শিরোনাম
আজ ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১০:২২
আজ ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস
শেরপুর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

আজ ৪ ডিসেম্বর শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহযোগীতায় মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী উপজেলাকে শত্রু মুক্ত করে। দিনটি পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ঝিনাইগাতী উপজেলা কমান্ড ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।


পাক-হানাদার বাহিনী ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন ঢাকার বুকে হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই রাতেই ৩টা ৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম ম্যাসেজ ঝিনাইগাতী ভিএইচএফ ওয়্যারলেস অফিসে এসে পৌঁছে। ম্যাসেজ পেয়েই ওয়্যারলেস মাস্টার জামান তার অফিসের পিয়ন পাঠিয়ে শেষ রাতের দিকে আওয়ামী লীগ নেতা ফকির আ. মান্নানের বাসায় সংবাদ দেন।


বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ পেয়ে পরদিন ভোরেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ সকালে ছাত্রনেতা ফকির আ. মান্নান, আব্দুল কাফি মিয়া, হারুনুর রশিদ, সৈয়দ আলী মেম্বার, বাবু অনন্ত কুমার রায়, সেকান্দর আলী ফকিরসহ অনেকেই ওয়্যারলেস অফিসে এসে পৌঁছান। ইংরেজিতে লেখা টেলিগ্রাম ম্যাসেজটি পেয়েই নেতৃবৃন্দ তৎক্ষণাৎ তা শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠান।


২৬ মার্চ সকাল থেকেই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো ঢাকার সর্বশেষ সংবাদ কি তা জানার জন্যে শেরপুর শহরে মানুষ সমবেত হতে থাকে। ঝিনাইগাতী ওয়্যারলেসে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ হাতে পেয়েই তা বাংলায় অনুবাদ করে শেরপুর নিউ মার্কেট মোড়ে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে পাঠ করে শুনানো হয়। বঙ্গবন্ধুর পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণার শ্রবণ করে সমবেত জনতা মুহূর্মুহু স্লোগানে মুখরিত করে তোলে শেরপুরের আকাশ বাতাস।


২৭ মার্চ সকালে শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম এমপি, মুহসিন আলী মাস্টার ও ছাত্র নেতা আমজাদ আলী ঝিনাইগাতী এসে পৌঁছেন। ঝিনাইগাতীর নেতৃবৃন্দ তাদের অভ্যর্থনা জানান। ছাত্রনেতা ফকির আব্দুল মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে তারা নকশি ইপিআর ক্যাম্পে যান। নকশি ক্যাম্পের সুবেদার হাকিম নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেই বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করাসহ পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে রাংটিয়া পাতার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ট্রেনিং শেষে এসব স্বেচ্ছাসেবকসহ মুজিব বাহিনী ও ইপিআর সৈনিকদের নিয়ে সুবেদার হাকিম মধুপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে তা পিছু হটে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের চরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।


২৬ এপ্রিল সুবেদার হাকিম এর খোলা জীপ এসে দাঁড়ায় ঝিনাইগাতী আমতলায়। সুবেদার হাকিম জনতাকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অনুরোধ জানান। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঝিনাইগাতী শত্রু মুক্ত ছিল। ২৭ এপ্রিল পাক বাহিনী বহর নিয়ে গোলা বর্ষণ করতে করতে পৌঁছায় ঝিনাইগাতী বাজারে। ঝিনাইগাতী ঢুকেই আওয়ামী লীগ অফিস আগুন ধরিয়ে পুড়ে দেয়। গাড়ি বহর নিয়ে রাংটিয়া পাহাড় পর্যন্ত গিয়ে আবার পিছনে ফিরে এসে ওইদিন বিকালেই কোয়ারীরোডে পাক বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে ঝিনাইগাতীর এক মাইল দক্ষিণে আহম্মদ নগর হাই স্কুলে তাদের সেক্টর হেড কোয়াটার স্থাপন করে। যা মুক্তিযোদ্ধাদের ১১নং সেক্টরের বিপরীতে পাকবাহিনীর ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরে একমাত্র সেক্টর হেড কোয়াটার। যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর রিয়াজ।


এছাড়া পাক বাহিনী শালচূড়া, নকশি, হলদীগ্রাম, তাওয়াকোচা, মোল্লাপাড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৬ বৈশাখ জগৎপুর গ্রামে হানা দিয়ে গ্রামটি পুড়িয়ে দেয় এবং পাক বাহিনী ৪১ জন গ্রাম বাসীকে গুলি করে হত্যা করে। ৫ জুলাই কাটাখালি ব্রীজ ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা রাঙ্গামাটি গ্রামে আশ্রয় নেয়। দালালদের খবরে পাক বাহিনী রাঙ্গামাটি গ্রামে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। শুধু রাঙ্গামাটি বিলের দিক খোলা ছিল। সম্মুখ যুদ্ধে কমান্ডার নাজমুল আহসান শহীদ হন। তার লাশ আনতে গিয়ে আলী হুসেন ও মোফাজ্জল শহীদ হন।


পরদিন রাঙ্গামাটি গ্রামে হানা দিয়ে পাক বাহিনী নয়জন গ্রাম বাসীকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ২৩ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলার তাওয়াকুচা ক্যাম্প দখল করে এবং মুক্ত তাওয়াকুচায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তাওয়াকুচা যুদ্ধে চারজন পাক সৈন্য ও সাতজন রাজাকার নিহত হলে পাক বাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে আসে। ৩ আগস্ট নকশি ক্যাম্প আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধারা। আগের দিন ২ আগস্ট বিকেলে মেজর জিয়া নকশি ক্যাম্প আক্রমনের জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ারের অবস্থান গুলো দেখেন। এদিনের যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও নিখোজ হন। যুদ্ধে পাক বাহিনীর ৩৫জন সৈন্য নিহত হয়।


২৭ নভেম্বর কমান্ডার জাফর ইকবালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী বাজারের রাজাকার ক্যাম্প দখল করে আটটি রাইফেলসহ আটজন রাজাকারকে ধরে নিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর পাক বাহিনী ঝিনাইগাতী হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবিএম সিদ্দিকের ছোট ভাই ওমর (১১) ও মুক্তিযোদ্ধা মকবুলের পুতর খালেক (১০), পাক বাহিনীর দালাল আব্দুর রহমান, গোজারত মেম্বারসহ আটজনকে আহম্মদ নগর ক্যাম্পের বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে তাদের এক গর্তে মাটি চাপা দিয়ে পুতে রাখে।


৩ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক দেড়টায় শালচূড়া ক্যাম্পের পাক বাহিনী কামালপুর দুর্গের পতনের আগাম সংবাদ পেয়ে পিছু হটে এবং আহম্মদনগর হেড কোয়াটারের সৈনিকদের সাথে নিয়ে রাতেই মোল্লাপাড়া ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেয়। এভাবে রাতের আঁধারে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শত্রুমুক্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায়।


বিবার্তা/সানী/জেমি/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com