শিরোনাম
যমুনা চরাঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ঘোড়ার গাড়ি
প্রকাশ : ২০ মে ২০১৯, ১৩:৪১
যমুনা চরাঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ঘোড়ার গাড়ি
মোল্লা তোফাজ্জল, টাঙ্গাইল
প্রিন্ট অ-অ+

যমুনা চরাঞ্চলে প্রায় দেড় যুগ আগেও পরিবহনের জন্য ছিল না তেমন কোনো কিছু। বর্ষা মৌসুমে নৌকায় আর শুকনো মৌসুমে মাইলের পর মাইল ধূ-ধূ বালুচর পায়ে হেঁটেই নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল মাথায় নিয়ে গন্তব্য স্থানে পৌঁছতেন মানুষ।


গ্রামাঞ্চলের মেঠো পথে পরিবহন বলতে ছিল গরু ও মহিষের গাড়ি। ক্রমান্বয়ে এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে অধিকাংশই গরু ও মহিষের গাড়ি। তার পরিবর্তনে আধুনিকতায় ছোঁয়ায় অটো-ভ্যান, অটো-রিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক পরিবহনের গাড়ি দখল করে নিয়েছে গ্রামাঞ্চলের পথ ঘাট।


বর্তমান আধুনিক যুগে গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়ি বিলুপ্তি হলেও টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও কালিহাতী উপজেলার যমুনা নদীর তীরে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ঘোড়ার গাড়িতে মালামাল ও ইঞ্জিন চালিত মিনি ট্রফি ট্রাক্টর পরিবহন।


এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে জানা যায়, গরুর ও মহিষের গাড়ি ছিল মালামাল পরিবাহনের বাহক। কিছু মানুষও যাতায়াত করতেন; তবে কম। ঘোড়ার গাড়ি বলতে ছিল সে সময়ে রাজা-বাদশা ও জমিদারদের পরিবহন। যা তাদের প্রজা ও সাধারণ মানুষদের কল্পনার মধ্য ছিল ঘোড়ার গাড়িতে (চড়া) উঠা।


গ্রাম ও যমুনার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে সব ধরনের মানুষের রাজকীয় আদলে না হলেও বর্তমান সময়ে ঘোড়ার গাড়ি এখন বেশ জনপ্রিয় উঠছে চরাঞ্চলবাসীর কাছে।


ভূঞাপুর উপজেলার কালিপুর গ্রামের ঘোড়া চালক মো. সবুর মিয়া বলেন, এখন যমুনা চরাঞ্চল মরা। যমুনা তাঁর রূপ নিয়ে উঁচু নিচু বালুময় চরাঞ্চল। এ চরাঞ্চল এলাকার জমি থেকে উৎপাদিত ফলস ঘরে তোলার জন্য ঘোড়াই একমাত্র বাহক। কেননা মাইলের পর মাইল বালুচর পায়ে হেঁটে মাথায় করে ফসল বাড়িতে নিয়ে আসা খুবই কষ্টকর। তাই বর্তমানে এ চরাঞ্চলে মালামাল ও বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের জন্য ঘোড়ার গাড়িই প্রধান মাধ্যম।


যমুনা চরাঞ্চলের মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যমুনা চরাঞ্চলে উৎপাদিত ফসল, বাদাম, ভুট্টা, মসুর ডাউল, কাউন, খেসারি ডাউল, বোরো ধান, মিষ্টি আলু, কাশফুলের শুকনো খড় ইত্যাদি ফসল জমি থেকে ঘোড়ার গাড়িতে পরিবহন করা হয়। এছাড়াও গাবাসারা মধ্য চরাঞ্চলে হাট বাজারে গোবিন্দাসীর পুরাতন ফেরিঘাট থেকে পরিবহন করে বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে পাড়ি জমায় হাটে।


সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষের একমাত্র সুবিধাজনক হিসেবে পথে প্রান্তরে ঘোড়ার গাড়ি। কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়া ইউনিয়নের আলীপুর, বেলটিয়া, পটল-বেরি পটল, ইসলামপুর, দুর্গাপুর, কাকুয়ার চর ইত্যাদি গ্রামে চরাঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করছেন।


ভূঞাপুর উপজেলার গাবাসারা, অর্জুনা ও নিকরাইল ইউনিয়নের অর্ধেকাংশ ঘোড়ার গাড়িতে সব ধরনের কৃষি পণ্য ও মালামাল পরিবহন করা হচ্ছে। ঘোড়ার গাড়ি চালক হিসেবে বেশি ভাগ ১৫ থেকে ২২ বছর বয়সের ছেলেরা ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছে। পরিবারে অভাব-অনটন, বাল্যশিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়া ও সংসারের হাল ধরতেই তারা এ পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও জানা যায়। শুধু ঘোড়া চালাচ্ছে তাই নয়। বর্ষা মৌসুমে নদীতে মাছ ধরাসহ নদী থেকে নৌকা যোগে বালু উত্তোলন করেও গোবিন্দাসী ঘাটসহ জামালপুর, সরিষাবাড়ি ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ঘাটে বালু বিক্রি করে সংসার চালাতে ব্যাপক সহযোগিতা করছে পরিবারকে।


ঘোড়া চালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমান তাদের দুইটি ঘোড়া রয়েছে। পাঁচ ভাই- দুই বোন ও মা-বাবা নিয়েই তাদের সংসার। তার বাবা একা সংসার চালাতে হিমসিমে পড়েছিল বছর তিন আগে। অন্যের দেখে ও পরামর্শে ১ টা ঘোড়া কিনে দেয় তাকে। এরপর নিজেদের ফসলের পরিবহন করেও অন্যের ফসল আনতো ভাড়ায়। দিনে ২ হাজার ৫শ থেকে ৩ হাজার ৫শ টাকা পর্যন্ত ভাড়া উঠতো। এভাবে সংসারে অভাব কমতে থাকে। এক পর্যায়ে আরো ৩ টি ঘোড়া কিনে চরাঞ্চলে ভাড়ায় চালাচ্ছে শফিকুল।


যমুনা চরাঞ্চলবাসীরা জানান, ঘোড়ার গাড়ি তৈরিতে খরচ কম, ঘোড়ার দামও হাতের নাগালে। ঘোড়ার গাড়ি পরিবহনের উপযোগী ১টা ঘোড়ার দাম ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে কয়েক বছর পরিবহন করতে সক্ষম। ঘোড়ার খাদ্য হিসেবে ধান ভাঙানো কুড়া, সরিষার খৈল, ছোলা (বুটের ডাউল), ভূসি ও চালের খুত খাওয়ালেই হয়। এছাড়া মাঠে সবুজ ঘাস ও খড়ও খায়। এতে ঘোড়া পালনে আরো খরচ কম হয়। তাছাড়া ঘোড়া পালনে অনেকেই লাভবান হয়ে সংসারের স্বচ্ছতা ফিরেয়ে আনে।


গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল লতিফ তালুকদার বলেন, যমুনা চরাঞ্চলে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের কৃষি পণ্য ও পরিবহনে ঘোড়ার গাড়ি ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।


চরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে চলাচলের রাস্তা-ঘাটের অভাবে যেখানে আধুনিক যান্ত্রিক পরিবহন গাড়ি চলতে পারে না সেখানে বালুকে উপেক্ষা করে ঘোড়ার গাড়িই পরিবহনে মানুষের নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে আসছে। যার কারণে দিন দিন ঘোড়ার গাড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে যমুনা চরাঞ্চলে।


বিবার্তা/তোফাজ্জল/তাওহীদ/আকবর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com