শিরোনাম
দিনাজপুরে ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০১৮, ২২:২৬
দিনাজপুরে ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস
দিনাজপুর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

শুক্রবার (২৪ আগস্ট) ছিল দিনাজপুরের ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস। পুলিশ হেফাজতে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ২৩ বছর পূর্ণ হলো এদিন। দিনটি 'নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করেন স্থানীয়রা।


১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরের কয়েকজন বিপদগামী পুলিশ সদস্য ওই কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। ঘটনার পর থেকেই দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।


ইয়াসমিনের মা শরিফা খাতুন দেশের সকল রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক সংগঠনের নেতাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিশু ও নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোর আইন প্রনয়ন এবং সামাজিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহবান জানান।


১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সর্বস্তরের জনতা। তখন প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে দিনাজপুর শহরের সামু, সিরাজ, কাদেরসহ সাতজন নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত হন। এরপর তৎকালীন দিনাজপুর সিআইডি জোনের এএসপি আফজাল আহমেদ বাদী হয়ে অভিযুক্ত ৩ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন।


মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি মাহফুজার রহমান তদন্ত শেষে তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেবসহ নয়জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করেন। মামলাটি নিরাপত্তাজনিত কারণে দিনাজপুর থেকে রংপুরে স্থানান্তর করা হয়।


তৎকালীন রংপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মতিনের আদালতে ইয়াসমিন হত্যা মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে ২০০৭ সালের ৩১ আগস্ট ৩ পুলিশ সদস্যেকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের দেয়া রায় পরে উচ্চতর আদালতে বহাল থাকে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি পুলিশের এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার এবং পিকআপ চালক অমৃত লালের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।


দিনটি স্মরণে মহিলা পরিষদ, বালুবাড়ী মহিলা উন্নয়ন সংস্থা, পল্লীশ্রীসহ বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়াসমিনের কবর জিয়ারত, দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এছাড়া ইয়াসমিনের মা শরিফা বেগম তার দিনাজপুর শহরের লালবাগ মহল্লার বাড়িতে কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন।


বর্বরোচিত সেই ঘটনা


দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার গরিব ঘরের শরীফা বেগমের মেয়ে ইয়াসমিন। গরিব পরিবারে জন্ম নেয়ায় চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে পেরেছিল সে। টাকা জমিয়ে আবার লেখাপড়া করার স্বপ্ন বুকে নিয়েই পাড়ি জমায় ঢাকায়। ঢাকায় এসে একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেয়। আট-নয় মাস কাজ করার পর নিজের বাড়িতে যেতে চায়। কিন্তু গৃহকর্তা তাকে দুর্গা পূজায় বাড়িতে যেতে বলেন। কিন্তু মায়ের জন্য মন ছুটে যায় ইয়াসমিনের। আর সে কারণেই হয়তো ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় ইয়াসমিন।


১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন। ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়ে সে। বাসটি রাত ৩টার পরে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় এসে পৌঁছায়। তিন রাস্তর মোড় বলে সেখানে রাতেও চায়ের স্টল, খাবারের দোকান প্রায়ই খোলা থাকে। বাসের সুপারভাইজার খোরসেদ আলম ও হেলপার সিদ্দিকুর রহমান ইয়াসমিনকে সেখানে নামিয়ে জনৈক চা দোকানদার জোবেদ আলীকে অনুরোধ করেন, যেন ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী কোনো গাড়িতে উঠিয়ে দেন।


সে সময় জয়ন্ত নামে একজন যাত্রীও বাস থেকে নামেন। বাস থেকে নেমে জয়ন্ত ও ইয়াসমিন জোবেদ আলীর চায়ের দোকানের পাশেই একটি দোকানে নাস্তা খায়। আবদুর রহিম নামে এক পান দোকানদার ইয়াসমিন কীভাবে দিনাজপুরের রামনগরে যাবে জানতে চাইলে জয়ন্ত তাকে পৌঁছে দেবে বলে জানান। এ সময় উপস্থিত কয়েকজন আপত্তি জানিয়ে ইয়াসমিনকে তারাই দিনাজপুরগামী গাড়িতে তুলে দিতে চান।


এরপর বীরগঞ্জ থেকে আসা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের (নং-ম-০২-০০০৭) চালক অমৃতলাল বিষয়টি জানতে চান। পিকআপ ভ্যানে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল এবং আব্দুস সাত্তার বসে ছিলেন। অমৃতলাল এ সময় ইয়াসমিনকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে ইয়াসমিন সকাল না হওয়ায় যেতে সাহস পায়নি। এরপর অমৃতলাল ধমক দিয়ে তাকে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যান।


যাওয়ার সময় ইয়াসমিন তাদের কুমতলব আঁচ করতে পেরে অন্ধকারে পিকাপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায়। এরপর পিকআপ ভ্যানটি আনুমানিক তিনশ গজ দূরে সাধনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে দাঁড় করিয়ে পুলিশ টর্চ দিয়ে তাকে খুঁজতে থাকে। এ সময় দু’জন রিকশাচালকের কাছে পুলিশ জানতে চায়, তাদের পিকআপ ভ্যান থেকে যে মেয়েটি লাফ দিয়েছে, তাকে তারা দেখেছে কি-না? ঠিক ওই মুহূর্তে ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী একটি নৈশ কোচের হেডলাইটের আলোয় পুলিশ এবং রিকশাচালকরা ইয়াসমিনকে রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর পুলিশ আবার ইয়াসমিনকে পিকআপ ভ্যানে তুলে নেয়।


পরে ওই এলাকার লোকজন রাস্তায় রক্তের দাগ, পাশে ইয়াসমিনের জুতা, রুমাল, হাতপাখা ও ভাঙা চুড়িও পড়ে থাকতে দেখেন। এর ঘণ্টা তিনেক পরে গোবিন্দপুর সড়কে ব্যাাক অফিসের সামনে ইয়াসমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর উত্তর গোবিন্দপুর এলাকায় পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশে কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) স্বপন কুমার প্রকাশ্যে লাশ বিবস্ত্র করে ফেললে উৎসুক জনতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং ঘটনার পরদিনই দিনাজপুরে এ হত্যাকারন্ডর প্রতিবাদে এবং হত্যা ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।


এলাকাবাসীর অভিযোগ, দিনাজপুর কোতোয়ালি পুলিশ বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য ‘একজন অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা করে। লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বালুবাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের কোনো ধরনের গোসল ও জানাজা পড়ানো হয়নি।


২৫ আগস্টের বিক্ষোভে নারী-পুনুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সাতজন। ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে ইয়াসমিনের পরিবারকে হুমকিও দেয়া হয় অনেকবার।


দিনাজপুরে পুলিশী হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিলো কিশোরী ইয়াসমিনের ঘটনায় উত্তাল হয়ে পড়েছিলো দিনাজপুর। পুলিশি হেফাজতে তরুনী ইয়াসমিন ধর্ষন ও হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে আইন-শৃংখলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলো সামু,সিরাজ ও কাদেরসহ নামে ৭জন। আহত হয় আরও শতাধিক মানুষ। পরবর্তীতে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বিক্ষুদ্ধ জনতা দিনাজপুর কোতয়ালী থানা,৩টি পুলিশ ফাড়ি,কাস্টমস গোডাউন, ৪টি পত্রিকা অফিস সহ বেশ কিছু স্থাপনা ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়।


ডেটলাইন ২৪ আগষ্ট


স্থান: দশ মাইল মোড়। সময় তখন ভোর ৪টা। দিনাজপুর শহর অভিমুখে ফিরতে অপেক্ষামান তরুণী ইয়াসমিন। ফজরের নামাজ পড়তে বের হওয়া স্থানীয় মুসল্লিরা নিরাপদে যেতে তাকে তুলে দিলেন একটি পুলিশ ভ্যানে। মুসল্লিরা কোতয়ালী পুলিশকে অনুরোধ করলেন তরুনীকে দিনাজপুরে পৌছে দিতে। কিন্তু পুলিশ ভ্যানে উঠেই ইয়াসমিনকে বিদায় নিতে হয় পৃথিবী থেকে। ১০ মাইল থেকে দিনাজপুর শহরে আসার পথে ব্রাক স্কুলের সামনে ভোরের দিকে পুলিশ ভ্যানে উপস্থিত ৩ জন সদস্য এসআই মইনুল কনেস্টবল সাত্তার ও অমৃত ইয়াসমিনের শ্লীলতাহানী ঘটিয়ে চলন্ত পিক আপ ভ্যান থেকে ছুড়ে ফেলে দিলে তার মৃত্যু ঘটে।


ইয়াসমিনের এই হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যার জের ধরে বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার জনতা কোতয়ালী থানা ঘেরাও করে। লুট হয় একে একে কাষ্টমস্ গোডাউনসহ শহরের বিভিন্ন সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। জ্বালিয়ে দেয়া হয় ৪টি পত্রিকা অফিস ও প্রেসক্লাব। ২৭ আগষ্ট বিক্ষুব্ধ জনতা একে একে রাজপথে নেমে এসে সকল প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি এবং দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি করলে জনতার উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলী করে। এ ঘটনায় সামু, কাদের ও সিরাজসহ ৭ জন নিহত হয়। আহত হয় আরও শতাধিক ব্যক্তি। তারা এখনও বেঁচে আছে মৃত্যু যন্ত্রণায়।


দিনাজপুর থেকে নিরাপত্তাজনিত কারনে ইয়াসমিন হত্যা মামলাটি স্থানান্তর করা হয় রংপুরে। রংপুর বিশেষ আদালতে ইয়াসমিন হত্যা মামলার স্বাক্ষ্য প্রমান শেষে দোষী প্রমানিত ৩ পুলিশ সদস্যেকে ফাঁসি দেয়া হয়। উপমহাদেশের ইতিহাসে দোষী পুলিশদের ফাঁসিতে মৃত্যু কার্যকরের ঘটনা এটাই প্রথম।


ইয়াসমিনের স্মরণে দিনাজপুরের দশ মাইল এলাকায় তৈরী করা হয়েছে ইয়াসমিন স্মরণী। দিবসটি বিভিন্ন সংগঠন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। দিবসটি পালনে ইয়াসমিনের পরিবার এবং বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল, কবর জিয়ারত ও আলোচনা সভাসহ গ্রহন করেছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ইয়াসমিন ট্রাজেডি’র কালের স্বাক্ষী এই ইয়াসমিনের মা। ইয়াসমিনের মায়ের প্রাণের দাবি- আর যেন না ঘটে আইন-শৃংখলা বাহিনী’র হেফাজতে ইয়াসমিন ট্রাজেডি’র মতো জঘন্যতম ঘটনা।


বিবার্তা/শাহী/কামরুল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com