শিরোনাম
দিনাজপুর কঠিন শিলা প্রকল্প থেকে ৩ লাখ টন পাথর গায়েব
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০১৮, ১৬:১০
দিনাজপুর কঠিন শিলা প্রকল্প থেকে ৩ লাখ টন পাথর গায়েব
দিনাজপুর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

দিনাজপুররে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা গায়েবের পর এবার দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন পাথর গায়েব হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মধ্যপাড়া খনি থেকে গায়েব হওয়া পাথরের মূল্য প্রায় ৫৬ কোটি টাকা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।


দিনাজপুরের পার্বতীপুররে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল) থেকে এ পাথর গায়েবের অভিযোগ উঠে। গত ২৯ জুলাই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সভায় পাথর গায়েবের এ তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। বোর্ড সভায় কোম্পানির মহাব্যবস্থাপকের দেয়া একটি তদন্ত প্রতিবেদনে এই বিপুল পরিমাণ পাথর গায়েবের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।


এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য এখন কোম্পানির পক্ষ থেকে ‘পুরো পাথর দেবে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। বোর্ড সভায় এ ঘটনায় অধিকতর তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।


যদিও খনি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, এটা হিসাবের ভুল। পদ্ধতিগত লোকসান (সিস্টেমলস) ও মাটির নিচে পাথর দেবে যাওয়ায় এই গড়মিল দেখা দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ আরো দাবি করেছে, এক বছরে এক লাখ ৬ হাজার ৪৯৬ টন পাথর মাটিতে দেবে গেছে। তারা হিসাবের এই পার্থক্যটুকু কোম্পানির আর্থিক বিবরণীর সঙ্গে সমন্বয় করার দাবি জানিয়েছে।


তবে কোম্পানির সাবেক কর্মকর্তা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা খনি কর্তৃপক্ষের দাবিকে অবাস্তব উল্লেখ করে বলেছেন, এক বছরেই এক লাখ টন পাথর মাটিতে দেবে যাওয়া অবাস্তব ব্যাপার। মাটিতে দেবে গেলেও তা তোলা সম্ভব। নির্ঘাত পাথর চুরি হয়েছে।


তারা আরো বলছেন, কঠিন শিলা খনির দায়দায়িত্বে যারা ছিলেন বা আছেন তাদের জবাবদিহি করা উচিত। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের গাফিলতি বিশেষ করে এ খনি কোম্পানির পরিচালনা পরিষদ ও পেট্রোবাংলার সঠিক তদারকির অভাবে এমনটি ঘটছে বলে তারা মনে করেন।


জানা গেছে, এ খনি থেকে ২০০৭ সালের ২৫ মে বাণিজ্যিকভাবে পাথর তোলা শুরু হয়। প্রথমে উত্তর কোরিয়ার কোম্পানি নামনাম পাথর তোলার দায়িত্বে ছিল। পরবর্তীকালে বেলারুশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া টেস্ট কনসোর্টিয়ামকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়।


নিরীক্ষায় উত্তোলিত ও বিক্রীত পাথরের মধ্যে ব্যবধান অনেক। এর পরিমাণ তিন লাখ ৫৯ হাজার ৮১৬ টন। সংশ্লিষ্টরা এই পাথরের একটা বড় অংশ চুরি হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তাদের মতে, কিছু সিস্টেমলস থাকতেই পারে। পাথর মাটির নিচে কিছু দেবেও যেতে পারে। তবে তা এক অর্থবছরে (২০১৬-১৭) এক লাখ টন হতে পারে না। এটা অবাস্তব।


আলোচ্য সময়ে কঠিন শিলা কোম্পানির দায়িত্ব পালনকারী এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, ২০১৫ সাল থেকে দীর্ঘদিন পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। সে সময়ে বরং মাটিতে দেবে যাওয়া পাথর তুলে বিক্রি করা হয়। তাই এক লাখ টন পাথর দেবে যাওয়ার যুক্তি হাস্যকর।


ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, পাথর কাটার সময় গুঁড়ো (ডাস্ট) পাওয়া যায়। পাথর তোলার সময়ও ডাস্ট থাকে। এই ডাস্ট বিক্রিও হয়। এতে কী পরিমাণ সিস্টেমলস হতে পারে তা পরিমাপের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি রয়েছে। তাই সিস্টেমলস হয়েছে না চুরি হয়েছে তদন্তের মাধ্যমে তাও ধরা সম্ভব।


ওই কর্মকর্তা বলেন, ঠিকাদারের সঙ্গে এমন করে চুক্তি করা হয়েছিল যাতে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। ঠিকাদার যত পাথর উত্তোলন করবে সে অনুসারে বিল পাবে। ফলে অনেক সময় হয়তো সে পাথর কম তুলে বেশি হিসাব দেখিয়েছে। এভাবেও ফাঁকি দেয়া হতে পারে।


খনি কর্তৃপক্ষের দাবি, নামনাম পাথর তোলার সময় ওজন করলেও এই পাথর বাণিজ্যিক আকারে ভাঙার সময় ক্র্যাশিং পয়েন্টে কোনো ওজন মেশিন ছিল না। এছাড়া পাথর তাৎক্ষণিকভাবে বিক্রি করা হতো না। খনি এলাকার বিভিন্ন স্থানে স্তূপাকারে মজুদ করা হতো। ফলে অনেক পাথরখন্ড মাটিতে দেবে যায়।


সূত্র জানিয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনেও ‘উধাও’ পাথর মাটির নিচে দেবে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে চলতি বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত কোম্পানির সমন্বয় সভায় বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) আবু তালেব ফরাজীকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।


তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ পর্যন্ত উত্তোলন করা পাথরে ১৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ পরিমাপগত ভুল ও ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ পদ্ধতিগত লোকসান হয়েছে। আর্থিক বিবরণী অনুসারে ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে পাথর উত্তোলন করা হয় ১৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৯ টন। কমিটির হিসাবকৃত পরিমাপগত ভুল ও সিস্টেমলস বাদ দিলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ লাখ আট হাজার ৫৬২ টন। অর্থাৎ ঘাটতি দাঁড়ায় দুই লাখ ২৭ হাজার ২৩৩ টন। পরবর্তীকালে ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত জিটিসি কর্তৃক উত্তোলিত পাথরের দুই দশমিক ০৫ শতাংশ সিস্টেমলস হিসাব করা হয়।


আর্থিক বিবরণী হিসাবে জিটিসি চার বছরে ১২ লাখ ৭২ হাজার ৫৩৭ টন পাথর তোলে। কমিটির হিসাব করা সিস্টেমলস বাদ দিলে হিসাবে ঘাটতি দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৮৭ টন। কমিটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক লাখ ছয় হাজার ৪৯৬ টন পাথর মাটিতে দেবে গেছে।


কমিটি তাদেও প্রতিবেদনে দাবি করেছে, সব মিলিয়ে ২০০৬-০৭ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে তিন লাখ ৫৯ হাজার ৮১৬ টন পাথর হিসাব আর্থিক বিবরণীতে বেশি দেখানো হয়েছে। কমিটি বলছে, এই পরিমাণ পাথর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আর্থিক বিবরণীতে মজুদ হিসাবে দেখানো হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ধরা হয়েছে ২৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা।


তারা সুপারিশ করেছেন, উৎপাদনের সঙ্গে আর্থিক বিবরণীর মিল রাখার স্বার্থে এই অর্থ ও মজুদের হিসাবটা সমন্বয় (অবলোপন) করা যায়। প্রতিবেদনের সঙ্গে খনি কর্তৃপক্ষ সহমত পোষণ করে পরিচালনা পরিষদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে আরো বলা হয়, এই হিসাব সমন্বয় করলে কোম্পানির লোকসান আরো বাড়বে।


জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও খনি প্রকৌশলী ড. চৌধুরী কামারুজ্জামান বলেন, খনির পুরো ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজড না হলে এরকম দুর্নীতি ও অনিয়ম হতেই থাকবে। এখানে সিস্টেমলস হতে পারে। তবে তা তিন থেকে চার শতাংশের বেশি হবে না। আর মাটিতে দেবে গেলেও সে পাথরের একটা বড় অংশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।


জানতে চাইলে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এসএম নুরুল আওরঙ্গজেব (কয়লা খনি কর্তৃপক্ষের সাবেক এমডি, কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে) বলেন, তার আগের কর্তৃপক্ষ ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদফতরের এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। পরে পরিচালনা পরিষদ আবার খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিলে তাদের কর্মকর্তার নির্দেশে যাচাই-বাছাই করেই আবার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এরপর পরিচালনা পরিষদ এ বিষয়ে অধিকতর স্বচ্ছতার জন্য স্বাধীনভাবে যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেয়। এখন সে অনুসারে বাইরে বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে বিষয়টি নিরীক্ষা করা হবে।


কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রুহুল আমিনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে একটি তদন্ত কমিটি গঠনরে কথা স্বীকার করেছেন। দিনাজপুরের মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড এর এমডি জাবেদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোন ধরেননি।


বিবার্তা/শাহী/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com