শিরোনাম
লালমনিরহাটে বাতাসে ভাসছে নিকোটিন
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:১৪
লালমনিরহাটে বাতাসে ভাসছে নিকোটিন
লালমনিরহাট প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

লালমনিরহাটের আকাশে-বাতাসে শুধু তামাকের গন্ধ, আর এই তামাকের গন্ধের প্রভাব পড়ছে শিশুদের উপর। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা ৫টি উপজেলা নিয়ে লালমনিরহাট জেলা। সব জায়গায় এখন তামাক আর তামাক। তামাকের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে নিকোটিন। যা গোটা জেলায় বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে।


তামাকের রাজ্য বলে খ্যাত লালমনিরহাটে এখন তামাক শুকানোর মৌসুম চলছে। তামাক শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকের পরিবারের লোকজন। তামাক শুকানোর কারণে ওইসব কৃষকের স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।


সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য বারের তুলনায় এবার জেলায় তামাক আবাদ হয়েছে তুলনামূলক বেশি। কিন্তু তামাক শুকানোর যায়গা ঠিক আগের মতোই সংকুচিত। যার ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত তামাক দ্রুত বাজারজাত করণের লক্ষ্যে মহাসড়ক, বাড়ির উঠানসহ যেখানে খুশি যত্র-তত্র তামাক শুকাচ্ছেন তারা। ৫টি উপজেলাসহ সদর উপজেলার গকুন্ডা, খুনিয়াগাছ, পঞ্চগ্রাম, বড়বাড়ি ও আদিতমাড়ি উপজেলার সাপ্টিবাড়ি, মহিষখোলা, মোগলহাট, দুর্গাপুরসহ প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে রাস্তার দুপাশে মাইলের পর মাইল রোদে তামাক শুকাতে দেয়া হয়েছে।


লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লালমনিরহাটে ৯ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে আদিতমারী উপজেলায়। এ অঞ্চলে মূলত ভার্জিনিয়া ও মতিহরি জাতের তামাক চাষ হয়। অবশ্য ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর তামাকের আবাদ কিছুটা কমেছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তামাকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়। এতে মাটির উর্বরাশক্তি কমে যায়, অম্লতা বাড়ে, ফলে দীর্ঘমেয়াদীর জন্য অনুর্বর হয়ে পড়ে জমি। তাছাড়া মারাত্মক পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিও রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।


মহিষখোলা ইউনিয়নের ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী আবির হোসেন বলে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাদের চোখে তামাক পড়ে। আমাদের থাকার ঘরেও তামাক রাখা হয়েছে। আর বাড়ির আশ-পাশ ও রাস্তা-ঘাটেতো তামাক রয়েছেই। এই তামাকের গন্ধ ঝাঁজালো নাকে গেলে কেমন যেন বমি বমি ভাব হয়।


আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুরের ১০ বছরের আল আমিন তামাক শুকানোর ফাকে বলে প্রায় প্রতিদিন তাকে তামাক শুকাতে তার বাবাকে সাহায্য করতে হয়। এজন্য কয়েকদিন থেকে তার স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। তামাক শুকানোর কাজে থাকায় প্রতিদিন তার বমি বমি ভাব হয়। খাওয়ার রুচি একেবারে নেই বললেই চলে। কিন্তু উপায় নেই সে কৃষকের সন্তান, তাই কৃষি কাজে তার বাবাকে সাহায্য করতেই হবে।


সাপ্টিবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসা বেগম বলে, ৩ কিলোমিটার পথ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে হয় তাকে। যাওয়ার সময় দুর্গন্ধটা একাধারে অনেকক্ষণ নিশ্বাসের সাথে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করায় যখন স্কুলে গিয়ে পৌঁছি তখন আর ক্লাস করার ইচ্ছে হয়না। মনে হয় মাথাটা ঘুরছে। স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে আসলে সন্ধ্যার পর আর পড়ায় মন বসে না। মনে হয় গন্ধটা নাকে লেগে আছে।


সদর উপজেলার বড়বাড়ি ইউনিয়নের কৃষক জমির উদ্দিন জানান, আমরা কৃষক মানুষ আমাদের যে ফসলে বেশি লাভ হবে আমরা সেই ফসলই আবাদ করব। তামাক আবাদ করার জন্যে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ঋণ স্বরূপ টাকা দেয়, সার দেয় আর তামাকের বদলে ভালো টাকাও পাই, তাই তামাকে বেশি লাভ হওয়ায় তারা তামাক চাষ করেন। বিভিন্ন তামাকজাত পণ্য উৎপাদক কোম্পানির পক্ষ থেকে উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সব দায়দায়িত্ব নেয়ার কারণেই তারা নিশ্চিন্তে ফসলটি আবাদ করছেন। অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে এটি লাভজনকও বলছেন তারা।


যত্র-তত্র তামাক শুকাতে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তামাক শুকাতে এ পর্যন্ত কেউ তাদেও বাধা দেয় নাই। তাই রাস্তা-ঘাট, খেলার মাঠ যেখানে ফাঁকা জায়গা পেয়েছি আমরা সেখানেই তামাক শুকাই। আর রাস্তা ঘাটে তামাক শুকাতে সময় কম লাগে, তাই তারা সড়ক ব্যবহার করে।


লালমনিরহাট বর্ডার গার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সেকেন্দার আলী জানান, কৃষি বিভাগের নজরদারি না থাকায় লালমনিরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় তামাক চাষ দিন দিন ব্যাপক হারে বাড়ছে। ক্ষতিকারক জেনেও অন্য ফসলের চাইতে লাভবান বেশি হওয়ায় তামাক চাষে উৎসাহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। শারীরিক ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদী জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা জানলেও তামাক চাষ ছাড়ছেন না কৃষকরা।


লালমনিরহাট সদর-উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নবীউর রহমান জানান, তামাকে রয়েছে নিকোটিন যা মানবদেহের ক্ষতি করে। তবে শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধরা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম। তাই তামাক যেখানে সেখানে রোদে না শুকিয়ে নির্ধারিত স্থানে শুকানোর ব্যবস্থা করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।


লালমনিরহাট সিভিল সার্জন ডা. কাশেম আলী বলেন, অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানির প্রলোভনের কারণেই তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অথচ প্রতি বছর তামাক সেবনের কারণে অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, আগামী বছর লালমনিরহাটে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে কৃষকদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হতে পারে।


লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, খোলা জায়গায় তামাক শুকানোর কারণে বাতাসে পরিবেশ দূষণ হয়। এরফলে বিভিন্ন বয়সের লোকজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে।


বিবার্তা/জিন্না/আকবর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com