শিরোনাম
কুড়িগ্রামে নৌকা ডুবে পাঁচজনসহ নিহত ১০
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০১৯, ২০:১৭
কুড়িগ্রামে নৌকা ডুবে পাঁচজনসহ নিহত ১০
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকায় স্বজনদের দেখতে গিয়ে নৌকা ডুবে চার শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন আরো তিনজন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।


মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দুপুরে উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের নতুন অনন্তপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে স্থানীয়রা ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে।


স্থানীয়রা জানান, নতুন অনন্তপুর গ্রামের কয়েকজন মহিলা ১৪ থেকে ১৫ জন শিশুকে নিয়ে একটি ডিঙ্গি নৌকায় করে বন্যার পানিতে ঘুরতে পার্শ্ববর্তী একটি বিলে যান। এসময় অতিরিক্ত ভারের কারণে বিলের পানিতে নৌকাটি ডুবে যায়।


স্থানীয়রা বিষয়টি দেখতে পেয়ে ফায়ার সার্ভিসকে অবগত করে নৌকা নিয়ে তাদের উদ্ধার করতে যায়। এসময় তারা শিশুসহ কয়েকজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে উলিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই দুইজনের মৃত্যু হয়। আর এক শিশুর মা রুনা বেগম (৩৫) তার শিশু সন্তানকে বাঁচাতে নিজে পানিতে ডুবে দুই হাতে সন্তানকে পানির উপর ভাসিয়ে রাখেন।


স্থানীয়রা তার শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করতে পারলেও দীর্ঘক্ষণ পানিতে ডুবে থাকা মা রুনাকে বাঁচাতে পারেনি। নিহত অপর ৪ শিশু হলো, অনন্তপুর গ্রামের ব্যাপারী পাড়ার আয়নাল হকের ছেলে হাসিবুল (৭) একই গ্রামের মহসিন আলীর মেয়ে রুপা মনি (৮), মনছুর আলীর ছেলে মোরসালিন সুমন (১০) এবং রাশেদের মেয়ে শিশু রুকু মনি (৭)।


গুরুতর আহত লাভলী বেগম (৪৫), রুমি বেগম (১৬) ও আয়শা সিদ্দিকাকে (০৫) উলিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।


নৌকায় থাকা লাভলী বেগম ও এনামুল ফকির জানান, বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া স্বজনদের বাড়ি দেখতে ২০ থেকে ২৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশু নৌকায় করে যাচ্ছিলেন। এসময় তীব্র স্রোতে তাদের নৌকাটি ডুবে যায়। পরে বাকিরা সাঁতার কেটে বেঁচে ফিরলেও এই পাঁচজন আর ফিরতে পারেননি।


উলিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফখরুল আলম বলেন, আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।


কুড়িগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মঞ্জিল হক বলেন, দীর্ঘ চার ঘণ্টা চেষ্টার পর মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়।



এদিকে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। বাড়ছে পানিবন্দী ও বন্যার পানিতে ডুবে নিহতের সংখ্যাও।


সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।


অন্যদিকে কুড়িগ্রামের রৌমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে দুই যুবক নিখোঁজ হয়েছে। এদের মধ্যে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আরেকজনের লাশ ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও স্থানীয় লোকজন পানির নিচে সম্ভাব্য স্থানগুলোতে খুঁজে বেড়াচ্ছে।


নিখোঁজ যুবকরা হলেন, রৌমারী উপজেলার চাক্তাবাড়ী গ্রামের আব্দুস ছালামের ছেলে সাইফুল ইসলাম (২৩) এবং নাগেশ্বরী উপজেলার কালিগঞ্জ ইউনিয়নের মাদাইখাল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আ.ন.ম মুসার ছেলে আল মামুন (৪০)।


নাগেশ্বরী থানার ওসি রওশন কবির জানান, মাদাইখাল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আ.ন.ম মুসা সোমবার নিজে বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার বড় ছেলে আল মামুন নাগেশ্বরী উপজেলা শহর থেকে তার বাবাকে নিতে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন। পথে বন্যার পানি ভেঙ্গে পায়ে হেটে যাওয়ায় সময় বাড়ির পাশে মাদাইখাল এলাকায় খাদে পড়ে নিখোঁজ হয়। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মঙ্গলবার দুপুর নাগেশ্বরী ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পার্শ্ববর্তী জায়গা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে।


রৌমারী থানার ওসি আবু মো. দিলওয়ার হাসান ইনাম জানান, রৌমারী উপজেলার চাক্তাবাড়ী এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার পানিতে ঘর-বাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় মঙ্গলবার সকালে সাইফুর ইসলাম বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কলা গাছের ভেলায় উঠিয়ে উঁচু স্থানের দিকে যাওয়ার সময় বিদ্যুতের তারের সাথে ধাক্কা লেগে পানিতে পড়ে যায়।


এরপর স্থানীয়রা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের নিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার কোনো সন্ধান পাননি।


স্থানীয়রা জানান, অসাবধানতা বশত বন্যার পানিতে পড়ে গিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে।



এছাড়াও গত রবি ও সোমবার ২ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে চিলমারীতে ২ এবং উলিপুরে ১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম।


স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে তিস্তার পানি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।


এতে করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার ৯ উপজেলার ৫৬ ইউনিয়নের ৪০৭টি গ্রাম। বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষ। বন্যা দুর্গত এলাকাগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গো-খাদ্যের সংকট দেখা দেওয়ায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসী মানুষজন।


চরাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী উঁচু বাঁধ ও পাকা সড়কসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে।


জেলা প্রশাসন থেকে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের কথা বলা হলেও বন্যা দুর্গত বেশির ভাগ মানুষ ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেন।


কুড়িগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান জানান, জেলার ৯ উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য এখন পর্যন্ত ৫০০ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। যা বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া নতুন করে ১ হাজার মেট্রিক টন চাল, ২০ লাখ টাকা ও ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলার সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ৮৫টি মেডিকেল টিম বন্যা বন্যার্তদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য কাজ করছে।



অন্যদিকে কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলাসহ সোনাহাট স্থল বন্দরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পানির প্রবল তোরে রৌমারী উপজেলার চাক্তাবাড়ী এলাকায় প্রায় শহর রক্ষা বাঁধের প্রায় দেড়শ ফুট ধ্বসে যাওয়ার যাদুর চর ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী ৩০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়েছে।


বন্যার পানি উঠার কারণে ৩৭২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৪৫টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে ৯ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমির সবজি বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসল।


বিবার্তা/সৌরভ/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com