একটি পাড়ায় দু’টি দেশ। পাড়ার অর্ধেক বাংলাদেশের বাঘমাড়া। অন্যটা ভারতের হাড়িপুকুর। কিন্তু দু’পাড়ার মাটি, মানুষ, ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি সবই এক। আজো একটি পাড়ায় দু’টি দেশ। একই রকম আটপৌরে জীবন প্রবাহ। শুধু ওরা ভারতীয় আর আমরা বাংলাদেশী। দিনাজপুরের হিলি সীমান্তের আজবপাড়া দু’টি দেশের মানুষ একত্রে বাস করে।
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর থেকে মাত্র অর্ধ কিলোমিটার উত্তরেই এই সীমান্ত গ্রাম। গ্রামের মাঝ পথে রয়েছে মাত্র চিহিৃত কয়েকটি সীমানা পিলার। যা অনিমেয় লেভেল ক্রসিং। শুধু আছে দু’পাড়ে উর্দিধারীদের অবিশ্বাসের চোখ রাঙানি। দু’পাড়েই রয়েছে সীমান্তে পাহারারত অস্ত্রঘাড়ে পোশাকধারী বিজিবি-বিএসএফ। সীমান্ত পারাপারের নেই কোনো উপায়, এর মাঝে উভয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হুংকার। বিজিবি বলছে, আর এগুবেন না। ওরা যতই মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক না কেন, সেটা উচ্চ পর্যায়ের ব্যাপার।
লেবেল ক্রসিং পেরুলেই গুলি ছুঁড়বে ওরা। শেষে ঢাকা-দিল্লি দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যাবে আপনার জন্য। কি অদ্ভুত, ওদের আর আমাদের মাঝে হাস্যকর বিভাজন। নিরাপত্তা চোখ বেষ্টনী ভেঙ্গে ওপার থেকে এলো বৃদ্ধ মহিতোষ বিশ্বাস। তার সাথে আলাপ কালে বললেন, মনে আছে ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে ওই যে দেখছো হিলি ষ্টেশন, ওখান থেকেই ট্রেনে চড়ে বেশ ক’বার শিয়ালদহ গিয়েছি। সকাল ৭টায় ট্রেন ছিল। বাবা কতবারই না কলকাতা গিয়ে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরতেন, রানাঘাট-দর্শনা হয়ে পদ্মা পেরিয়ে রাজশাহী হয়ে এই দিনাজপুরের হিলি। তখন তো আর এতো জোরে ট্রেন চলতো না! তবু ৬/৭ ঘণ্টার মাঝেই কলকাতা চলে যাওয়া যেত। এখন তো আর সেই অবস্থা নেই? চোখের পলকে দ্রুত পালিয়ে যায় ট্রেন। আবারো যদি চলতো দার্জিলিং ও আসাম মেইল, বেঁচে থাকতেই আর একবার না হয় ছড়তাম।
কথার ফাঁকে দেখতেই ঝমঝম আওয়াজ করে চোখের পলকে দ্রুত পালিয়ে গেল একটি ট্রেন। ট্রেনটি উত্তরের পার্বতীপুর-চিলাহাটির দিকে যাবে! লেবেল ক্রসিংয়ে এপারে পান বিড়ির দোকান দিয়ে বসে আছেন এক দোকানী। ওপার আর এপার সীমান্তে কি হচ্ছে আর না হচ্ছে, সবকিছুই তার নখদর্পণে। ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর। দেশ ভাগের পর দিনাজপুর হলো দু’ভাগ, হিলিও হলো দু’ভাগ সাথে হাড়িপুকুর গ্রামটিও হলো দু’ভাগ। মৌজাটা যে রয়েছে সেটাও দু’ভাগ। ১০ বছর আগে ছিল ৮০/৯০টি পরিবার, এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭শ’ পরিবার।
স্থানীয় ভাষাই বলা হয়, না-এপার-না ওপার। ওদের কারো শোয়ার ঘর ভারতে, রান্না ঘর বাংলাদেশে। হিন্দুধর্মাম্বলীদের জন্য রয়েছে মন্দির, মুসলিমাধর্মাম্বলীদের জন্য রয়েছে মসজিদ। মসজিদটি বাংলাদেশের সীমানায় হলেও ভারত সীমানা মাড়িয়েই যেতে হয় মসজিদে। যেন ওরা সীমান্ত আইনের বাধ্যবাধকতা সবকিছু ভুলে একে অপরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ৬৬ বছর ধরে। এপারেও হিলি ওপারেও হিলি।
পান বিড়ি দোকানী বললেন, সন্ধে হলেই এখানে শুরু হয় হরেক রকম ব্যবসা। এখানে পাবেন নেশা সামগ্রী, আগ্নেয়াস্ত্র, ভারতীয় শাড়িসহ নানা রকম প্রসাধনী সামগ্রী ও পণ্য। এছাড়াও বসে মাদক বিক্রির হাট। আরো বসে চোরাকারবারিদের হাটবাজার। বসে থাকেন লাইনম্যান নামক সিন্ডিকেট সদস্যরা। সীমান্তরক্ষীদের টাকা না দিলেও সিন্ডিকেটদের দিতেই হয় টাকা।
বিবার্তা/শাহী/জহির
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]