গর্ভে বর্নিত শেখ মসিউদ্দৌল্লা, শেখ মফিজউদ্দৌলা, শেখ সিরাউদ্দৌলা, শেখ আসাফুদ্দৌলা, শেখ সাইফুদ্দৌলা, রওনক আফজা ও নুরুন মজিরার নামজারী ও জমাভাগ কেইস নং-১৫৩৮৮/০৭ মূলে সৃজিত জোত সমূহ বাতিল করে আদেশ প্রদান করেন।


এ ব্যাপারে মামলার বাদী এ এম কে হাসান জানান, মো. মহিউদ্দিন মঈন ও তার সহযোগীরা জাল দলিল, খতিয়ান সৃষ্টি করে ব্যাংক থেকে কয়েকশ কোটি টাকা লোন নিয়েছে। এ ছাড়া মামলা সংক্রান্ত জায়গায় আনসার দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও শুধু টাকার জোরে আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি জাল দলিল ও পর্চা করে দখলের উদ্দেশ্য আনসার মোতায়েন করেছে। এছাড়া ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে টাকার জোরে রায় নিয়ে ভুয়া দলিল ও পর্চা সৃজন করে আমাদের জমির কতক অংশ দখল করে রাজউক থেকে হোল্ডিং নম্বর সৃজনের মাধ্যমে জমি দখলের পায়তায় লিপ্ত রয়েছেন। এ জন্য দীর্ঘ দিন থেকে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার মামলা মোকদ্দমা চলছে।


বর্তমানে এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে দলিল ও পর্চা জালিয়াতির প্রতিকার চেয়ে ঢাকার বিজ্ঞ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোট ২১ এ সিআর মামলা নং ৭৮৬/১৮ মামলাটি বিচারাধীন কালে পিবিআই ঢাকা কে তদন্তের নির্দেশ দিলে পিবিআই দীর্ঘ তদন্তের পর জাল দলিল ও পর্চা সৃজনের প্রমান পায় এবং গত ৬/১০/২০২০ তারিখে আদালতে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। আদলত তদন্ত রিপোর্ট আমলে নিয়ে আসামি এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহিউদ্দিন মঈন সহ সকল আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।


এছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ, ১ম আদালতে দেঃ মোঃ নং- ৮০৫/১১ এবং ভায়োলেশন মিস কেইস নং ৪০/১৫, হাইকোর্টে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালের মিথ্যা রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল এবং ঢাকার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার( রাজস্ব) এর নিকট উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও মিউটেশন দেয়ায় বাদীর আরজির বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিল মামলা ১৭৩/২০২০ চলমান রয়েছে। যেহেতু জাল জালিয়াতি করে দলিল ও মিউটেশন করা হয়েছে তথাপি জমি হস্তান্তর না করে আসামিরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।


এদিকে, সম্প্রতি এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহিউদ্দিন মঈনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও এখনো তিনি ধরাছোয়ার বাহিরে হয়েছেন।


ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর সাথে যোগাযোগ করে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব)মো. হেলাল মাহমুদ শরীফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি। তবে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে একটি এসএমএস দিয়েছেন এবং পরে কথা বলবেন বলে আরো একটি এসএমএস দিয়েছেন। পরবরর্তীতে তিনি আর ফোন দেননি।


বিবার্তা/খলিল/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com