শিরোনাম
দিনাজপুর মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস আজ
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:২৪
দিনাজপুর মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস আজ
দিনাজপুর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

আজ ৬ জানুয়ারি। দিনাজপুরের মহারাজা স্কুল মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস। দিনাজপুর জেলার ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর দিন।


১৯৭২ সালের এই দিনে মহারাজা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে এক মাইন বিস্ফোরণে একসাথে শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনা প্রায় ৫ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে অনেকেই।


ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি একটি শোকাবহ দিন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে এতবড় ট্র্যাজেডির ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নেই। দিবসটি উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।


১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস। দীর্ঘ ৯ মাস জীবনের বাজি রেখে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা লাল সবুজের একটি পতাকা ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র জাতিকে উপহার দিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়ে পরিবার পরিজনের সাথে আনন্দ উৎসব করার কথা। কিন্তু তারা মনে করেছিলো দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসী এখনো শংকামুক্ত নন।


দেশ স্বাধীন হলেও পাকি সেনাদের পুতে রাখা মাইনের কারণে এদেশে ভূমি এখনো দেশবাসীর জন্য স্বাধীন নয়। তাইতো তারা এদেশের ভূমিকে দেশবাসীর জন্য স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার উপযোগী করতে নিয়োজিত হয়েছিলেন পুতে রাখা মাইন অপসারণের কাজে।


দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীতে মহারাজা স্কুলে স্থাপন করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে সমবেত হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলোর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পতিরাম ও বাঙ্গালবাড়ী ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রায় আটশত মুক্তিযোদ্ধা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে মাইন অপসারণ করে জড়ো করছিল।


ক্যাম্প থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়তেন পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা ও পুঁতে রাখা মাইন ও অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের সন্ধানে। সন্ধ্যার দিকে উদ্ধারকৃত মাইন ও অস্ত্রাদি জমা করা হতো মহারাজা স্কুলের দক্ষিণাংশে খনন করা বাংকারে।


কিন্তু ৬ জানুয়ারি ঠিক মাগরিবের নামাজের পর দুটি ট্রাক থেকে মাইন নামানোর সময় হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন ফসকে পড়ে যায় জড়ো করা মাইনের উপর। সাথে সাথেই বিস্ফোরণ ঘটে জড়ো করা হাজারো মাইনের। কেঁপে উঠে গোটা দিনাজপুর। প্রাণ হারান সেখানে অবস্থান নেয়া প্রায় পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয় শত শত মুক্তিযোদ্ধা।


মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের ছিন্ন ভিন্ন অংশ ছিটকে গিয়ে পড়ে আশেপাশে ও গাছের ডালে। মুক্তিযোদ্ধাদের এসব ছিন্ন ভিন্ন অংশ জড়ো করে সমাহিত করা হয় সদর উপজেলার চেহেলগাজী মাজারে। সেখানে গণকবর দেয়া হয় তাদেরকে।


বিস্ফোরণে সেদিনের স্কুল ভবনটিও ধ্বংস হয়ে যায়। সেদিনের বিস্ফোরণে কতজন নিহত হয়েছিল তার কোনো সঠিক হিসেব নেই, তবে ৫ শতাধিক বলে জানান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা। এই দিবসটি পালন করে আসছে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।


ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় আহত বীরমুক্তিযোদ্ধা দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার চরাড়হাট গ্রামে আব্দুর রহমানের পুত্র আব্দুর রশিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সে দিন মাইন বিস্ফোরণে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার পূর্বে ৫০ থেকে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সাড়ে ৪শ মুক্তিযোদ্ধা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলেই নিহত হন।


তিনি আরো বলেন, দুর্ঘটনার পর পরই শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিসেন্ট মিশন হাসপাতালে। এদের মধ্যে থেকে পরে ২৯ জন মারা যায়। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে ১৭ দিন চিকিৎসার পর তার জ্ঞান ফিরেছিল। পরে তাকে ভারতের কলকাতার একটি হাসপাতালে সাড়ে ৪ মাস চিকিৎসার পর শরীরের বাম পা কেটে ফেলে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। এখন এই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সরকারি ভাতা পান। ওই দুর্ঘটনায় তার মতো আরো ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন স্থানে জীবিত থেকে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন।


দিনাজপুর সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ জানান, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এতো বড় ঘটনা আর একটি নেই। নতুন প্রজন্মকে বিষয়টি জানানোর জন্য এই ঘটনাটি পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ। কিন্তু যুদ্ধের ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের দাবি বাস্তবায়িত হয়নি।


পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদদের স্মৃতি বাস্তবায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এখনো উপেক্ষিত।


অন্যদিকে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক ছুটু জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পরপরই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে একসাথে এত সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহতের ঘটনা দেশে আর কোথাও হয়নি। তাই এই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার দাবি সকলের।


সেদিনের সাক্ষী যে মহারাজা স্কুল সেখানে সেদিনের যেসব স্মৃতি তা নতুন প্রজন্ম ও দেশবাসীকে জানানোর জন্য একটি জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনচেতা মানুষেরা।


বিবার্তা/শাহী/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com