সাতক্ষীরার তিন ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার মানুষ স্যানিটেশন ও নিরাপদ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। খোলা মাঠে এখন কেউ মলত্যাগ না করলেও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও নিরাপদ সুপেয় পানির অভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সাতক্ষীরার পিছিয়ে পড়া দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ।
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে এখনো সচেতনতার আলো পৌঁছায়নি সকলের মধ্যে।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাড়ি, বল্লী ও ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের ১৩টি পাড়ার ৭৩১টি পরিবার এখনো নিরাপদ সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও হাইজিন সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে আগরদাড়ি ইউনিয়নে পাঁচটি, বল্লী ইউনিয়নে তিনটি এবং ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নে পাঁচটি পাড়ায় এ সমস্যা প্রকট।

আগরদাড়ি ইউনিয়নের বাবুলিয়া ঋষিপাড়া, ইন্দ্রিরা গোলদারপাড়া, চুপড়িয়া ঋষিপাড়া, রামেরডাঙ্গা ভগবানীপাড়া ও কাশেমপুর হাজামপাড়ার প্রায় ২৫২টি পরিবারের প্রায় ১১৬০ জন মানুষ নিরাপদ সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও হাইজিন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

অপরদিকে বল্লী ইউনিয়নের কাঁঠালতলা ঋষিপাড়া, মুকুন্দপুর কারিকরপাড়া ও রায়পুর ভগবানীপাড়ার ১৭৫টি পরিবারের প্রায় ৮৭৫ জন মানুষ নিরাপদ সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও হাইজিন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে ভুগছেন নানা রোগে।

এছাড়া ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া ঋষিপাড়া, বলাডাঙ্গা কারিকরপাড়া, মাধবকাঠি কলোনীপাড়া, আখড়াখোলা মোড়লপাড়া ও ওয়ারিয়া গোলদারপাড়ার ৩০৪টি পরিবারের ১৫২০ জন সদস্য ভুগছেন নানা রোগে।

পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি তারা ডায়রিয়া, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, হাপানীসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব এলাকায় অধিকাংশ মানুষ অগভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করেন। নলকূপগুলোর অধিকাংশই আর্সেনিক ও আয়রনে আক্রান্ত। তিনটি ইউনিয়নের ১৩টি পাড়ার প্রায় চার হাজার মানুষ ব্যবহার করছেন আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত পানি। এসব পাড়ার অধিকাংশ নলকূপ এখনো পাকা নয়। নলকূপের গোড়া ময়লা আবর্জনায় ভরা। এসব পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরা স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ পায়খানা ব্যবহার করেন না। এক সময় খোলা আকাশের নিচে বনে-বাদাড়ে ঝোপের আড়ালে তারা মলত্যাগ করতেন। এখন সে অবস্থা না থাকলেও যে পায়খানা ব্যবহার করেন তা আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

চার থেকে পাঁচটি রিং স্লাব বসিয়ে তা বস্তা কিংবা কাপড় দিয়ে ঘিরে সেখানেই মলত্যাগ করে নারী-পুরুষ ও শিশুরা। একটি পায়খানা তিন চারটি পরিবার ব্যবহার করছেন। পায়খানার পরে সাবান কিংবা ছাই দিয়ে হাত পরিষ্কার করা নাকি এদের কাছে বিলাসিতা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে এখনো অনেকেই সচেতন নয়।

এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ অতি দরিদ্র শ্রেণির। অন্যের ক্ষেতে খামারে কামলা খেটে সংসার চলে তাদের। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাঁশ সংগ্রহ করে ঝুড়ি ডালা বুনে অনেকেই কোনো রকমে সংসার চালান। গরীব শ্রমজীবী এসব মানুষের পক্ষে নিরাপদ পানি কিনে পান করা দুঃসাধ্য। পাকা পায়খানা নির্মাণ তাদের পক্ষে একবারেই অসম্ভব। এছাড়া যাতায়াত ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে রয়েছেন। গ্রামের অধিকাংশ রাস্তা এখনো কাঁচা।

এরা সরকারি খাস জমিতে বসবাস করেন। বর্ষায় হাঁটু অবধি কাদা ঠেলে তাদের যাতায়াত করতে হয়। সামান্য বৃষ্টিতে ঘরের চালের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে। পুষ্টিকর খাবার থেকে অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা বঞ্চিত। গর্ভবতী মায়েরা অনেকেই স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত। শিশুরা স্কুলে গেলেও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুতে পারে না।

বাবুলিয়া ঋষিপাড়ার রিনা দাস, রামপ্রসাদ দাস, আশালতা দাস, দিপালী দাস, মঞ্জুরী দাস, কল্যাণী দাস, সম্পা দাসসহ অনেকেই তাদের সমস্যা এভাবেই তুলে ধরেন।

একই কথা বলেন ছয়ঘরিয়া ঋষিপাড়ার সুমন দাস, সাধন দাস, মাধবকাঠি কলোনীপাড়ার তাহমিনা খাতুন, শাহানারা খাতুন, বলাডাঙ্গার কারিকরপাড়ার আসমা খাতুন, শফিকুল ইসলাম, মুকুন্দপুরের আলতাফ হোসেন ও শাহিদা খাতুন, আখড়াখোলার ফতেমা খাতুন ও নাজমা খাতুন, চুপড়িয়ার অসীম দাস ও প্রফল্ল দাসসহ অনেকেই তাদের এলাকার পিছিয়ে জনগোষ্ঠীর নিরাপদ সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ পায়খানা ও হাইজিন সমস্যা তুলে ধরে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।

আগরদাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মজনুর রহমান মালিসহ অন্য জনপ্রতিধিগণ জানান, পিছিয়ে পড়া এসব জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সরকারি বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।

দলিত নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমাজের পিছিয়ে পড়া এসব জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্থাটি অ্যাডভোকেসি কর্যক্রম পরিচালনা করছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।

সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্র থেকে জানা যায়, নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। খোলা স্থানে মলত্যাগের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় এসেছে।

সূত্র আরো জানায়, আগে মানুষ পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করত। এখন অধিকাংশ মানুষ নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে। এ ক্ষেত্রে অধিদফতর ৯৭ শতাংশ সফল। এরপর আর্সেনিক সমস্যা সমাধানেও কাজ শুরু হয়েছে। এখনো ৪২ শতাংশ বাসাবাড়ির পানিতে রোগজীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও গুণগত মানের ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনের গুণ ও পরিমাণগত মান নিয়ে কাজ করতে হবে।

দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানুষ এখনো আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে। ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত করার লক্ষ্যটি সহজ নয়। তাই কঠিন এ লক্ষ্য অর্জনে এ খাতের দক্ষতা বাড়াতে হবে। লোকবল ও সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরেরও দুর্বলতা রয়েছে। জনশক্তির যথেষ্ট স্বল্পতা আছে। যা অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে পূরণ করতে হবে বলে মনে করে সূত্রটি।

এদিকে অপর একটি সূত্রের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৬ শতাংশ শিশুর শরীরে সব সময় ইনফেকশন থাকে। এদের জন্য নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং হাইজিন সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে এ অবস্থা থেকে তাদের বের করে আনা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতি নির্ধারকদের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।

বিবার্তা/রহমান/তাওহীদ/জাকিয়া