শিরোনাম
পদ্মায় থেমে নেই ইলিশ ধরা, বিক্রি হচ্ছে পানির দামে
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৩০
পদ্মায় থেমে নেই ইলিশ ধরা, বিক্রি হচ্ছে পানির দামে
মাদারীপুর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

ডিম ছাড়তে মা ইলিশ ছুটে আসে পদ্মায়। ইলিশের এই প্রজনন মৌসুমে তাই ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে কিছুদিন। যাতে করে মা ইলিশ নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়তে পারে। তবে চিত্র ঠিক উল্টো!


নিষিদ্ধ মৌসুমেও থেমে নেই শিবচরের চারজানাজাত, বন্দরখোলা ও কাঠালবাড়ি এলাকার পদ্মা নদীতে ইলিশ শিকার। দেদারছে ইলিশ ধরছে জেলেরা। পদ্মার চরাঞ্চলের দূর্গম চর এলাকা সংলগ্ন পদ্মা নদীতে অনেকটা গোপনেই জেলেরা ব্যস্ত থাকে ইলিশ ধরায়।


প্রশাসনের নাকের ডগায় চরাঞ্চলের বিভিন্ন বাজারে দেদারছে বিক্রি করছে ডিমভর্তি মা ইলিশ। অনেক সময় আবার প্রকাশ্য বাজারে ইলিশ বিক্রি করতে না পারায় খুবই সস্তায় জেলেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছে ইলিশ। এ সময় সুযোগ বুঝে পুলিশ জেলেদের ধরে এনে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিচ্ছে। বেশির ভাগ সময়ই উদ্ধারকৃত মা ইলিশ পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।


স্বাভাবিক সময়ে যে ইলিশের বাজার মূল্য কেজিতে ৮শত থেকে এক হাজার টাকা সেই ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দেড়শত টাকায়! এতো সস্তায় ইলিশ পেয়ে স্থানীয় দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভিড় করছে পদ্মার পাড়ে। ব্যাগ বোঝাই করে ইলিশ নিয়ে ফিরছে বাড়িতে!



শিবচর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, ৭ অক্টোবর থেকে রবিবার পর্যন্ত ৩৯ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। পাঁচজনকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ৮০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল ও ৪০০ কেজি মা ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত মাছ আটটি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিতরণ করা হয়েছে।


এছাড়া গত শনিবার ১৬ জেলেকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও পাঁচজনের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে মোট পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন ভ্রাম্যমান আদালত।


সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নিষিদ্ধ মৌসুমে ইলিশ শিকার বন্ধে অভিযান চালানো হয় পদ্মায়। তবে দূর্গম অঞ্চল প্রায় সময়ই অভিযানের বাইরে থেকে যায়। জেলেরা কৌশলে গভীর রাতে ও খুব ভোরে পদ্মার বিভিন্ন এলাকায় মাছ শিকার করে থাকে। সেক্ষেত্রে ইলিশের জাল নদীতে ফেলে কৌশলে জালটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানিতে লুকিয়ে রেখে মাছ শিকার করে বলেও জানা গেছে।


উপজেলার চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ী ও বন্দরখোলা এলাকার চর সংলগ্ন পদ্মানদীতে জেলেরা ইলিশ ধরে থাকে। চরাঞ্চলের এই পদ্মার পাড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খুচরা বিক্রি হয় এই ইলিশ।



সরেজমিনে চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ি ও বন্দরখোলা ইউনিয়নের ইলিশ বিক্রির চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, অভিযান শুরু থেকেই প্রায় দিনই ভোর থেকেই ব্যাগ হাতে পদ্মার পাড়ে নারী-পুরুষের ভিড়। রয়েছে ছোট ছেলে মেয়েরাও। উদ্দেশ্য সস্তায় ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরবে।


ইলিশ কিনতে আসা আসলাম জানান, তিনি প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন। এই সময় পদ্মার পাড়ে সস্তায় ইলিশ পাওয়া যায়, এই খবরে তিনি মাছ কিনতে এসেছেন। তার দিনমজুর পিতার পক্ষে অন্য সময়ে দাম দিয়ে ইলিশ কেনা সম্ভব হয় না। তাই সস্তায় একটু বড় ইলিশ কিনতে কষ্ট করে এই দূর্গম চরে এসেছেন।


জেলেদের সাথে কথা বললে তারা জানান, পদ্মায় মাছ শিকারকারী জেলেরা বেশির ভাগই দরিদ্র। ঋণ করে জাল, নৌকা কিনে পদ্মায় মাছ ধরেন তারা। ফলে মাসে মাসে ঋণ পরিশোধের কিস্তি দিতেই হচ্ছে। তাছাড়া সংসারের খরচ তো আর থেমে নেই। তাই মাছ শিকার বন্ধ করা আর হয়ে উঠে না।


তারা আরো বলেন, মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় জেলেদের সরকারিভাবে সাহায্য দেয়ার কথা। কিন্ত এ পর্যন্ত কোনো সাহায্য আমরা পাই নাই।



চরজানাজাত এলাকার অপর এক জেলে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক) বলেন, আমি প্রথম দিকে এই সময় মাছ ধরতে যেতাম না। গত বছরও ধরিনি। কিন্তু অন্যরা তো ঠিকই ধরেছে। তারা মাছ বিক্রি করে পয়সা কামাচ্ছে। তাই এবার আমিও মাছ ধরতে নেমেছি। তবে দিনে একবারই পদ্মায় জাল ফেলি।


তিনি আরো বলেন, এ সময় অনেক সতর্ক থাকতে হয়। পুলিশের হাতে অনেকে ধরা পড়লে অনেক হয়রানি পোহাতে হয়। অনেক টাকা না দিতে পারলে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে জেল দেয়। আর যে জেলে পুলিশকে বেশি টাকা দিতে পারে শুধু তাদেরই পুলিশ ছেড়ে দেয়। কিন্তু মাছ ও জাল রেখে দেয়।
শিবচর উপজেলা মৎস কর্মকর্তা এটিএম শামসুজ্জামান (দায়িত্ব প্রাপ্ত) বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় আমরা প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছি পদ্মা নদীর মাদারীপুর অংশে। দিনের পুরোটা সময়ই আমরা পদ্মায় নজর রাখছি। তাছাড়া জেলেদের মাছ ধরা বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি যারা মাছ কিনতে আসছেন তাদেরও সচেতন করতে চেষ্টা করছি। তারপরও সাধারণ মানুষের ভিড় পদ্মার পাড়ে লেগে থাকে।


তিনি আরো বলেন, মাছ ধরা বন্ধের প্রথম দিন থেকেই আমরা অভিযান চালিয়ে আসছি। জেলেদের আটক, মাছ জব্দ এবং জাল ধ্বংস কার্যক্রম চলছে। তবে কত সংখ্যক জেলেকে এ পর্যন্ত আটক করে জেলা জরিমানা করা হয়েছে সে ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
তিনি আরো বলেন, মাছ ধরা এখনো নিষেধ। নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করার অভিযান চালাতে গিয়ে আমরা চরজানাজাত খাসেরহাট এলাকায় দুই অফিসার লাঞ্চিত হয়েছি। কিন্তু জেলেরা তো থেমে নেই। মাছ না ধরা ও বিক্রি কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।



শিবচর থানার অফিসার ইনচার্জ জাকির হোসেন মোল্লা জানান, জেলা ও উপজেলা মৎস্য অফিসের কর্মকর্তা মাঝে মধ্যেই নদীতে মা ইলিশ ধরা বন্ধ করার জন্য নদীতে অভিযানে নামে। তাদের চাহিদা মতো আমরা পুলিশ দিয়ে সহযোগিতা করি। পুলিশের কোনো লোক জব্দকৃত মাছ নেয় না বলে তিনি দাবি করেন।


মাদারীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুস সাত্তার জানান, গত কয়েকদিন ধরেই আমরা নদীতে অভিযান পরিচালনা করে আসছি। কিন্ত অভিযানকালে জীবিত মাছ আমি পানিতে ছেড়ে দেই। কিন্ত পুলিশ তখন আপত্তি করে। তাতে বুঝলাম মাছের প্রতি পুলিশের অনেক লোভ আছে। জেলেদের আটক করা হচ্ছে। গত শনিবার সকাল থেকে ৫৪ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
বিবার্তা/রবিউল/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com